‘আমরা গাঁও গেরামের মানুষ, অসুখের অতশত বুঝি না। জ্বর, প্যাডের (পেট) অসুখ-কিছু অইলেই যাই বাড়ির কাছের হাসপাতালে। হেইনো (সেখানে) ওষুধ-বড়ি মাগনা (বিনামূল্যে) পাই। অহন আর ট্যাহা (টাকা) দিয়া ওষুধ কিনন লাগে না।’ সরকার স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেওয়া স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এভাবেই সন্তুষ্টির কথা বলছিলেন হাওর অধ্যুষিত নেত্রকোণা জেলার বারহাট্টার পাইকপাড়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব আশরাফুন্নেসা। বাসস।
শুধু আশরাফুন্নেসাই নন, ‘পাইকপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে’র স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বেজায় খুশি এই গ্রামসহ স্থানীয় রায়পুর ইউনিয়নের কয়েক গ্রামের মানুষ।
উপকারভোগী এসব মানুষের ভাষ্য, গ্রামাঞ্চলে আগে হাসপাতাল তো দূরের কথা, ভালো ওষুধের দোকানও পাওয়া যেত না। কিন্তু সরকারের এ উদ্যোগ ‘গরিবের হাসপাতালে’ পরিণত হয়েছে। এখন ঘরের কাছে বিনামূল্যে ডাক্তারি পরামর্শ এবং ওষুধও বিনামূল্যে ওষুধও পাওয়া যাচ্ছে। আর এতেই স্বস্তি মিলেছে গ্রামীণ মানুষের জীবনে।
ক্লিনিকে ছয়মাস বয়সী নাতিকে নিয়ে এসেছেন স্থানীয় কর্ণপুর গ্রামের হাফিজুর রহমানের স্ত্রী শর্মিলা রহমান। পেশায় স্কুল শিক্ষিকা শর্মিলা জানালেন, দুদিন ধরে নাতির সর্দি-জ্বর। তাই ক্লিনিকে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন।
তিনি বলেন, আমার নাতির জন্মের আগে থেকে তার মা-ও এখানে এসে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়েছে। জন্মের পরও যেকোনো সমস্যায় ঘরের কাছের হাসপাতালে আসি। সাধারণ অসুখের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শের পাশাপাশি এখানে ওষুধও পাচ্ছি।
‘এইখানের ডাক্তার ও নার্সরা (কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার) বেশ ভালো। তারা রোগীদের অসুখের খোঁজ-খবর নিয়ে ওষুধ দেন। ওষুধ কিনতেও টাকা লাগে না। এই হাসপাতাল হওনের (হওয়া) আগে আমরার নেত্রকোণা সদর হাসপাতাল নইলে বেসরকারি ক্লিনিকে যাওয়া লাগতো। এতে টাকা ও সময়ও লাগতো বেশি। কিন্তু তা লাগে না,’ বলেন শর্মিলা।
তার সঙ্গে যোগ করে এ সময় সেখানে থাকা আছাব আলী এই প্রতিবেদককে বলেন, গত কয়েকদিন ধরে হাঁপানি ও শ্বাস কষ্টে ভুগছি। তাই, ওষুধ নিতে এসেছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। এরপর ২০০০ সালের এপ্রিলে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া পাটগাঁতী ইউনিয়নের ঘিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তা বাতিল করে দেয়। এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পনায় প্রকল্পটি আবারও চালু হয়। যার সুফল ভোগ করছেন গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ।
‘শেখ হাসিনার অবদান, কমিউনিটি ক্লিনিক বাঁচায় প্রাণ’ স্লোগানে পরিচালিত এসব ক্লিনিকের মাধ্যমে তাদের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে ৩২ রকমের ওষুধ। আর গর্ভবতী নারীদের জন্য স্বাস্থ্য পরামর্শ ছাড়াও পরিবার-পরিকল্পনা এবং পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শ তো থাকছেই। কোনো কোনো ক্লিনিকে প্রসবও করানোর ব্যবস্থাও রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ১৩ হাজার ৮৬১টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। ২০০৯ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার প্রকল্প শেষ হয় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। এ পর্যন্ত ৬২ কোটি ৫৭ লাখ মানুষ সেবা নিয়েছেন।
গ্রামীণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরি সহজলভ্য করতে সরকারের আরও ১ হাজার ২৯টি ক্লিনিক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
রায়পুর ইউনিয়নের পাইকপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার মোফাজ্জল হোসাইন এই প্রতিবেদককে বলেন, এই ক্লিনিকের মাধ্যমে স্থানীয় ৭-৮টি গ্রামের মানুষকে ভালভাবে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। এখান থেকে সর্দি-কাশি, জ্বরসহ সাধারণ রোগের ৩২ রকম ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
তিনি জানান, সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ক্লিনিক খোলা থাকে। প্রথমে লোকজন কম এলেও এখনও দিনে গড়ে ৭০-৮০ জন মানুষ পরামর্শ নিতে আসেন।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত কমিউনিটি বেজড হেলথ সেন্টারের (সিবিএইচসি) মাস্টার ট্রেনার ডা. ইয়াসিন আলী বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এসব ক্লিনিকে প্রতিনিয়ত মানুষ সেবা নেন। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ভুকতেরা কমিউনিটি ক্লিনিকে এই পর্যন্ত দুই শতাধিক প্রসব হয়েছে। যা একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
কমিউনিটি ক্লিনিকে পাওয়া সেবায় মানুষের সন্তুষ্টির কথা তুলে ধরে সিবিএইচসির লাইন ডিরেক্টর ডা. আবুল হাসেম খান বলেন, হাতের কাছে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ পেয়ে সবাই খুশি। বর্তমানে ক্লিনিকগুলোতে মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। ফলে মানুষের আস্থাও বেড়েছে।
সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আমাদের যে অর্জনগুলোকে বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে-এর মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক একটি। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তার ফল।
ভবিষ্যতে যাতে এ সেবা কার্যক্রম সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া যায় সেজন্য আরও ১ হাজার ২৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ আরও বাড়বে বলেও মনে করেন তিনি।