র ক্ত না লী তে আ ঘা ত

ডা. আবুল হাসান মুহম্মদ বাশার
দুর্ঘটনা মানুষের যেন নিত্যসঙ্গী। ঘর, কর্মস্থল অথবা রাস্তাঘাট কোথাও দুর্ঘটনামুক্ত নয় । দুর্ঘটনায় আমাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিভিন্নভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। সাধারণত এসব আঘাতের বাহ্যিক দিকটাই আমাদের নজরে আসেÑ যেমন চামড়া অথবা মাংসপেশীর ছিঁড়ে-কেটে, থেঁতলে যাওয়া, হাড় ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি। মনে রাখা প্রয়োজন, অনেক সময় আঘাতের অধিকতর জরুরি দিক থাকেÑ যা তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের নজরে নাও আসতে পারে। যখন নজরে আসে, তখন হয়তো বা খুব বেশি দেরি হয়ে যায়। এধরনের জরুরি একটি বিষয় হল আঘাতের কারণে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ রক্তনালীর ক্ষতি হওয়া।
রক্তনালী : প্রকারভেদ ও বিন্যাস
আমাদের শরীরে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের রক্তনালী জালের মতো ছড়িয়ে আছে। এরা মূলত দু’ ধরনের : ধমনী ও শিরা। ধমনী অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত হƒৎপিণ্ড থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে দেয় (ব্যতিক্রম- ফুসফুসীয় ধমনী) আর শিরা অক্সিজেনবর্জিত রক্ত শরীরের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হƒৎপিণ্ডে ফিরিয়ে আনে (ব্যতিক্রম- ফুসফুসীয় শিরা)। বড় বড় ধমনী শরীরের অপেক্ষাকৃত গভীরে বিন্যস্ত থাকে। পক্ষান্তরে মানবদেহে শিরার বিন্যাস দু’ স্তরে; একটি ত্বকের নিচে ও অপরটি দেহের গভীরে বড় বড় ধমনীর সঙ্গে। যদিও আঘাতের কারণে শরীরের যে কোন অংশের ধমনী বা শিরাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, বাস্তবতার নিরীখে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বড় বড় ধমনীর আঘাত। কেননা দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া না গেলে এসব আঘাত অল্প সময়ের মধ্যে বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। আজকের আলোচনার মূল বিষয়বস্তুও শরীরের গুরুত্বপূর্ণ ধমনী বিশেষ করে হাত ও পায়ের বড় বড় ধমনীর আঘাতজনিত সমস্যা ও সে ব্যাপারে আমাদের
করণীয় নিয়ে।
ধমনীতে আঘাতের রকমফের
দুর্ঘটনায় যখন হাত বা পা আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন চামড়া, হাড়, মাংস, স্নায়ু ইত্যাদির সঙ্গে ওপরে বর্ণিত ধমনীগুলোও আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। আমাদের দেশে এসব আঘাত সংঘটিত হওয়ার প্রক্রিয়াগুলো মোটামুটি এরকম;
ি সড়ক দুর্ঘটনা
ি গাছ বা অন্য কোন উঁচু জায়গা থেকে নিচে পড়ে যাওয়া যা শিশু বা অল্পবয়স্কদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।
ি ভারি যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র নিয়ে কাজ করার সময় দুর্ঘটনা।
ি সহিংসতা।
অবশ্য অপারেশন করাতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত রক্তনালী কেটে ফেলা বা কখনও কখনও ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজের হাত বা পায়ের রক্তনালী কেটে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়।
মারাÍক সড়ক দুর্ঘটনা বা ভারি যন্ত্রপাতির আঘাতে কখনও কখনও ধমনী ছিঁড়ে গিয়ে এর একটা অংশ স্থানচ্যুত হয়। আবার কখনও পুরোপুরি ছিঁড়ে-কেটে না গেলেও ধমনীর দেয়াল থেঁতলে যেতে পারে। তখন ধমনীর ওই অংশের ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। আর এসবের অবশ্যম্ভাবী ফল হলÑ আঘাতপ্রাপ্ত ধমনীর পরবর্তী অংশে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহ বিঘিœত হওয়া।
ধমনীতে আঘাত বোঝার উপায়
