একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং নবজাতক এ শিশুটিকে পৃথিবীর নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আরও বেশি যত্নশীল ও দায়িত্ববান হতে হয়। মানব সন্তানের জন্য গর্ভকালীন সময় হলো ৪০ সপ্তাহ। এ সুদীর্ঘ সময় প্রথমে ভ্রূণ ও পরবর্তী সময়ে পরিপূর্ণ আকৃতি নিয়ে শিশুটি বৃদ্ধি পেতে থাকে। মায়ের গর্ভে আলো, বাতাস, উষ্ণতা সবই সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট।
তাই হঠাত্ করে যখন শিশুটি বাইরের পরিবেশে চলে আসে তখন শিশুর ঘুম, খাওয়া-দাওয়া, সুবিধা-অসুবিধা সব কিছুর দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হয়। জন্মের পর একটি নবজাতক শিশুর ঘুম কেমন হতে পারে, কতক্ষণ ঘুমাতে পারে, ঘুমানোর সময় আমাদের করণীয় কী ইত্যাদি নানা বিষয় সম্পর্কে আমাদের তেমন কোনো জ্ঞান নেই। আর সেই কারণে শিশুর মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় আমাদের অজান্তেই।
নবজাতক শিশু যতক্ষণ ঘুমাতে পারে :
দিন-রাত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটি শিশু সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা ঘুমাতে পারে, এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তবে সচরাচর ১৬ ঘণ্টা ঘুমকেই একটি নবজাতক শিশুর আদর্শ ঘুম হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে নবজাতক শিশু একনাগাড়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকতে পারে। পরে ১-২ ঘণ্টা বিরতি দিয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই চলতে থাকে একটি নবজাতক শিশুর ঘুম।
নবজাতক শিশু যেভাবে ঘুমায় :
আমরা বড়রা যেমন বিভিন্নভাবে ঘুমাই, শিশুরাও ঠিক তেমনি নানাভাবে ঘুমায়। একটি নবজাতক শিশু ঘুমানোর সময় হালকা নাক ডাকার মতো শব্দ করতে পারে, চোখের পাতা অল্প অল্প নড়তে পারে। হালকা, গভীর কিংবা অত্যধিক গভীর ঘুম হতে পারে। শিশু যত বড় হতে থাকবে ঘুমের পরিমাণ তত কমতে থাকবে, আর জেগে থাকার পরিমাণ বাড়তে থাকবে।
রাতের ঘুম কেমন হতে পারে :
জন্মের পর কোনো শিশু রাতে বেশি ঘুমায়, আবার কোনো শিশু দিনে বেশি ঘুমায়। আবার কোনো কোনো শিশু রাতে একদম ঘুমাতে চায় না। এসবই সাময়িক, কিছুদিন পর থেকেই শিশুর ঘুমের এই নিয়মকানুন বদলে যাবে, অযথা দুশ্চিন্তা করবেন না। রাতে শিশু না ঘুমালে অধৈর্য হবেন না, পালাক্রমে শিশুকে সঙ্গ দেয়ার চেষ্টা করুন। তবে কোনোভাবেই শিশুকে বিছানা থেকে উঠিয়ে নিয়ে হাঁটাহাঁটি কিংবা অন্য ঘরে নিয়ে যাবেন না। এতে শিশুর রাতের ঘুমের প্রবণতা কমে যাবে। শিশুকে বুঝতে দিন এখন ঘুমের সময়। প্রয়োজনে ঘরে হালকা আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিশুর মনে প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। প্রথম কয়েকদিন না ঘুমালে পরে সে নিজেই বুঝবে এখন ঘুমাতে হবে। সাধারণত দুই মাসের শিশু রাতে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকে। যদি কোনো শিশু রাতে না ঘুমায়, আর যদি এই না ঘুমানো চার মাস অতিক্রম করে, তবে শিশু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। কিছু শিশু আছে জন্মের ছয় সপ্তাহ রাতে একটানা ঘুমিয়ে থাকে। আবার কোনো শিশু রাতে দু-তিনবার