সারা মুসলিম বিশ্বের জন্য রমজান একটি বিশেষ মাস। এ মাসে সিয়াম সাধনায় মুসলমানরা ধৈর্য ও সংযমের এক অপূর্ব সমন্বয় সাধন করেন। কাজকর্ম, চলাফেরা, খাদ্যাভ্যাস_ সব কিছুকেই পরিবর্তন করতে হয়। সেহরি ও ইফতার এই দুটি বিশেষ সময় যোগ হয় আমাদের জীবনযাত্রায়। দিনে না খাওয়ার কারণে সন্ধ্যায় ইফতারিতে একটু বেশিই ভোজনরসিক হয়ে উঠি আমরা। আর তার খেসারতও দিতে হয় সেহরি কিংবা পরের দিনের রোজায়।
গ্যাস্ট্রিক, আলসার, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপসহ যে কোনো অবস্থাতেই রোজা রাখা সম্ভব। শুধু প্রয়োজন খাদ্যগ্রহণে সতর্কতা, আর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ। মনে রাখতে হবে, রোজায়ও কিন্তু আমরা তিন বেলাই খাচ্ছি, শুধু সময়টা ভিন্ন। রোজার মাসে আমাদের খাদ্য তালিকায় যোগ হয় ভাজাপোড়া, মিষ্টান্ন, গরুর গোশত, মুরগি ইত্যাদি। বুট-পিঁয়াজু না হলে যেন ইফতারই করা কঠিন। অনেকের ধারণাটাই এমন। অথচ এসব তেলে ভাজা-ঝাল, অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাবার শুধু রোজা নয়, অন্য যে কোনো মাসেও নিয়মিত প্রতিদিন খেলে অসুস্থ হয়ে পড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা মুখরোচক এসব খাবার ঠিকই খাবো কিন্তু পরিমিতভাবে। যারা ক্যালরি মেপে খাবার খান, তাদের জন্য এ কাজটা অনেক সহজ, ইচ্ছে হয়তো করবে ৪টি পিঁয়াজু খেতে। কিন্তুু যদি জানা থাকে এতে কত ক্যালরি বেড়ে যাবে, তাহলে আমরা ঠিকই ১টা কিংবা ২টা পিঁয়াজু খাবো।
রমজানে সুনির্দিষ্ট সময় ও পরিমিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে সাধারণ কয়েকটি রোগের জটিলতা একটু বেড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাসে ও ওষুধ সেবনে কয়েকটি নিয়ম মেনে চললে তেমন কোনো অসুবিধাই হয় না।
কোষ্ঠকাঠিন্য
অতিরিক্ত ভাজা-পোড়া, অাঁশযুক্ত খাবারের স্বল্পতা ও পানি কম খাওয়ার কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। ফলে পাইলস ও অ্যানালক্যানালের সমস্যাও বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে যা করণীয়-
ষ অতিরিক্ত ভাজা-পোড়া একদমই খাওয়া যাবে না।
ষ সন্ধ্যারাত কিংবা সেহরিতে অাঁশযুক্ত শাক-সবজি খেতে হবে।
ষ ইফতার ও সন্ধ্যারাতের মধ্যবর্তী সময়ে যতটুকু সম্ভব বেশি পরিমাণে পানি খেতে হবে।
ষ ইফতারে পানি কম খেয়ে ফলের রস বেশি খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
নিম্ন রক্তচাপ
পুষ্টিকর খাবারের অভাব ও পানিস্বল্পতার কারণে যেকোনো সময়ই নিম্ন রক্তচাপ বা লো-বস্নাড প্রেসার দেখা দিতে পারে। আর রমজানে মুখরোচক খাবার ও কোল্ড ড্রিংকস আমরা বেশি পরিমাণে খাই। কিন্তু তাতে এনার্জি কিংবা শক্তি একদমই থাকে না। ফলে শরীরে দ্রুত ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত অত্যধিক দুর্বল হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে যা করণীয়_
ষ ইফতারের আগে হঠাৎ করে বস্নাডপ্রেসার কমে যেতে পারে, অস্থির না হয়ে বিশ্রাম নিতে হবে।
