ডা. মৌসুমী রিদওয়ান
অনুন্নত বিশ্বের কিছু দেশ, বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে অল্টারনেটিভ মেডিসিনের নামে প্রাচীন আমলের চিকিৎসাব্যবস্খাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। যদিও প্রকৃত অর্থে অল্টারনেটিভ মেডিসিন বলতে যা বোঝানো হয় তার কোনো কিছুরই প্রতিফলন থাকে না তথাকথিক এ বিকল্প চিকিৎসায়। অল্টারনেটিভ মেডিসিনের নামে উদ্দেশ্যমূলক এই বিস্তার আয়ুর্বেদ শাস্ত্র বা হার্বাল মেডিসিনের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে মূল চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে উন্নত বিশ্বে প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের বিষয়টি বিলুপ্তপ্রাপ্ত। এখন কোটি কোটি বিলিয়ন ডলার খরচ করে এগিয়ে যাচ্ছে যে চিকিৎসাব্যবস্খা, তা মোটেও হার্বাল নয়। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্খার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা এখনো রয়ে গেছে। এই সীমাবদ্ধতার কথা অকপটে স্বীকার করছে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান। কিন্তু সাধারণ দরিদ্র মানুষ সস্তায় প্রাপ্ত হার্বালের দিকে ঝুঁকছেন। তবে এ কথা সত্যি, সস্তার তিন অবস্খা।
তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, হার্বালের কি কোনো উপকারই নেই? এর উত্তর হচ্ছে আছে। কিন্তু হার্বালের উপকারিতা নিয়ে যত লম্বা লম্বা কথা বলা হয়, কাজ হয় তার চেয়ে অনেক কম। মানসিক নির্ভরতার কারণে অনেকে এ চিকিৎসা নিয়ে স্বস্তি পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া কিছু কিছু রোগ আছে এমনিতেই সেরে যায়। সে ক্ষেত্রে হার্বাল চিকিৎসা নিলে রোগী ভাবতেই পারেন হার্বাল ওষুধে রোগ নিরাময় হয়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি সামান্য কাজ দেয়। যেমন বমিভাব হলে আদা খেলে কমে যায়। কিন্তু বমিভাবের পেছনে যদি শরীরের কোনো অঙ্গের অসুস্খতা দায়ী থাকে তখন এক মণ আদা খেলেও কাজ হবে না। এ রকম অনেক সামান্য কিছু সফলতার ইতিহাস আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের আছে। একে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে যে কল্পকাহিনী তৈরি করা হয়, তাতে হার্বালের মারাত্মক সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা চাপা পড়ে যায়। তৈরি হয় ভুল ধারণা। কুসংস্কারে বিশ্বাসী মানুষ চলে বিপথে। বিপদ নেমে আসে অকস্মাৎ। হার্বাল মেডিসিন নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো এ নিবìেধ।
প্রচলিত বিশ্বাস : হার্বাল প্রাকৃতিক, তাই এটা অবশ্যই নিরাপদ ও কার্যকর।
প্রকৃত সত্য : প্রাকৃতিক শব্দের সাথে নিরাপদ শব্দটি সব সময় খাপ খায় না। হেমলক বা বিষাক্ত ব্যাঙের ছাতার কথা চিন্তা করুন। প্রকৃতিপ্রদত্ত ডাবের পানিও কিডনি অকেজো হয়ে গেলে খাওয়া নিষেধ। ইপেড্রা বা সোমলতা রক্তচাপ বাড়াতে পারে। বেশি গ্রহণে স্ট্রোক, খিঁচুনিসহ মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কয়েক সপ্তাহ জ্যৈষ্ঠমধু গ্রহণ করলে রক্তে পটাশিয়াম কমে যেতে পারে, শরীর দুর্বল লাগবে, হার্ট অচল হয়ে পরপারের আমন্ত্রণপত্র পেতে পারেন। হার্বালের সাথে বিষাক্ত পারদ, আর্সেনিক, সিসা