নিউমোনিয়া শিশুদের জন্য একটি প্রাণঘাতী রোগ। বিশেষ করে শীতে নিউমোনিয়ার প্রকোপ মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। শীতের ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্ট একটি সাধারণ অসুখ। সচেতন না হলে সাধারণ সর্দিজ্বর, ঠাণ্ডা-কাশি অবশেষে রূপ নেয় প্রাণঘাতী নিউমোনিয়ায়। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এরই মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে অনেক শিশু এবং তার মধ্যে মারাও গেছে বেশ কয়েকজন।
নিউমোনিয়া কী?
নিউমোনিয়া শ্বাসতন্ত্রজনিত অর্থাত্ ফুসফুসের প্রদাহ সংক্রান্ত একটি মারাত্মক রোগ।
কী কারণে নিউমোনিয়া হয়?
সাধারণত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস কিংবা ফাঙ্গাসের কারণে নিউমোনিয়া নয়। যখন ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাস ফুসফুসে ঢোকে এবং জীবাণু ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে ফুসফুসকে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করে ফেলে তখনই নিউমোনিয়া দেখা দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ব্যাকটিয়ার নাম হচ্ছে নিউমোকক্কাস।
নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো
● হঠাত্ জ্বর কয়েক ঘণ্টার জন্য হবে এবং তার সঙ্গে বমি ও খিঁচুনি হবে।
● শ্বাস গ্রহণের সময় বুক ভেতরের দিকে চেপে গেলে তাকে মারাত্মক নিউমোনিয়া ও বুক ভেতরে না চেপে গেলে তাকে সাধারণ নিউমোনিয়ার লক্ষণ ধরে নিতে হবে।
● শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত চলবে। এটি প্রতি মিনিটে ৫০ থেকে ৬০ বার হতে পারে।
● ০-২ মাস বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাস ৬০ বার বা আরও বেশি হতে পারে।
● ২ মাস থেকে ১ বছর অর্থাত্ ১২ মাস বয়সের শিশুর ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাস মিনিটে ৫০ বার বা তারও বেশি হতে পারে।
● ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাস মিনিটে ৪০ বার বা তারও বেশি হতে পারে।
● নাড়ি দ্রুতগতিতে চলবে।
● শিশু খাওয়া কমিয়ে দেবে কিংবা একেবারেই খাবে না।
● নাকের দু’পাশের চামড়া শ্বাস নেয়ার সময় চেপে যাবে।
● শ্বাস নেয়ার সময় সাই সাই শব্দ হবে।
● হঠাত্ দেহের তাপ বাড়বে অথবা কমে যাবে।
● দেহের রঙ ধূসর হয়ে যাবে।
● কাশি হবে, তার সঙ্গে মাথাব্যথা ও হাতে-পায়ে ব্যথা অনুভব হবে।
● দেহের চামড়া শুষ্ক হয়ে যাবে।
চিকিত্সা
● মারাত্মক নিউমোনিয়া বুঝতে পারলে দেরি না করে দ্রুত শিশুকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
● নিউমোনিয়া লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্র প্রথম অবস্থাতে স্বাস্থ্যকর্মী কিংবা ডাক্তারের কাছে প্রয়োজনীয় চিকিত্সা নিতে হবে।
● প্রয়োজনে দ্রুত কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস অর্থাত্ অক্সিজেন দিতে হবে।
● প্রয়োজনে ইনকিউবেশন কেয়ারে রাখতে হবে।
● প্রয়োজনে ওরো ফ্যারিনজিয়াল সাকশন দেয়া যেতে পারে।
● অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে ইনজেকশন দিতে হবে।
● দুধ খাওয়া শিশুর ক্ষেত্রে কোট্রাইমোক্রাজল ট্যাবলেট গুঁড়ো করে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে দু’বারের ডোজ হিসেবে ৫ দিন খাওয়াতে হবে।
● জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল সিরাপ বা ট্যাবলেটও খাওয়াতে হবে।
প্রতি বছর নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার
সেভ দ্য চিলড্রেনের এক জরিপে পাওয়া গেছে, বিশ্বের ২ মিলিয়নেরও বেশি শিশু প্রতি বছর নিউমোনিয়ায় মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি শিশু মারা যায় দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকায়। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে ম্যালেরিয়া, হাম কিংবা এইডস দ্বারা সম্মিলিতভাবে শিশুমৃত্যুর হার থেকেও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুমৃত্যুর হার বেশি। প্রতি বছর বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়।
নিউমোনিয়ায় এত শিশু কেন মারা যায়?