জেগে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এ ধরনের শিশুদের ১২ মাস পর্যন্ত রাতে জেগে ওঠার অভ্যাসটা থেকে যায়। পরে ধীরে ধীরে তা ঠিক হয়ে যায়। তিন মাসের শিশু যার ওজন অন্তত ১২ পাউন্ড সেই শিশুর ঘুম দীর্ঘক্ষণ ও গভীর হবে। তবে যেসব শিশু বুকের দুধ খাবে তাদের জেগে ওঠার পরিমাণ বোতলে দুধ খাওয়া শিশুর থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি হবে। তবে দুধ খাওয়ামাত্রই অথবা দুধ খেতে খেতেই যেসব শিশু ঘুমিয়ে পড়ে তারা খুব কম বিরক্ত করে, কান্নাকাটিও কম করে।
শিশুর ঘুমের পরিবর্তন :
সাধারণত ১২ সপ্তাহ কিংবা তিন মাস পর থেকে শিশুর ঘুমের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করবে। শিশুর নির্দিষ্ট ঘুমের রুটিন আপনি লক্ষ্য করতে পারবেন না। তিন মাস পর থেকে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি খুব দ্রুত হতে থাকে। তাই ঘুম ও খাওয়ায় সামঞ্জস্য থাকতে হবে।
রাতে না ঘুমালে শিশুর কি সমস্যা হতে পারে?
রাতে ঘুমানো আমাদের স্বাভাবিক ধর্ম। রাতে না ঘুমানো একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার। শিশুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। শিশুকে রাতে ঘুমাতে হবে। কম করে হলেও রাতে ঘুমাতেই হবে। তা না হলে শিশুর মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। লক্ষ্য করুন, রাতে একটি শিশু না ঘুমালে মা কিংবা বাবা অথবা ঘনিষ্ঠ কোনো একজন শিশুর সঙ্গে জেগে থাকে, আর সবাই ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু শিশু দিনে একসঙ্গে সবাইকে পায়। মা-বাবা, ভাইবোন এবং পরিবারের অন্য সবার কথাবার্তা, চলাফেরা লক্ষ্য করতে পারে। ফলে শিশুর মানসিক পরিবর্তন ঘটতে পারে খুব অনায়াসে। কিন্তু রাতে না ঘুমালে শিশু দিনে বেশি ঘুমাবে। গভীর ঘুম দেবে, ফলে সে এসব কিছু থেকে বঞ্চিত হবে।
রাতের ঘুমে কীভাবে অভ্যস্ত করবেন?
একটি শিশু তার মাকে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করে। পাশাপাশি বাবাকেও কমবেশি লক্ষ্য করে থাকে। তাই রাত যে ঘুমের সময়, শিশুকে তা বোঝাতে হবে। প্রতিদিন রাতে নির্দিষ্ট সময়ে মা-বাবা দু’জনই পোশাক পরিবর্তন করুন। নাইট ড্রেস ব্যবহার করুন, ধীরে ধীরে কথাবার্তা বলুন, আলো কমিয়ে দিন, শিশু কান্নাকাটি না করে শুয়ে খেলতে থাকলে নিজেরা কথাবার্তা বলবেন না। এমনকি ঘুমের অভিনয় করবেন, দেখবেন শিশু খেলতে খেলতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছে। এটি একদিনেই কাজ করবে না, এক মাস এভাবে ধৈর্যের সঙ্গে করুন, দেখবেন শিশুর অভ্যাস হয়ে যাবে, যা পরবর্তী সময়ে আপনাদের জন্য আনন্দের বিষয় হবে।
একটি শিশুর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য মা-বাবা দু’জনকেই শ্রম দিতে হবে, ধৈর্যশীল হতে হবে। যে শিশুর ঘুম সঠিকভাবে, সঠিক নিয়মে চলবে সেই শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ততই দ্রুত ও ভালো হবে। তাই জন্মের পর তিন মাস ঘুম পর্যবেক্ষণ করুন। এরপর কোনো অসামঞ্জস্যতা দেখা দিলে অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
ডা. আওরঙ্গজেব আরু
প্রোগ্রাম অফিসার, এমপিএইচ, ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথ
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