■ বকুল আহমেদ
হাসপাতালের রোগীদের জিম্মি করে রাখা, তাদের বাইরের ক্লিনিকে যেতে বাধ্য করে রাখা, ওষুধ-পথ্য ঠিক মতো না দেয়াসহ দালাল ও কর্মচরীদের অপতৎপরতা, শয্যা বিক্রিসহ নানা অনিয়ম প্রসঙ্গে পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল সাফী মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, যেসব ওষুধ রোগীদের পাওয়ার কথা সেগুলো তাদের দেয়া হয়। কিন্তু যুগান্তরের অনুসন্ধানকালে আমরা পেয়েছি ভিন্ন চিত্র। হাসপাতালের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের এক্স-৩ নম্বর বেডের রোগী মাহতাবের কাছ থেকে একটি লিস্ট পেয়েছি।
তাতে দেখা যায়, চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় হাতে যে গ্লাবস পরেন সেই গ্লাবস ও ক্যানোলাসহ ৯ ধরনের ওষুধ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার জন্য রোগীর হাতে লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দেয়া হয়। চিকিৎসকের জন্য প্রয়োজনীয় গ্লাবস রোগীকে কেন বাইরে থেকে কিনতে হবে তার কোন সদুত্তর নেই কারও কাছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একটি সিরিঞ্জ পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে রোগীদের দেয়া হয়নিÑ এমন প্রশ্নের জবাবে পরিচালক বলেন, সিরিঞ্জ এখন স্টোরে নেই। কিছু চিকিৎসক রোগীকে এই হাসপাতালে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন বাইরের ল্যাবে পাঠান- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ অভিযোগ আমার কাছে নেই। শয্যা বিক্রির অভিযোগও এখন পাইনি।সেবা নয় যেন রাজনৈতিক মঞ্চ : জাতীয় হƒদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সেবার মান যাই থাক না কেন, চিকিৎসক কিংবা কর্মচারীদের মধ্যে রাজনৈতিক দলাদলি থেমে নেই। তাদের এই গ্র“পিংয়ের কবলে পড়ে অনেক সময় রোগীদেরও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অন্যদিকে রাজনৈতিক আনুকূল্য পাওয়ায় সরকারদলীয় চিকিৎসক ও কর্মচারীরা যে কোন কাজ করেন চরম দাপটের সঙ্গে। অনিয়ম-দুর্নীতি যেন তাদের কাছে কিছুই নয়। কর্মরত অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে রাতারাতি কোটিপতি বনে যান। অনেকে নিয়ে থাকেন নিয়মবহির্ভূত সুযোগ-সুবিধা। অনুসন্ধানে জানা যায়, হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক কাজল কর্মকার গত এক বছরে দু’বার আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন। তার মতো এমন অনেকেই বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির টাকায় বিদেশও ভ্রমণ করেন বলে জানা গেছে। এদিকে চিকিৎসকদের পাশাপাশি হাসপাতালের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী সংগঠনও বেশ দাপুটে। এ সংগঠনের কাছে অনেক সময় চিকিৎসকরাও জিম্মি হয়ে পড়েন। হাসপাতাল ভবনের দক্ষিণ গোলকের বেজমেন্টের পাশে ১৭ নম্বর কক্ষ দখল করে আছে হাসপাতালের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী সংগঠন। তারা সংগঠনের অফিস বৃদ্ধির জন্য ১৮ এবং ১৯ নম্বর কক্ষও দখল করে দুই কক্ষের মাঝের দেয়াল মাসখানেক আগে ভাঙা শুরু করলে কর্র্তৃপক্ষ বাধা দেয়। ৪র্থ শ্রেণী সংগঠনের নেতারা ১৮ ও ১৯ নম্বর কক্ষ দখল নিতে কর্তৃপক্ষকে চাপ দিচ্ছে। তবে এ বিষয়ে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী সংগঠনের সভাপতি শহিদুল ইসলাম শহিদ যুগান্তরকে বলেন, কর্তৃপক্ষই ওই কক্ষগুলো সংগঠনের জন্য লিখিতভাবে বরাদ্দ দিয়েছে। জোর করে কোন কক্ষ দখল করা হয়নি। রিং বেচাকেনা : অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, ক্যাথ ল্যাবের সামনে কোম্পানির প্রতিনিধিরা রিং নিয়ে বসে থাকেন খদ্দেরের অপেক্ষায়। বিভিন্ন ক্যাটাগরির রিংয়ের মূল্য নির্ধারণের তালিকা ক্যাথ ল্যাব ওয়েটিং রুমের দেয়ালে টাঙ্গানো আছে। কোন রোগীর রিংয়ের প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক পছন্দের কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন রোগীকে। যে কোম্পানি চিকিৎসককে তুলনামূলক বেশি কমিশন দেয় সেই কোম্পানির রিংই রোগীকে নিতে বলেন তারা। সুবিধা বুঝে রিংয়ের মূল্য নির্ধারণ : হƒদরোগ হাসপাতালে প্রায় ২৬টি কোম্পানি বিভিন্ন দেশ থেকে রিং বা স্টেন্ট আমদানি করে বিক্রি করে থাকে। এসব রিংয়ের ক্যাটাগরি অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ মূল্য নির্ধারণে দুর্নীতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ তুলেছেন। নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন রিং সরবরাহকারী যুগান্তরকে জানান, কোবাল্ট ক্রমিয়াম স্টেন্ট বা রিং সব কোম্পানির একই ক্যাটাগরির হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৩টি কোম্পানির রিংয়ের মূল্য নির্ধারণ করেছে ৬৫ হাজার টাকা। অপরদিকে বাকি কোম্পানিগুলোর একই ক্যাটাগরির রিংয়ের মূল্য নির্ধারণ করেছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। হার্টের মুমূর্ষু রোগীদের জন্য এই রিং পরানো জরুরি বিধায় মারাÍকভাবে আক্রান্ত হয়ে বিপদের সময় তাদেও যে রিংই পরানো হয় তারা সেটাই মেনে নেন। আর মুমূর্ষু রোগীদের এই রিং কেনাকাটা নিয়ে খোদ চিকিৎসকরাই নানা ধরনের অনিয়ম করে থাকেনÑ এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। রিং সরবরাহকারীদের মধ্যে একজন যুগান্তরের কাছে অভিযোগ করে বলেছেন, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ওই ৩টি কোম্পানির রিংয়ের মূল্য বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। পিসিসিইউ ওয়ার্ডের এক্স-১১ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন দানিয়েল (৫৫) যুগান্তরকে জানান, হাসপাতাল থেকে তাকে গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট ছাড়া কিছুই দেয়া হয়নি। তাকে সিরিঞ্জ পর্যন্ত বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। ১৬ এপ্রিল সকালে কার্ডিনেক্স-৬০ ইনজেকশন ৪১০ টাকা দিয়ে বাইরে থেকে কিনেছেন। ইন্সটিটিউটের উপপরিচালক ডা. এসটিএম আবু আজম যুগান্তরকে বলেন, কার্ডিনেক্স-৬০ হাসপাতাল থেকে রোগীকে দেয়ার কথা। হয়তো শেষ হয়ে গেছে, তাই বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। ৯০ ভাগ ওষুধ কিনতে হয় বাইরে থেকে : হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শতকরা ৯০ ভাগ ওষুধ তাদের বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে হয়। যদিও কর্তৃপক্ষ বলার চেষ্টা করেছেন ওষুধের সরবরাহ কম থাকায় রোগীরা বাধ্য হয়ে বাইরের ওষুধ কেনেন। তবে রোগীদের বক্তব্য হচ্ছে, হাসপাতালের জন্য সরকারি বরাদ্দের টাকায় ওষুধ কেনা কিংবা সরবরাহ করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। তাদের কাছে ওষুধ থাকা বা বরাদ্দের ওষুধ বাইরে চলে যাওয়ার বিষয়ে দায়িত্বও তাদের নিতে হবে। বিভিন্ন ওয়ার্ডের ২০ জন রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ ২০ জনের একজনকেও কোন ধরনের ইনজেকশন হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়নি। কার্ডিওলজি ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ৬ নম্বর ইউনিটের ২৩ নম্বর বেডে ভর্তি কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা কুদ্দুস মল্লিক। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ১৭ এপ্রিল যুগান্তরকে জানান, কয়েকদিন আগে সিটি এনজিওগ্রাম করিয়েছেন। এটি করতে সরকারি ফি ৩ হাজার টাকা। সরকার নির্ধারিত ফি’র টাকা দেয়ার পরও সিটি এনজিওগ্রাম করাতে যাবতীয় ওষুধ তাকেই কিনতে হয়েছে। তিনি বলেন, ওষুধ হাসপাতাল থেকে দেয়ার নিয়ম। নিয়ম শুধু তাদের খাতা-কলমেই। বাস্তবে জিরো। কুদ্দুস মল্লিক আরও বলেন, সাড়ে ৩ হাজার টাকার ওষুধ কিনেছি সিটি এনজিওগ্রাম করাতে। এখনও অন্যান্য ওষুধ কিনতে হচ্ছে। হাসপাতাল থেকে নামমাত্র ২/১টা ট্যাবলেট দেয়া হয় বলেও জানান তিনি। অনুসন্ধানকালে দেখে যায়, জরুরি বিভাগের সামনে দালালদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি। তারা নির্ধারিত ক্লিনিকের কমিশনভিত্তিক দালাল। আর এসব ক্লিনিকে হƒদরোগ হাসপাতালের অধিকাংশ ডাক্তারই ব্যস্ত সময় কাটান। যেন তাদের মন পড়ে থাকে এখানে। ওই চিকিৎসকদের কেউ কেউ আবার এসব ক্লিনিকের পরিচালনাকারীও। জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসকই রোগীর কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পছন্দের ক্লিনিকে কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠান। সঙ্গে দালালও ঠিক করে দেন।পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও অতিরিক্ত টাকা লাগে : ‘৫০ টাকা বেশি দেন নইলে রিপোর্ট পাবেন না। ভেতরে (সংশ্লিষ্ট কক্ষ) স্যারকে দিতে হবে।’ হাসপাতালের কর্মচারী ইউসুফ ১৯ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টায় মিরপুর-২ এর পিডব্লিউডি স্টাফ কোয়ার্টার থেকে আসা জীবননাহার নামের এক রোগীর কাছে এভাবেই অতিরিক্ত ৫০ টাকা দাবি করে। জীবননাহার ইসিজি করিয়েছিলেন। ইসিজি করাতে সরকারি ফি ৮০ টাকা। কিন্তু ইউসুফ দাবি করে ১৩০ টাকা। অতিরিক্ত টাকা নেয়ার বিষয়ে ওই রোগী হাসপাতাল পরিচালকের কাছে ইউসুফের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। এ অভিযোগের কথা স্বীকার করে উপপরিচালক ডা. এসটিএম আবু আজম যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত করে অভিযুক্ত কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জীবননাহারের মতোই অন্য রোগীদের এভাবে জিম্মি করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু কর্মচারী।অনুসন্ধানকালে পিসিসিইউ ওয়ার্ডের চিত্রও পাওয়া গেছে। সেখানে ওয়ার্ডবয়দের পোয়াবারো। কারণ সেখানকার বেড দিনে ২ জন রোগীর কাছেও তারা বিক্রি করতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় সব ধরনের রোগীকে ওই ওয়ার্ডে নেয়া হয়। এরপর রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী তাকে অন্য ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। ওই ওয়ার্ডে রোগীদের বেড পেতে হলে ওয়ার্ডবয়দের ২০০ থেকে ৪০০ টাকা দিতে হয়। ওই ওয়ার্ডের একেকটি বেড প্রতিদিন একাধিক রোগীর কাছে বিক্রি করা হয়। অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, ক্ষেত্র বিশেষে চিকিৎসকরাও কর্মচারী বা ওয়ার্ডবয়দের কাছে অসহায়। মাস দেড়েক আগে এক চিকিৎসক তার গ্রামের এক রোগীর জন্য ওই ওয়ার্ডের এক ওয়ার্ডবয়কে একটি বেডের ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু ওয়ার্ডবয় চিকিৎসকের কথার তোয়াক্কা করেনি। ওই চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে জানান, ডাক্তাররা যে কাউকে বেডে ওঠাতে পারেন না। এসব নিয়ন্ত্রণ করে কর্মচারীরা। হাসপাতালের নন-পেয়িং বেড যে বেচাকেনা হয় সেই তথ্য বের করার জন্য যুগান্তর প্রতিবেদক ১৮ এপ্রিল বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে পিসিসিইউ ওয়ার্ডে এক রোগীর শয্যার প্রয়োজনের কথা জানান কর্তব্যরত এক ওয়ার্ড বয়কে। তিনি বলেন, ৩০০ টাকা লাগবে। দুটি বেড এখন খালি হবে। টাকা দিলে তাড়াতাড়ি দেন। নইলে অন্য রোগীকে দিয়ে দেব। বেডের জন্য সব রোগীর লোকই টাকা নিয়ে হাঁ করে থাকেন।বিনামূল্যের শয্যা বিক্রি ঠেকাতে পারছে না কর্তৃপক্ষ : হাসপাতালের পুরুষ রোগীদের জন্য ৪, ৫, ৬ এবং গরিব মহিলাদের জন্য ৩ নম্বর ওয়ার্ডের শয্যা বিনামূল্যে পাওয়ার কথা। এছাড়া পিসিসিইউ ওয়ার্ডের শয্যাও বিনামূল্যে রোগীদের দেয়ার নিয়ম। কিন্তু এসব ওয়ার্ডের ৮০ ভাগ শয্যা রোগীদের কিনতে হয় ওয়ার্ডবয় কিংবা কর্মচারীদের কাছ থেকে। ২শ’ থেকে ৪শ’ টাকা পর্যন্ত এ শয্যা বিক্রি হয়। প্রতিদিন অন্তত ৬০ থেকে ৭০টি বিনামূল্যের শয্যা বিক্রি করা হয় রোগীদের কাছে। এ খাতে প্রতিদিন শয্যা বিক্রি করে অন্তত ১৫ হাজার টাকা, প্রতি বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু কর্মচারী বা ওয়ার্ডবয়। এ টাকার ভাগ সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড মাস্টাররাও পান বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে। ১২ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১১টায় কার্ডিওলজি (পুরুষ) ৪নং ওয়ার্ডে ঢুকে দেখা গেল ফ্লোরে শুয়ে আছেন ভোলা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা নাছির আহম্মেদ। তিনি যুগান্তরকে জানান, হার্টের সমস্যার কারণে ১১ এপ্রিল ওই ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন। বেড (শয্যা) পাননি। ফলে ফ্লোরেই তার জায়গা হয়েছে। তিনি আরও জানান, প্রথম দিনেই এক ব্যক্তি (হাসপাতাল কর্মচারী) এসে তার কাছে ২০০ টাকা দাবি করে বলেছিল, টাকা দিলে বেড পাওয়া যাবে। টাকা ছাড়া বেড হবে না। ১২ এপ্রিল তিনি ওই ব্যক্তিকে ২০০ টাকা দেন একটি বেডের জন্য। এ সময় যুগান্তর প্রতিবেদক হাসপাতালের ওই কর্মচারীকে হাতেনাতে ধরে তার নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি স্বভাবসুলভভাবেই বলেন, নাম জেনে লাভ নেই। বেড লাগলে ২০০ টাকা দেন। সন্ধ্যার মধ্যে রোগীকে বেডে ওঠানো হবে। গত ১৭ এপ্রিল দুপুর ১১টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে গিয়ে লালবাগ এলাকার কুসুম সেকান্দার (৪৮) নামের একজন রোগীর চিকিৎসাসেবার নমুনা দেখা গেছে। তার ছেলে মেহেদি হাসান সজল ও ভাই রাজন তাকে নিয়ে আসেন। তারা প্রথমে জরুরি বিভাগে ঢোকেন। ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. সুব্রত কুমার সাহা রোগী কুসুমের ওষুধ-পথ্য দিয়ে বলেন, রোগীর ইকো করাতে হবে। হাসপাতালে ইকো করানো যাবে না। বাইরে থেকে ইকো করিয়ে আনতে হবে। এরপর তিনি একজন দালালকে ডাকেন। তাকে বলেন, মুন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে গিয়ে ইকো করিয়ে আনো। চিকিৎসকের কথামতো ওই দালাল রোগীকে নিয়ে যায় হƒদরোগ ইন্সটিটিউটের বিপরীতে প্রধান সড়ক থেকে একটু ভেতরে অবস্থিত মুন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। যুগান্তরের এই প্রতিবেদক রোগীর আÍীয় সেজে রোগীর সঙ্গে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যান। ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একাউন্টে বসা এক ব্যক্তি দালালকে বলেন, আরও অন্তত ৫ জন রোগী আজ আনতে হবে। এরপর দেখা গেল কুসুমের ইকো করাতে ২০৫০ টাকা নেয়া হল। ওই দালাল সেখান থেকে ১০০ টাকা কমিশন হাতে নিয়ে আবার হাসপাতালের দিকে ছুটে যায়। রোগী কুসুমের ছেলে সজল যুগান্তরকে জানান, ডাক্তার বলেছেন, হাসপাতালে ইকো করানো যাবে না। অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিদিন অন্তত ৫ শতাধিক রোগীকে ইসিজি করাতে হয়। এর মধ্যে হাসপাতাল থেকে করানো হয় ৩ থেকে সাড়ে ৩শ’ রোগীকে। বাকি রোগীরা বাধ্য হয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও তাদের দালালদের মাধ্যমে বাইরের প্রাইভেট প্যাথলজি, ল্যাব কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে ইসিজি করায়। ইসিজি করাতে গিয়েও রোগীরা নানা ফাঁদে পড়েন। এভাবে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক মোটা অংকের কমিশন পান। শুধু ইকো, এনজিওগ্রাম কিংবা ইসিজিই নয়, এমন অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষাই রোগীকে বাইরে থেকে করাতে বাধ্য করানো হয়। হাসপাতালে এক্সরে মেশিন বিকল থাকায় বহির্বিভাগের ৫০ থেকে ৬০ জন রোগী প্রতিদিন আশপাশের সেন্টারগুলো থেকে এক্সরে করিয়ে আনেন। এতে করে যেখানে হাসপাতালে ৭০ টাকায় এক্সরে করাতে পারতেন, সেখানে তারা ১৫০-২০০ টাকা বাড়তি ব্যয় করেন। এ খাতে রোগীদের গত ৩ মাসে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯ লাখ টাকা।অনুসন্ধানে জানা গেছে, বহির্বিভাগ কিংবা জরুরি বিভাগে প্রতিদিন ইকো করানো রোগীর সংখ্যা প্রায় ১১০-১২০ জন। এর মধ্যে হাসপাতালের সুবিধা পান ৫৫ থেকে ৬০ জন। বাকি ৫৫ থেকে ৬০ জন রোগী কর্তব্যরত কিছু চিকিৎসক কিংবা দালালদের ফাঁদে পড়ে বাধ্য হয়ে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন প্যাথলজি, ল্যাব কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ইকো করতে যান। এ অনিয়মের কারণে একদিকে সরকার যেমন রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি রোগীকেও গুনতে হচ্ছে ১০ গুণ টাকা। এভাবে ইকো করার খাতেই রোগীদের কাছ থেকে সরকার মাসে অন্তত ৩ লাখ টাকা হারে বছরে ৩৬ লাখ টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। আর বাইরে থেকে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ইকো করাতে রোগীদের মাসে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৬ লাখ টাকা। অন্যদিকে এনজিওগ্রাম করতেও রোগীদের বাড়তি টাকা গুনতে হয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে, সরকারি কার্যদিবসে প্রতিদিন গড়ে ৫৫ থেকে ৬০ জন রোগীকে ইকো করানো হয় হাসপাতালে। এনজিওগ্রাম করে ২৫ থেকে ৩০ জন রোগী এবং ইসিজি করানো হয় প্রায় ৩৫০ জন রোগীকে। এসব খাত থেকে প্রতিদিন সরকারি রাজস্ব আয় আসে লক্ষাধিক টাকা। হাসপাতালে ইকো করাতে সরকারি ফি মাত্র ২০০ টাকা। কিন্তু অন্তত অর্ধেক রোগী স্বল্পমূল্যে সরকারি এ হাসপাতালে ইকো করার সুবিধা না পেয়ে বাধ্য হয়ে বাইরের বিভিন্ন প্যাথলজি, ল্যাব কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায় ইকো করান। অপরদিকে এনজিওগ্রাম করাতে হাসপাতালে সরকারি ফি ২০০০ টাকা, সিটি এনজিওগ্রাম করাতে ৩০০০ টাকা