বা কীটনাশকের মিশ্রণ থাকতে পারে, কখনো বা হার্বালের সাথে স্টেরয়েড কিংবা ঘুমের ওষুধ মেশানো হয; যার দীর্ঘ ও অপ্রাসঙ্গিক ব্যবহার আপনার জীবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। মনে করা হয়, হার্বালে নাকি বিভিন্ন গাছগাছড়ার ফলমূল একসাথে মেশানো হয় বলে এই কার্যকরী। প্রকৃতিপ্রদত্ত বলে কৃত্রিমভাবে তৈরি ওষুুধের চেয়ে শরীরে ভালোভাবে শোষিত হয় এ ধারণা বিজ্ঞানসম্মত নয়। হার্বাল বলে যা গ্রহণ করছেন তা পাকস্খলীর অ্যাসিড-এনজাইম হজম করতে পারে। শোষণের ক্ষেত্রে শরীর বুঝতে পারে না কোনটা প্রাকৃতিক, কোনটা সিনথেটিক। বিজ্ঞানীরা কোনো প্রাকৃতিক উপাদানের রাসায়নিক গঠন জানার পর ওই উপাদানের বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে হুবহু জিনিস তৈরি করেন। যেমন স্যালিসিন সাধারণ মাথাব্যথার মোক্ষম ওষুধ। এর সিনথেটিক রূপটি হচ্ছে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড ও ডিসপ্রিন, যা কার্যকারিতায় তফাতবিহীন।
প্রচলিত বিশ্বাস : বছর বছর ধরে বাপ-দাদারা প্রাকৃতিক ওষুধ ব্যবহার করে আসছেন। অতএব এটা উপকারী ও নিরাপদ।
প্রকৃত সত্য : কবিরাজরা প্রাকৃতিক ওষুধগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কান্ট্রিলোজের রাসায়নিক পদার্থ বা কোল্টসফটের কারণে যে ক্যান্সার হয় তা দ্রুত নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া আলফা-আলফা বা পেনিওয়ার্ট যে কোনো কাজে আসে না তা আধুনিক বিজ্ঞানে প্রমাণিত।
প্রচলিত বিশ্বাস : হার্বাল তো প্রাকৃতিক। এ বিষয়ে তাই ডাক্তারকে না জানালেও চলবে।
প্রকৃত সত্য : প্রকৃতিজাত বলে হার্বাল গ্রহণকারীরা বেশি পরিমাণে হার্বাল গ্রহণে দ্বিধাবোধ করেন না। তারা বিষয়টি অন্য চিকিৎসকদের কাছে গোপন রাখেন। ফলে হার্বালের কারণে যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তা অনির্ণীতই রয়ে যায়। হার্বালের কারণে অনেক অসুখেরই তীব্রতা বাড়তে পারে। রসুন, আদা রক্তের স্বাভাবিক জমাট বাঁধা প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে। এর সাথে ডিসপ্রিন, ওয়ারফারিন ওষুধে কার্যকারিতা যোগ হলে শরীরে শুরু হবে রক্তক্ষরণ। ডায়াবেটিস রোগীরা ওষুধের সাথে যৌবন বা শক্তি বর্ধনের জন্য জিনসেং গ্রহণ করলে রক্তে চিনির পরিমাণ খুব বেশি কমে যেতে পারে। একাইনেসিয়া নামক হার্ব গিঁটে বাতের ব্যথা বাড়ায়। এই তথ্যগুলো অনেকেরই জানা নেই।
প্রচলিত বিশ্বাস : বোতলের গায়ে লেখা আছে মহৌষধ, ১০০% গ্যারান্টি, বিফলে মূল্য ফেরত, কাজ না করে উপায় আছে?
প্রকৃত সত্য : লেবেলে অনেক কিছুই লেখা থাকে। একই ওষুধ নিয়ে এক কোম্পানি বলছে স্মরণশক্তি বাড়বে, আরেক কোম্পানি রিভার সতেজ রাখে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তাহলে কোনটি ঠিক? মজার বিষয় হলো, কোন ওষুধ কিভাবে কাজ করবে বা শরীরের কোথায় কোথায় কাজ করবে, এ বিষয়ে প্রাকৃতিক ওষুধবিশারদদের কেউই কিছু বলতে পারেন না। বিফলে মূল্য ফেরত! ১০০ টাকার ওষুধ খেয়ে কিডনি নষ্ট হলে হয়তো ১০০ টাকা ফেরত পাবেন, কিন্তু কিডনিটি নয়। আরেকটি বিষয় গ্যারান্টি দিয়ে কোনো রোগের চিকিৎসা সম্ভব নয়। যদি কেউ দেন তাহলে তিনি হয় দেবতা, নয় ইবলিশ।
প্রচলিত বিশ্বাস : প্রকৃতিজাত, অতএব বেশি জানার কী দরকার?
