সিওপিডি কী
এটি শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এ রোগে ক্রনিক ব্রংকাইটিস (দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসনালির প্রদাহ) এবং এমফাইসিমা বা বায়ুস্ফীতিজনিত সমস্যার কারণে ফুসফুসের স্বাভাবিক বায়ুপ্রবাহে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসে বিঘ্ন হয়। ইংরেজি পরিভাষায় একে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি বলে। সিওপিডি বা ক্রনিক অবসট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ শ্বাসতন্ত্রের একটি জটিল রোগ। এই রোগ ধূমপায়ীদের বেশি হতে দেখা যায়।
ফুসফুসের একধরনের জটিল রোগ নিয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন। তিনি বারডেম জেনারেল হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
প্রশ্ন : সিওপিডি মানে কী? এতে কারা বেশি আক্রান্ত হন?
উত্তর : এটি শ্বাসনালির এক ধরনের প্রদাহজনিত রোগ। এই প্রদাহজনিত রোগটি আর ভালো হবে না। একবার হলে আর আগের অবস্থায় ফিরে আসবে না। এটি ধীরে ধীরে আরো খারাপের দিকে যাবে। এবং তাঁর দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্ট বাড়বে।
প্রশ্ন : এই রোগ হলে একজন মানুষের কী সমস্যা হয়?
উত্তর : সাধারণত যাঁরা ধূমপায়ী, তাঁদের এই রোগ হয়। যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁদেরই বেশি হয়। এ ছাড়া আরো কারণ রয়েছে। আমাদের মায়েরা যাঁরা গ্রামে আছেন, তাঁরা অনেক সময় লাকড়ি দিয়ে রান্না করেন। চুলায় যখন ফুঁ দিতে থাকেন, তখন কিছু ধুলা শ্বাসনালিতে চলে আসে। তাঁরা ধূমপায়ী নন, তবে ওই যে ধুলাগুলো খাচ্ছেন, তাই তাঁদের সিওপিডি হতে পারে। আর সিওপিডি মানে একটি দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসনালির প্রদাহ। যেটা আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে না। যাঁদের বয়স বাড়ে, সাধারণত চল্লিশের পরে হয়। অ্যাজমা কিন্তু আগেই যেকোনো বয়সে হতে পারে।
সিওপিডি রোগটি শুরু হলে ধীরে ধীরে এর তীব্রতা বাড়তে থাকে। মানে তাঁর শ্বাসকষ্ট, কাশি, দম নিতে কষ্ট হওয়া, কফ পড়া ইত্যাদি জিনিস বেশি হয়ে থাকে।
প্রশ্ন : যখন কারো শ্বাসকষ্ট হয় বা কাশি হয়, মাথায় কাজ করে ‘আমার অ্যাজমা হলো কি না’? সিওপিডিতেও আপনি বলছেন কাশি হবে, শ্বাসকষ্ট হবে। এ দুটি শ্বাসকষ্টের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি? বা বোঝার উপায় আছে কি কোনটির কারণে হচ্ছে?
উত্তর : আসলে অ্যাজমা যেকোনো বয়সে হতে পারে। বাচ্চা থেকে শুরু করে একেবারে বৃদ্ধ পর্যন্ত হতে পারে। তবে সিওপিডি সাধারণত মাঝবয়সে হয়। সাধারণত চল্লিশ বছরের পরে হতে পারে। অ্যাজমা যেমন মাঝেমধ্যে হয়, আবার ভালো হয়ে যায়। তবে সিওপিডি কিন্তু এ রকম নয়। হলে ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্টের দিকে চলে যায়।
সিওপিডি বেশি হয় ধূমপায়ীদের। তাঁরা মনে করেন, সিগারেট খাই, তাই হয়তো একটু কাশি হয়। আস্তে আস্তে শ্বাসকষ্ট হয়। হতে হতে রোগটি বেড়ে যায়। যখন চিকিৎসকের কাছে আসে, তখন জটিল অবস্থা নিয়ে আসে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, অ্যাজমা অনেক সময় পারিবারিকভাবে থাকে। সিওপিডিতে সাধারণত এ রকম ইতিহাস থাকে না। অ্যাজমার কিছু কারণ থাকে, যেগুলোর কারণে অ্যাজমা বাড়ে। যেমন ধুলাবালি লাগলে বাড়ছে বা কোনো খাবার থেকে হচ্ছে বা ঠান্ডা লাগলে সমস্যা হচ্ছে। তবে সিওপিডিতে তেমন নেই। তবে যেকোনো সংক্রমণ সিওপিডিকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
প্রশ্ন : সিওপিডি একবার হলে আর ভালো হয় না কেন?