লাগে। এনজিওগ্রামের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ হাসপাতাল থেকেই দেয়ার কথা। কিন্তু রোগীকে পুরো ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। এছাড়া এনজিওগ্রাম করতে প্রাইভেট ক্লিনিকে খরচ হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। মুমূর্ষু রোগীর স্বজনরা এ টাকা জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খান। অনেকে ধারদেনা করেও এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার টাকা জোগাড় করতে বাধ্য হন।হার্টের গুরুতর রোগীদের জন্য সরকারিভাবে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা দিতে একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় হƒদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল এখন রয়েছে কর্মচারী ও দালাল চক্রের নিয়ন্ত্রণে। তারা যেভাবে চাইবে সেভাবেই রোগীদের সেবা পাওয়া যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসক, কর্মচারী ও দালালদের সমন্বয়ে এখানে তৈরি হয়েছে একাধিক সিন্ডিকেট। হাসপাতালে ওষুধ-পথ্যসহ অপারেশন সামগ্রীর কৃত্রিম সংকট এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে করে রোগীরা চিকিৎসক, কর্মচারী ও দালালদের মাধ্যমে হাসপাতালের আশপাশে তাদেরই নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়। হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা রোগীর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পছন্দের প্যাথলজি কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। রোগীর জন্য বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের নিয়ম থাকলেও নামমাত্র ২/১টি ট্যাবলেট ছাড়া তেমন কোন ওষুধ দেয়া হয় না তাদের। হাসপাতালের নানা অভিযোগ ও অনিয়ম সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ১১ থেকে ২০ এপ্রিল সরকারি কার্যদিবস এবং ছুটির দিনেও বিভিন্ন সময় হাসপাতালে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বহু অনিয়মের হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, রোগীদের একটি সিরিঞ্জ পর্যন্ত বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে হচ্ছে। অপারেশন কিংবা এনজিওগ্রাম করতে প্রয়োজনীয় ওষুধও হাসপাতাল থেকে দেয়া হচ্ছে না। বিনামূল্যের শয্যা বেচাকেনা এখানে ওপেন সিক্রেট। হাসপাতালে রোগী দেখতে গেলেও প্রতি গেটে জনপ্রতি দিতে হয় ১০ থেকে ২০ টাকা। টাকা ছাড়া কোন কাজই হয় না। অনুসন্ধানে জানা যায়, এ হাসপাতালের রোগীদের জন্য ২০১০-১১ অর্থবছরে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকার ওষুধ এবং ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার সার্জিক্যাল আইটেমসহ মোট ৪ কোটি টাকার সরকারি অর্থ বরাদ্দ থাকলেও তার বড় অংশ লোপাট করা হয়েছে। বরাদ্দকৃত এ অর্থের ওষুধ কিংবা সার্জিক্যাল আইটেম রোগীদের ভাগ্যে তেমন জোটে না। তাদের একটি সিরিঞ্জ থেকে শুরু করে সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ ভাগ ওষুধ হাসপাতালের বাইরে থেকে কিনতে হয়। তাদের জন্য বরাদ্দ ওষুধ তাহলে কোথায় যায়? এ নিয়ে খোঁজ-খবর করে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এমনও তথ্য বেরিয়ে এসেছে যাতে দেখা যায়, অত্যন্ত কৌশলে গত ৩ মাস ধরে বহির্বিভাগ রোগীদের এক্সরে মেশিন অকেজো করে রাখা হয়েছে। যাতে করে রোগীরা বাধ্য হয়ে পার্শ্ববর্তী ক্লিনিকগুলোতে এক্সরে করতে যান।
সুত্র : যুগান্তর