প্রফেসর ডা. এনএ কামরুল আহসান
আরমানহার্টের প্রধান রক্তবাহী ধমনি অ্যাওর্টা। এই অ্যাওর্টার একটি শাখা করোনারি আর্টারি, যা হৃৎপিণ্ডকে রক্ত সরবরাহ করে। কোনো কারণে যদি করোনারি আর্টারি বা এর কোনো শাখা ব্লক হয়ে যায় তখন হার্টের কিছু অংশে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় বা কমে যায়। তখন অক্সিজেনের অভাবে ওই কোষগুলো মরে যায়। এতে বুকে ব্যথাসহ আরো কিছু উপসর্গ দেখা দেয়, যাকে বলে হার্ট অ্যাটাক।
যেভাবে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়
কোনো আর্টারিতে রক্ত সরবরাহ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ অ্যাথেরোসক্লোরোসিস। এতে ধমনির দেয়াল চর্বি বা কোলেস্টেরল জমে মোটা হয়ে যায় এবং ধমনির স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়। যে স্থানে চর্বি জমে থাকে, তাকে বলে অ্যাথেরোমেটাস প্লাক বা অ্যাথেরোমা। এই প্লাকের কারণে আর্টারির চ্যানেল বা লুমেন ছোট হয়ে যায় এবং রক্ত প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়।
অনেক ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তার কারণে আর্টারি সরু হয়ে যায় এবং এ অ্যাথেরোমার স্থানে রক্তপ্রবাহ খুব কমে গিয়েও ব্যথা হয়।
কখন হার্ট অ্যাটাক হয়
অ্যাথেরোমেটাস প্লাকের ওপর রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বেশি থাকে। যখন রক্ত জমাট বেঁধে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ধমনিকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় বা জমাট রক্ত সেখান থেকে ছুটে গিয়ে ছোট কোনো ধমনিকে বন্ধ করে দেয়, তখন হার্টের সেই স্থানে রক্ত সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় এবং সেখানকার কোষগুলো মরে যায়। এ অবস্থায়ই আমরা বলি হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন।
হার্ট অ্যাটাকের রিস্ক ফ্যাক্টর
* ডায়াবেটিস
* উচ্চ রক্তচাপ
* ধূমপান
* রক্তে কোলেস্টেরলের (এলডিএল) মাত্রা বেশি থাকা।
এ বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে নিচের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
* বয়স। কারণ, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস তথা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে।
* মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি।
* মা-বাবার হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস থাকলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি থাকে।
আরো কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর
* ওবেসিটি বা অতিরিক্ত ওজন
* শারীরিক পরিশ্রম কম করা
* বেশি পরিমাণ চর্বিযুক্ত খাবার বা শর্করা গ্রহণ করা।
* দুশ্চিন্তা করা।
* অ্যানজাইনা ও অন্যান্য হার্টের অসুখ।
* জন্মবিরতিকরণ পিল।
রোগের লক্ষণ
প্রধান লক্ষণ বুকে ব্যথা। এ ব্যথা তীব্র হতে পারে আবার অনেকের ক্ষেত্রে অল্প ব্যথা শুরু হয়ে তা ধীরে ধীরে বাড়তে পারে। ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে রোগী বুকে চাপ অনুভব করেন এবং মনে হতে পারে যে বুকের খাঁচা ভেতরের দিকে চেপে আসছে। এর সঙ্গে রোগীর বুক ধড়ফড় এবং শ্বাসকষ্ট থাকে। এ ব্যথা বুকের মাঝ বরাবর অনুভূত হয়। একই সঙ্গে রোগী ব্যথা অনুভব করতে পারেন ঘাড়, চিবুক, বাঁ বাহু, বাঁ হাত, অনেক সময় দুই হাত, পিঠ এবং পেটের ওপরের দিকেও। বেশি বয়সী বা যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাঁরা বুকে ব্যথা অনুভব নাও করতে পারেন। তাঁরা বুকে অস্বস্তি অনুভব করেন এবং চেস্ট টাইটনেস থাকে (তাঁরা বলেন, তাঁদের বুকটা যেন ভেতরের দিকে চেপে আসছে)। এর সঙ্গে শ্বাস দ্রুত হতে থাকে বা শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। অনেকে বুকে অস্বস্তির পাশাপাশি পেটে অসুবিধা অনুভব করেন।
ব্যথার পাশাপাশি রোগীর ঘাম হয়। বমি বমি ভাব হয় বা বমি হয়।
যা করণীয়
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
হাইপারটেনশনের রোগী নিয়মিত ব্লাড পেশার মেপে ও ওষুধ খেয়ে তা স্বাভাবিক রাখবেন।
ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে।
নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়।
কম চর্বিযুক্ত খাবার খেতে হবে ও প্রচুর শাকসবজি, ফলমুল খেতে হবে।
যাদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি বা অ্যানজাইনা আছে তাদের মাংস, কলিজা, মগজ, চিংড়ি মাছ, ডিমের কুসুম ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
এ ছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ওষুধ নিয়মিত খাওয়া যেতে পারে, যেগুলো আমাদের রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয় বা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় এবং ডায়াবেটিস ও ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখে।
অ্যানজাইনা পেকটোরিসের রোগীদের নিয়মিত ফলোআপে থাকা উচিত এবং ওষুধ সেবন করা উচিত। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যানজিওপ্লাস্টি (অ্যাথেরোমেটাল প্লাকের স্থানে মেটালিক রিং লাগিয়ে তা ফুলিয়ে দেওয়া হয় এবং রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখা হয়) বা সার্জারি করা যেতে পারে।
মাইনর বা মেজর হার্ট অ্যাটাকের পরও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধপথ্য সেবন ও বিধিনিষেধ মেনে চললে দীর্ঘদিন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব।
প্রফেসর ডা. এনএ কামরুল আহসান
বিভাগীয় প্রধান, কার্ডিয়াক সার্জারী বিভাগ
জাতীয় হৃদরোগ ইনসটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা