Site icon স্বাস্থ্য ডটটিভি

বন্যায় স্বাস্থ্যঝুঁকি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়

দেশে বন্যা প্রায় মহামারি আকার ধারণ করেছে। সর্বত্র দেখা যাচ্ছে বন্যাপীড়িত মানুষের দুর্দশার ছবি। এ সময় পানিবাহিত বিভিন্ন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, বিশেষ করে শিশুরা রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। অনেক জায়গায় বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও একইসঙ্গে বাড়তে শুরু করেছে রোগব্যাধি।

ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, চর্মরোগসহ নানা ধরনের ব্যাধিতে এখন আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। সুষ্ঠু পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার অভাবে এ স্বাস্থ্য সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। হাসপাতালগুলোতে পেটব্যথা, পাতলা পায়খানা, সর্দি-কাশি, মাথাব্যথা ও কাটাছেঁড়ার মতো জটিলতা নিয়ে ভিড় করছেন অনেকে। বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী স্বাস্থ্যসুরক্ষায় যেসব বিষয়ের দিকে নজর রাখতে হবে, তা হলো-

১. বন্যার সঙ্গে সম্পর্কিত স্বাস্থ্যগত প্রভাবগুলো হলো গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল এবং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের রোগ ও মৃত্যুর প্রধান কারণ। স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলোতে প্রবেশের অভাব এবং ভিড় এ সংক্রমণ থেকে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়।

বন্যা সরবরাহব্যবস্থা এবং পানির উৎসগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বর্জ্য-নিষ্কাশনব্যবস্থা ও পয়ঃনিষ্কাশন ছাড়াও তখন প্যাথোজেনগুলোর সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রবণতা থাকে।

২. বন্যার পানিতে প্রায়ই বিষাক্ত পদার্থ থাকে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। এ পানির মধ্যে তেল, ডিজেল বা পেট্রোল, আবর্জনা, মৃত প্রাণী ইত্যাদি থাকতে পারে। জলাবদ্ধ পানি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকের একটি প্রজননক্ষেত্র। এগুলো বায়ুবাহিত হতে পারে এবং এর ফলে ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এমনকি যখন বৃষ্টির পানির মতো মোটামুটি পরিষ্কার উৎসের কারণে বন্যা হয়, তখনও এ অণুজীবের বৃদ্ধি সংবেদনশীল ব্যক্তিদের মধ্যে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। বন্যার পর ভাইরাল সংক্রমণের ঝুঁকি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা এবং বিভিন্ন শ্রেণির সংক্রামক রোগ বন্যা-পরবর্তী প্রাদুর্ভাব ঘটাতে পারে। বন্যা ভাইরাসজনিত রোগের সংক্রমণ বাড়াতে পারে, বিশেষ করে পানিবাহিত সংক্রমণ, যেমন-ডায়রিয়াজনিত রোগ, হেপাটাইটিস-এ ও ই, বায়ুবাহিত ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ।

৩. আশ্রয়কেন্দ্রে ভিড়ের কারণে বন্যার পর শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ (আরটিআই) ঘটে প্রায়ই। দেশে ১৯৮৮ সালের বিধ্বংসী বন্যার পর সব রোগের মধ্যে ১৭.৪ শতাংশ আরটিআই রিপোর্ট করা হয়েছিল এবং এতে মৃত্যুর হার ছিল ১৩ শতাংশ।

বন্যার সময় উচ্চস্তরের আর্দ্রতা এবং আর্দ্র পদার্থযুক্ত অঞ্চলগুলো অণুজীবের বৃদ্ধির জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করে, যার ফলে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়ার মতো অবিরাম বা অতিরিক্ত স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে। এ সময় শ্বাস-প্রশ্বাসের রোগ সৃষ্টিকারী অনেক জীবাণু কাশি ও হাঁচি থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এ জীবাণু সাধারণত এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়ায়, যখন অসংক্রমিত ব্যক্তিরা অসুস্থ ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে থাকে। কোনো ব্যক্তি যদি সংক্রমিত কিছু স্পর্শ করে এবং সেই হাত তাদের নাকে-মুখে লাগলে তিনিও সংক্রমিত হতে পারেন।