ধমনী আঘাতপ্রাপ্ত হলে নিম্নবর্ণিত অবস্থার সৃষ্টি হতে পারেÑ
ি ধমনীর ক্ষতিগ্রস্ত স্থান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে বা আঘাতপ্রাপ্ত অংশের আশপাশে জমাট রক্তের চাকা তৈরি হতে পারে।
ি আঘাতপ্রাপ্ত ধমনীর পরবর্তী অংশে রক্ত সরবরাহ কমে যেতে পারে। ফলে হাত বা পায়ের ওই অংশ ফ্যাকাশে ও ঠাণ্ডা হয়ে আসে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই অংশে তখন নাড়ির উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না বা পাওয়া গেলেও তা স্বাভাবিক নাড়ির মতো জোরালো হয় না।
ি রক্ত সরবরাহ মারাÍকভাবে কমে গেলে আক্রান্ত অংশ ফুলে শক্ত হয়ে যেতে পারে, যাকে কম্পার্টমেন্ট সিনড্রোম বলে। কম্পার্টমেন্ট সিনড্রোমের কারণে আক্রান্ত অংশের ভেতরে চাপ বেড়ে যায়, যার ফলে রক্ত সরবরাহ আরও কমে যায়।
ি একপর্যায়ে অক্সিজেন ও পুষ্টিবঞ্চিত মাংসপেশী ও স্নায়ুর মতো গুরুত্ব¡পূর্ণ জিনিসগুলো মারা যেতে শুরু করে। তখন ওই অংশের অনুভূতি বা নড়াচড়ার ক্ষমতা দ্রুত লোপ পায়। আঘাতের কারণে পায়ের পপলিটিয়াল ধমনীর রক্তপ্রবাহ হঠাৎ বন্ধ হলে এ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় দেখা গেছেÑ এক্ষেত্রে শতকরা ৭৪ ভাগ রোগীর পা অকেজো হয়ে পড়ে এবং তা কেটে বাদ দিতে হয়। ফিমোরাল ধমনীর ক্ষেত্রে এই হার শতকরা ৫২ ভাগ। অবশ্য সব ধমনীর ক্ষেত্রে এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। ছোট ছোট শাখা-প্রশাখা থাকার কারণে মূল ধমনী আঘাতপ্রাপ্ত হলেও অনেক সময় হাত বা পায়ের স্থায়ী ক্ষতি হয় না।
তাৎক্ষণিক করণীয়
ি দুর্ঘটনার কারণে গুরুত্ব¡পূর্ণ ধমনীর ক্ষতি হয়েছে কিনাÑ সাধারণ মানুষের পক্ষে তা বুঝে ওঠা সহজ নয়। এক্ষেত্রে তাই প্রাথমিক চিকিৎসক বা রোগীকে স্থানীয় হাসপাতালে নেয়ার পর যিনি প্রথম রোগী দেখেনÑ তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্ব¡পূর্ণ । হাত বা পায়ের আঘাতপ্রাপ্ত জায়গার পরবর্তী অংশের তাপমাত্রা, চামড়ার রঙ, নাড়ির উপস্থিতি, অনুভূতি বা নড়াচড়ার ক্ষমতাÑ এসব থেকে গুরুত্ব¡পূর্ণ ধমনীর আঘাত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব।
ি যখনই গুরুত্ব¡পূর্ণ ধমনীর ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হবে তখন বিন্দুমাত্র সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত রোগীকে রক্তনালী মেরামতের সুবিধাসম্পন্ন হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সময় এক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। পপলিটিয়াল ধমনীর মতো গুরুত্ব¡পূর্ণ ধমনীর রক্তপ্রবাহ বন্ধ হলে সাধারণত দুর্ঘটনার ৫/৬ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশনের মাধ্যমে ধমনী মেরামত করে রক্ত সরবরাহ পুনরায় চালু করা দরকার। অন্যথায় পা স্থায়ীভাবে অকেজো হয়ে যেতে পারে। অবশ্য রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য রক্তনালীর ওপর পরিষ্কার কাপড় বা গজ দিয়ে চাপ প্রয়োগ করা বা সম্ভব হলে আঘাতপ্রাপ্ত রক্তনালী সাময়িকভাবে বেঁধে দেয়া যেতে পারে। অন্যথায় রক্তক্ষরণে জীবনহানিও হতে পারে। মনে রাখা দরকার, গুরুত্ব¡পূর্ণ ধমনীর আঘাতের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা-পরবর্তী প্রতিটি মুহূর্ত মহামূল্যবান।
ি রোগীকে অন্য হাসপাতালে পাঠানোর সময় পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন যেন আঘাতপ্রাপ্ত অংশ আরও ক্ষতিগ্রস্ত না হয় বা সেখান থেকে নতুন করে রক্তক্ষরণ শুরু না হয়। আবার অনেক সময় রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য হাত বা পা এত শক্ত করে বাঁধা হয়, যার ফলে পরবর্তী অংশে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এটিও কাম্য নয়।