নিউমোনিয়া চিকিত্সার প্রধান বিষয়টিই হচ্ছে দ্রুত চিকিত্সা গ্রহণ। হতে পারে সেটা স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তার কিংবা নিকটস্থ হাসপাতাল। মূলত দ্রুত চিকিত্সার অভাবের কারণেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু মারা যায়। আমাদের অসর্তকতা ও অসচেতনতা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশই বাড়িয়ে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে কিছু শিশু চিকিত্সার অভাবে বাসাতেই মারা যায়, আর কিছু শিশু দেরিতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কারণে মারা যায়। আবার অনেক সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা শিশুরা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে খুব দ্রুতই মারা যেতে পারে। সঠিক সময়ে চিকিত্সা করালে নিউমোনিয়ায় এত শিশু মারা যাবে না, মৃত্যুর হার কমে যাবে।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধের উপায়
কিছু নিয়ম মেনে চললে নিউমোনিয়া খুব সহজেই প্রতিরোধ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে জন্মের পর থেকে শিশুকে ৬ মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, মায়ের বুকের শালদুধই হচ্ছে শিশুর প্রথম ও প্রধান টিকা। মায়ের দুধ শিশুর পুষ্টি বাড়ায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফলে সর্দি কাশি শিশুকে সহজে আক্রান্ত করতে পারে না এবং নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা সহজ হয়। জরিপে জানা গেছে, যেসব শিশু মায়ের দুধ খায় তাদের থেকে বোতলে দুধ খাওয়া শিশুর নিউমোনিয়ার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি। এক কথায় ৬ মাস পর্যন্ত শিশুকে শুধু মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। এ সময় পানি খাওয়ানোরও প্রয়োজন নেই। তবে ৬ মাস বয়সের পর থেকে পুষ্টির জন্য শিশুকে মায়ের দুধের পাশাপাশি উপযুক্ত বাড়তি খাবার দিতে হবে। বাড়তি খাবার হিসেবে গাঢ় রঙের সবুজ, শাকসবজি ও হলুদ সবজি দিয়ে তৈরি খিচুড়ি খাওয়াতে হবে। ভিটামিন-এ মায়ের দুধে পাওয়া যায়, পাশাপাশি শিশুকে ভিটামিন এ-যুক্ত শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়াতে হবে। শিশুকে সময়মত সব টিকা দিতে হবে। টিকা দেয়া হলে শ্বাসতন্ত্রের রোগ থেকে শিশুকে অনেকটাই নিরাপদ রাখা সম্ভব। এছাড়া শিশুকে সব সময় পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে রাখতে হবে, স্যাঁতসেতে পরিবেশে রাখা যাবে না। ধুলাবালি ও ধোঁয়াযুক্ত পরিবেশ শিশুকে খুব সহজে সর্দিকাশি কিংবা নিউমোনিয়ার মতো প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত করতে পারে। শিশুদের ঘরে আলো-বাতাসের ভালো ব্যবস্থা রাখতে হবে। শীতের সময় শিশুর দিকে বাড়তি খেয়াল দিতে হবে, যত্ন নিতে হবে, সর্দিকাশি হলে অবহেলা করা যাবে না।
বর্তমানে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবসও পালিত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে শতাধিক প্রতিষ্ঠান নিউমোনিয়া প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছে, নিশ্চিত করতে চাচ্ছে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল-৪, যাতে ২০১৫ সালের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার দুই-তৃতীয়াংশে কমে আসে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু মৃত্যুর হার অনেক বেশি। সেই কারণে আমাদের বেশি সচেতন হতে হবে। শুধু সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করলেই হবে না। সেই সঙ্গে সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে নিউমোনিয়ার ব্যাপারে জানতে হবে। তাহলেই শীতের সময় পত্রিকার শিরোনাম হবে না নিউমোনিয়ার প্রকোপ এবারও বেশি, বেড়ে গেছে শিশুমৃত্যুর হার।