প্রকৃত সত্য : আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ওষুধসামগ্রীকে ব্যাপক ট্রায়ালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বাজারে ছাড়া হয়। ওষুধের মাত্রা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, সাবধানতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রাখা হয়। ওষুধ সম্পর্কে এ গবেষণা চলে অনবরত। সমস্যা দেখা দিলে বা তার প্রমাণ মিললে ওষুধটি বাজার থেকে তুলে নেয়া হয় কিংবা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। আর এ বিষয়টি হার্বাল শাস্ত্রে সম্পূর্ণ অবহেলিত। হার্বাল শাস্ত্রে ওষুধ নিয়ে কোনো গবেষণা নেই, ওষুধের দোষ-গুণ বিচারের কোনো ব্যবস্খা নেই। তাদের কথায় এসব ওষুধের কোনো দোষই নেই। আর দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, হার্বাল বলেই তাদের ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসে। সুতরাং হার্বাল ব্যবহারেও সাবধান হতে হবে। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্খাকে উপেক্ষা করে অìধপথে হাঁটবেন না। এতে ক্ষতি হবে নিজেরই। দীর্ঘমেয়াদি অসুখে এর ব্যবহার এড়িয়ে চলুন। গর্ভবতী মহিলা, গর্ভবতী হবেন বা বুকের দুধ খাওয়ান; এমন মহিলাকে হার্বাল সেবনে বিরত রাখুন। শিশুকে হার্বালের নাগালের বাইরে রাখুন। হার্বাল ফুডপয়জনিং করতে পারে। হার্বালে সমস্যা তৈরি হওয়ার সাথে সাথে তা বìধ করে দিন। দ্রুত ডাক্তার দেখান।
শীতের শাকসবজিভিটামিন সি ভরপুর মুলা
মুলা কাঁচা এবং রান্না উভয় অবস্থায় খাওয়া যায়। তবে রান্নার চেয়ে কাঁচা খাওয়া ভালো। মুলার পাতা খুবই পুষ্টিকর। ইউরোপে সালাদ হিসেবে মুলা ব্যাপক জনপ্রিয়।
মুলার পুষ্টিগুণ
আহার উপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম মুলায় আছে_আমিষ ১.৩ গ্রাম, শ্বেতসার ৫.৪ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, খনিজ লবণ ০.৫ গ্রাম, ভিটামিন বি-১০.৪৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৩৪ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৫
মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৫ মিলিগ্রাম, খাদ্যশক্তি ২৮ কিলোক্যালরি।
পুষ্টিবিদরা বলেন, মুলার চেয়ে মুলাশাক বেশি উপকারী।
উপকারিতা
– মুলা ভিটামিন সি-র সমৃদ্ধ উৎস। মুলার পাতায় এ ভিটামিনের পরিমাণ ছয় গুণ বেশি। ভিটামিন সি ছাড়াও এতে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টি-অঙ্েিডন্ট আছে। এটি শরীরের ক্ষতিকর ফ্রি রেডিক্যাল দূর করে।
– বিভিন্ন ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
– বিটা-ক্যারোটিন হার্টস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে।
– ক্যালরির পরিমাণ কম থাকলেও মুলায় আছে উচ্চমাত্রার কপার ম্যাঙ্গানিজ ও পটাশিয়াম।
– এটি শরীরের ওজন হ্রাস করে।
– আলসার ও বদহজম দূর করতে সাহায্য করে।
– কিডনি ও পিত্তথলিতে পাথর তৈরি প্রতিরোধ করে।
– হুপিং কাশি, কোষ্ঠকাঠিন্য, আর্থ্রাইটিসসহ বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে ভূমিকা পালন করে।
– প্রাচীনকালে মুলা শুধু সবজি হিসেবেই খাওয়া হতো না, ওষুধ হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
– দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে ও ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও মুলা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
ডা. জিয়াউল হক
তথ্য : তৃপ্তি চৌধুরী, পুষ্টিবিদ, বিএসএমএমইউ, ঢাকা