৪. বন্যার সময় স্যাঁতসেঁতে ভবন এবং আসবাবপত্র অণুজীব, ধূলিকণা, তেলাপোকা ও ছাঁচের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে, যা হাঁপানি ও অ্যালার্জি বাড়িয়ে তোলে এবং সংবেদনশীল ব্যক্তিদের মধ্যে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, কাশি এবং অতি সংবেদনশীল নিউমোনাইটিসের বিকাশ ঘটাতে পারে। বন্যার সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে জড়িতরা সব ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও টক্সিনের সংস্পর্শে আসতে পারে। তাই সর্বদা যথাযথ প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরার পরামর্শ দেওয়া হয়। বন্যায় ভোগার শারীরিক চাপ এবং পরবর্তী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাও মানুষকে রোগের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

৫. মনে রাখবেন, বন্যায় আক্রান্তের পর আপনার গৃহস্থালির অনেক আইটেম-আসবাবপত্র এবং বিশেষ করে বৈদ্যুতিক সামগ্রী ফেলে দিতে হতে পারে। কারণ সেগুলো আবার ব্যবহার করা খুব বিপজ্জনক (বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র)। এগুলো বন্যার জল থেকে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত হয়। আসবাবপত্র শুকিয়ে যাওয়ার মানে এই নয় যে ব্যাকটেরিয়া চলে গেছে।

এ ছাড়া বন্যার সময় দেওয়া বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রীও রোগ নিয়ে আসতে পারে। একসঙ্গে অনেক মানুষ গাদাগাদি করে থাকার কারণে ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া ও যক্ষ্মার মতো সংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটতে পারে। বন্যার পানি থেকে ছত্রাকের সৃষ্টি হতে পারে, যা পানি কমার অনেক পরেও আপনার শ্বাসযন্ত্রের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে।

বন্যার পর কী করবেন
শুরু থেকেই স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষেত্রে নজর রাখতে হবে। প্রথমে পানির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী শনাক্ত ও রক্ষা করতে হবে এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে। দূষণের মাত্রা চিহ্নিতকরণে সচেষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। ক্ষতিগ্রস্ত সামগ্রী ও আসবাবপত্র শনাক্ত করে এবং ফিরে আসা নিরাপদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো পরিষ্কার করা উচিত। যেখানে পানি স্থির বা স্যাঁতসেঁতে থাকে, সেখানে বিশেষ ছত্রাক বাড়তে পারে। ফুসফুসের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য পানি কমে যাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি এবং গৃহস্থালির জিনিসপত্র পরিষ্কার করা অত্যাবশ্যক। পরিষ্কার করার সময় প্রধান স্থানে বিদ্যুৎ ও গ্যাস বন্ধ করুন। এ ছাড়া পোর্টেবল পেট্রোল বা ডিজেলচালিত জেনারেটর, পাওয়ার ওয়াশার, গ্রিল, ক্যাম্প স্টোভ বা অন্যান্য পেট্রোল, প্রোপেন বা কাঠকয়লা জ্বালানোর সরঞ্জাম এবং ভেতরে থাকা অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহার করবেন না। এগুলো কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন করে, যা বাড়ির ভেতরে তৈরি হলে বাসিন্দাদের মৃত্যু হতে পারে। যে উপকরণগুলো পরিষ্কার করা যায়, তা অবশ্যই পরিষ্কার করতে হবে এবং ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। পরিষ্কার করার জন্য ব্লিচ ব্যবহার করবেন না; সাবান ও পানি কাজ করবে। রোগের উপসর্গগুলোর ওপর নজর রাখুন। দুর্যোগের পর মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়, এমনকি তাদের আগে কখনো সমস্যা না হলেও।

যে কোনো শ্বাসকষ্টের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থাকুন, যার মধ্যে রয়েছে-কাশি, বিশেষ করে রাতে, শ্বাসকষ্ট বা শ্বাসকষ্ট অনুভব করা, বুকে চাপ বা ব্যথা অনুভব করা। সাপ থেকে সাবধান থাকতে হবে। বজ্রপাত হলে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে যেতে হবে। আঙুলের নখ বা ঠোঁট নীল হয়ে গেলে বা তীব্র বুকে ব্যথা হলে অবিলম্বে জরুরি চিকিৎসা সহায়তা নিতে হবে।

ডা. শেখ এএইচএম মেসবাহউল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (রেসপিরেটরি মেডিসিন), সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ

Exit mobile version