উত্তর : ভালো না হওয়ার কারণ হলো, শ্বাসনালিতে যেসব পরিবর্তন হয়, এটা ধীরে ধীরে শ্বাসনালিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমরা যখন সিগারেট খাই, তখন শ্বাসনালিতে স্থায়ী কিছু পরিবর্তন হয়ে যায়। এ পরিবর্তন হওয়ার জন্য এটি আর আগের অবস্থায় ফিরে আসে না।
ত্রিশ বছরের পর একজন সাধারণ মানুষের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ৩০ এমএল করে প্রতিবছর কমে। বয়স বাড়বে, কার্যক্ষমতা কমতে থাকবে। এটি স্বাভাবিক বিষয়। তবে যাঁদের সিওপিডি হয়, যাঁদের সিওপিডি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাঁদের ফুসফুসের কার্যক্রম খারাপ হওয়ার মাত্রা প্রায় ১০০ এমএল। এতে তাড়াতাড়ি সমস্যাটা হয়।
সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হলো প্রথমে এই রোগ নির্ণয় করা। এর পর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা দেওয়া। চিকিৎসা যেগুলো রয়েছে, সেটি কিন্তু রোগকে ভালো করবে না। রোগীর কষ্ট কমিয়ে দেবে।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন, সিওপিডি একবার হলে আর ভালো হয় না। কেউ যদি মনে করে আমার তো এই রোগ ভালো হবে না, তাহলে চিকিৎসা করে লাভ কী?
উত্তর : আসলে আমরা দুটি জিনিস করতে পারব। একটা হলো রোগটি যেন আর না বাড়ে। একটি কাজ করতে পারব, সেটি হলো সিগারেট খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া। এটি খাওয়া বন্ধ করলে ফুসফুস যে খারাপ হয়ে যাচ্ছে, এটিও বন্ধ হবে। ওষুধগুলো দেওয়ার কারণে কষ্টটা অনেকটা কমে যাবে। তবে একে প্রতিরোধ করার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে সিগারেট বন্ধ করে দেওয়া।
আর রান্না করার বিষয়ে বলব, এখন বিভিন্ন ধরনের চুলা বেরিয়েছে, যেগুলো পরিবেশবান্ধব। সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন। আমরা মাস্ক ব্যবহার করতে পারি।
প্রশ্ন : সিওপিডির চিকিৎসা করলে দীর্ঘমেয়াদি কষ্ট কমানো সম্ভব, নাকি ক্ষণে ক্ষণে আবার এটা বাড়তে থাকবে?
উত্তর : এ ক্ষেত্রে যেটা করতে হবে প্রথমত, সিগারেট বন্ধ করে দিতে হবে। সংক্রমণ হলে চিকিৎসা নিতে হবে। কারণ, সংক্রমণ তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। এবং তৃতীয় হচ্ছে শ্বাসনালি প্রসারিত করার যে ওষুধগুলো, সেগুলো ব্যবহার করতে হবে। আর সংক্রমণে যেন তাঁদের ফুসফুস আরো খারাপ না করে দেয়, এ জন্য ভ্যাকসিন দিতে হবে।
প্রতিবছর একবার করে সিওপিডি রোগীকে এই ভ্যাকসিন দিয়ে দেওয়া হয়। এবং প্রতি পাঁচ বছর পরপর নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন, অর্থাৎ নিউমোনিয়ার যে ভ্যাকসিন, সেটি দিয়ে দিই। যাতে তাঁর কোনোভাবেই ফুসফুসের সংক্রমণ না হয়। যেটা খুবই কার্যকর। এটা সারা দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ দেশেও চালু করা হয়েছে। অনেক রোগীও নিচ্ছেন এটি।
প্রশ্ন : ধূপমান যত অল্প বয়সে শুরু করবে এবং প্রতিদিন যতগুলো সিগারেট খাবে, তত ক্ষতি হবে। সিওপিডির বেলায়ও কি বিষয়টি প্রযোজ্য?
উত্তর : আপনি যদি দৈনিক ২০টি করে সিগারেট খান, এক বছর ধরে, এটি হবে এক প্যাক ইয়ার। আপনি যদি ২০ বছর সিগারেট খান, তাহলে ২০ প্যাক ইয়ার। সাধারণত সিওপিডি হতে ২০ প্যাক ইয়ার প্রয়োজন হয়। তার পর যত বেশি খাবে, তার এটি বেশি হবে। যদি ৪০টি করে খায়, তাহলে ১০ বছরের মধ্যে হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : আমরা প্রায়ই আলোচনায় শুনি প্যাসিভ স্মোকিং (পরোক্ষ ধূমপান)। যিনি ধূমপান করছেন, তার যতটা ক্ষতি হচ্ছে, পরোক্ষ ধূমপানেও তেমন পরিমাণ ক্ষতি হয়। সিওপিডির ক্ষেত্রে যিনি ধূমপান করছেন না, তবে ধূমপায়ীর সঙ্গে আছেন তার কী সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : যাঁদের সিওপিডি রয়েছে, তাদের ৯০ শতাংশ রোগীরই সিওপিডি রয়েছে। তবে দেখা গেছে, যাঁরা ধূমপায়ী নন, তবে এমন একটি পরিবেশে আছেন, যেখানে ধোঁয়া শ্বাসের সঙ্গে ভেতরে নিতে হচ্ছে, তাহলে কিন্তু পাঁচ ভাগ অংশের সিওপিডি হতে পারে। আরেকজনের পাপের খেসারত তাঁকে দিতে হচ্ছে।