ষ ইফতারে হঠাৎ করে একসঙ্গে বেশি পরিমাণে পানি খাবেন না।
ষ ইফতারে পানি ও ফলের রস খেতে হবে।
ষ বমি বমি ভাবের সমস্যা না থাকলে ইফতারে খাবার স্যালাইন খেতে পারেন। এতে দ্রুত উপকার পাওয়া যাবে।
ষ নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা থাকলে প্রতি রোজায় ইফতার সেহরির যে কোনো সময় একটি, সম্ভব হলে দুটি খাবার স্যালাইন খেতে হবে।
গ্যাস্ট্রাইটিস
রমজানে দিনে দীর্ঘক্ষণ পেট খালি থাকার কারণে এসিড লেভেল বেড়ে যায়। ফলে পাকস্থলীতে অর্থাৎ পেটের ভেতর, জ্বালা-পোড়া বেড়ে যায়। তার ওপর ইফতারে অতিরিক্ত তেলে ভাজা- পোড়া, কোল্ড ড্রিংকস খাওয়ার কারণে এই জ্বালা-পোড়া মারাত্মক আকার ধারণ করে। এ ক্ষেত্রে যা করণীয়-
ষ অতিরিক্ত ঝাল, মসলাযুক্ত তেলে-ভাজা পোড়া খাবার খাওয়া যাবে না।
ষ রোজার সময় কোল্ড ড্রিংকস পরিহার করতে হবে।
ষ পেপটিক আলসারের রোগীর রোজার সময় ডাক্তারের পরামর্শমতো নিয়মিত ওষুধ খাওয়া উচিত।
ষ গ্যাস্ট্রিকের অল্প-বেশি যে কোনো সমস্যায় ইফতার ও সেহরিতে এন্টাসিড জাতীয় ওষুধ বা লিকুইড খেলে উপকার পাওয়া যায়।
কিডনি স্টোন
রমজানে পানিস্বল্পতার কারণে কিডনির নানা জটিলতা বেড়ে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে পানি অতিরিক্ত কম খাওয়ার কারণে কিডনিতে স্টোন বা পাথর তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে যা করণীয়-
ষ ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত এই সময়ে অন্তত ৮ গ্লাস পানি খেতে হবে।
ষ পানি বেশি খেলে পাথর তৈরির খনিজ উপাদানগুলোর ঘনত্ব হ্রাস পায়।
ষ লবণযুক্ত খাবার কম খেতে হবে। কারণ লবণ বা সোডিয়াম ইউরিনে ক্যালসিয়াম পাথর জমার আশঙ্কা হ্রাস করে।
ষ কিডনিতে পাথর সমস্যা থাকলে শর্করা ও প্রাণিজ আমিষ, বিশেষ করে ডিম ও মাছের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
ষ কিডনি সমস্যার জটিলতা যেকোনো সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে, তাই রমজানে অবশ্যই ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করে নেয়া ভালো।
ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস রোগের কারণে অনেকেই রোজা রাখাটা কঠিন মনে করেন। আসলে এটা ঠিক নয়। সারা বছর ডায়াবেটিক রোগীকে যেমন নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয় তেমনি রমজান মাসও এর ব্যতিক্রম নয়। এ ক্ষেত্রে যা করণীয়-
ষ ডাক্তারের পরামর্শমতো ক্যালরি মেপে খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
ষ রোজার সময় আমরা খেজুর বেশি খেয়ে থাকি। কিন্তু খেজুরে ক্যালরি বেশি থাকে। তাই একটি খেজুর কিংবা একদিন পর পর খেজুর খেতে চেষ্টা করুন।
ষ ইফতারের সময় পেট ভরে খাওয়া যাবে না এবং সেহরির খাবার যতটা সম্ভব দেরি করে খেতে হবে।
ষ শরবতে চিনির পরিবর্তে সুকরোল জাতীয় উপাদান ব্যবহার করা উত্তম।
ষ অতিরিক্ত মসলা, তেলে ভাজা-পোড়া খাবার না খাওয়াই ভালো।