আঘাতপ্রাপ্ত ধমনীর চিকিৎসা
ধমনীর আঘাত নিয়ে আসা রোগীদের ক্ষেত্রে ধমনী মেরামতের অপারেশনে যাওয়ার আগে আঘাত ঠিক কোথায় এবং কতখানি মারাÍকÑ সে সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্য উপরোল্লিখিত পরীক্ষাগুলো ছাড়াও রক্তনালীর ডুপ্লেক্স পরীক্ষার সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এর ফলে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় অপারেশন এড়ানো সম্ভব হয়। আঘাতপ্রাপ্ত ধমনীর পরবর্তী অংশ জীবিত আছে কি নাÑ অপারেশনের আগে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়াও জরুরি। যদিও অনুভূতি ও নাড়ানোর ক্ষমতা থাকলে সাধারণভাবে সে অংশকে জীবিত বলে ধরে নেয়া যায়, তারপরও মাংসপেশীতে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের মাধ্যমে এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। জীবিত ও কর্মক্ষম হাত বা পায়ের ক্ষতিগ্রস্ত ধমনী মেরামতের মাধ্যমে রক্ত সরবরাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়। আবার অনেক সময় ‘ফ্যাসিওটমি’ নামক অপারেশনের মাধ্যমে হাত বা পায়ের ফুলে ওঠা শক্ত অংশের মাংসপেশীগুলোকে আলগা করে দেয়া হয়। এতে মাংসপেশীর ভেতরকার চাপ কমে গেলে রক্ত সরবরাহে উন্নতি হয়। পক্ষান্তরে হাত বা পায়ের যে অংশ জীবিত নেই, সে অংশে রক্ত সরবরাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ধমনী মেরামতের অপারেশন বিধিসম্মত নয়। এতে বরং রোগীর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
দেশে জরুরি রক্তনালী সেবার
বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে রক্তনালী সংক্রান্ত জরুরি সেবা প্রদানকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান হল ঢাকার শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় হƒদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রক্তনালীর আঘাত নিয়ে রোগী এই হাসপাতালে আসে। দুঃখের বিষয়Ñ অনেক পথ পাড়ি দিয়ে রোগী যখন এখানে পৌঁছে, অনেক ক্ষেত্রেই তখন অকেজো হাত বা পা কেটে বাদ দেয়ার পরামর্শ ছাড়া রোগীকে আর কিছুই দেয়ার থাকে না। গত এক বছরে এই হাসপাতাল থেকে এ ধরনের শতাধিক রোগীকে হাত বা পায়ের অকেজো অংশ কেটে বাদ দেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে, যাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। তাই দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে রক্তনালী মেরামতের সুবিধা ও এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত জনবলসম্পন্ন আরও প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে গুরুত্ব¡পূর্ণ আর একটি বিষয় হল, দুর্ঘটনায় যখন রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন একই সঙ্গে সাধারণত হাড় এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্নায়ুও আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। রক্তনালী মেরামতের আগে ভাঙা ও নড়বড়ে হাড়কে স্থিতিশীল করে নিতে হয়। অন্যথায় মেরামতকৃত নরম ও নাজুক রক্তনালী আবারও ছিঁড়ে যেতে পারে। মূলত ভাঙা হাড় ও রক্তনালীর মেরামতের ব্যবস্থা একসঙ্গে করা গেলে গুরুত্ব¡পূর্ণ সময় বাঁচানো সম্ভব হয় এবং সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। দেশে বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে কোথাও এই সুবিধা নেই। এ ব্যাপারে দ্রুত যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষিত হোকÑ এটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখক : রক্তনালী সার্জন, জাতীয় হƒদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।

Exit mobile version