■ শিশির মোড়ল
১৩ এপ্রিল সকাল ১০টা। রাজধানীর মগবাজার এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মহিলা সার্জারি ওয়ার্ডের সামনে নবজাতক কোলে নিয়ে বসে ছিলেন এক নারী। জানালেন, বিক্রমপুর থেকে অন্তঃসত্ত্বা বোনকে ডাক্তার দেখাবেন বলে এসেছেন এক দিন আগে। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে চিকিৎসক তক্ষুনি অস্ত্রোপচারের কথা বলেন। তাঁরা সকাল ১০টায় হাসপাতালে পৌঁছান, আর বেলা সাড়ে ১১টায় নবজাতকের জন্ম হয়।
ওই নারী জানান, চিকিৎসক যখন বললেন, অস্ত্রোপচারে দেরি হলে শিশুর ক্ষতি হতে পারে, তখন তাঁদের রাজি হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এর আগে তাঁর অন্য দুই বোনেরও একই হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্ম নিয়েছে।
ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০১০ সালে ১০ হাজার ২৩৬টি শিশুর জন্ম হয়, এর ৬৬ শতাংশ অস্ত্রোপচারে। ওই হাসপাতালে ১৯৯৮ সালে অস্ত্রোপচারের হার ছিল ৪৭ শতাংশ।
শুধু এ হাসপাতালেই অস্ত্রোপচারের হার বাড়েনি, বেড়েছে সারা দেশে। ‘মাতৃমৃত্যু ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবা জরিপ ২০১০’ বলছে, গত বছর দেশে প্রায় চার লাখ ৩৮ হাজার শিশু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে। ২০০১ সালের তুলনায় এই সংখ্যা পাঁচ গুণ বেশি।
দেশে শিশু জন্মের সংখ্যা ও হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারও বেশি হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে সেবা গ্রহণকারী পক্ষকে বিপুল অর্থ অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসবের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার দরকার হয়। মায়ের অপুষ্টি ও গর্ভকালীন সমস্যার কারণে প্রসবে জটিলতা দেখা দেয়। মা ও নবজাতকের প্রাণ ও স্বাস্থ্যরক্ষায় অস্ত্রোপচার করতে হয়।
জাতীয় জরিপের তথ্য: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একাধিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থার সহায়তায় ২০১০ সালে দেশে মাতৃমৃত্যু ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবার ওপর সারা দেশে জরিপ করেছে। জরিপে এক লাখ ৭৫ হাজার পরিবারের তথ্য নেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০১ সালে ২ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর জন্ম হয়েছিল অস্ত্রোপচারে, আর ২০১০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ২ শতাংশে। অর্থাৎ ১০ বছরে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার পাঁচ গুণেরও বেশি বেড়েছে।
জরিপের সঙ্গে জড়িত পরিসংখ্যানবিদেরা প্রথম আলোকে জানান, ২০১০ সালে দেশে ৩৫ লাখ ৮০ হাজার শিশুর জন্ম হয়। চার লাখ ৩৮ হাজার শিশুর জন্ম হয় অস্ত্রোপচারে (১২ দশমিক ২ শতাংশ)। এর মধ্যে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজারের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন ছিল না। অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার হয়েছে ৩২ শতাংশ।
জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষিত ও ধনিক শ্রেণীর মধ্যে অস্ত্রোপচারের হার বেশি। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেছেন এমন মায়েরা ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। নিরক্ষর মায়েদের ক্ষেত্রে এই হার সাড়ে ৩ শতাংশ। অন্যদিকে সমাজের সবচেয়ে ধনিক শ্রেণীর মধ্যে ৩২ দশমিক ২ শতাংশ মা অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, আর সবচেয়ে দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে এই হার ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী শামস এল আরেফিন বলেন, শিক্ষিত ও ধনীদের যে এই হারে অস্ত্রোপচার দরকার, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হারের চেয়ে তা অনেক বেশি। আবার নানা বিবেচনায় যেসব দরিদ্রের অস্ত্রোপচার বেশি দরকার, কিন্তু তারা সে সুযোগ পায় না।
জরিপ বলছে, খুলনা বিভাগে অস্ত্রোপচারের হার সবচেয়ে বেশি, ১৭ দশমিক ২ শতাংশ। সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে, ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।
বিশ্বজুড়ে একই প্রবণতা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পৃথিবীব্যাপী অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মহার বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১০ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য প্রতিবেদনে বলেছে, ২০০৮ সালে শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ৬২ কোটি অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ৫২টি দেশে শিশু জন্মে অস্ত্রোপচারের হার ১০ শতাংশের নিচে। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অস্ত্রোপচার হয় ১৪টি দেশে, আর ১৫ শতাংশের বেশি অস্ত্রোপচার হয় ৬৯টি দেশে। ব্রাজিলে অস্ত্রোপচারের হার সবচেয়ে বেশি, ৪৫ দশমিক ৯ শতাংশ। প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানে এই হার যথাক্রমে ৮ দশমিক ৫ ও ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০০৮ সালের ওই হিসাবে বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারের হার ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
সর্বশেষ ২০১০ সালের হিসাবে বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ২ শতাংশে। অন্য একটি প্রতিবেদন বলছে, ভারতে বিশেষ করে শহরগুলোতেও অস্ত্রোপচারের হার দ্রুত বাড়ছে। মুম্বাই শহরের ২৫ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে এভাবে।
সেরা প্রতিষ্ঠানের চিত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় ২০০৯ সালের। দেখা যায়, ওই বছর এক হাজার ৭০১ জন গর্ভবতী মা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে এক হাজার ১৭২ জনের অর্থাৎ ৬৮ দশমিক ৯০ শতাংশ মায়ের সন্তান হয় অস্ত্রোপচারে। ওই বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেছেন, ‘জানি না আর কোন হাসপাতালে এমন নির্বিচারে পেট কেটে সন্তানের জন্ম দেওয়া হয়।’
এ ব্যাপারে বিভাগের চেয়ারম্যান এম আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশের জটিল রোগী এখানে আসে বলে অস্ত্রোপচার ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না।
কার স্বার্থ: পরিসংখ্যান বলছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যত শিশুর জন্ম হচ্ছে, তার ৭১ শতাংশ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। আর সরকারি হাসপাতাল এবং এনজিও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই হার যথাক্রমে ৩৫ ও ৩০ শতাংশ।
জরিপসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত বছর চার লাখ ৩৮ হাজার শিশু জন্ম নেয় অস্ত্রোপচারে। এর মধ্যে এক লাখ ৪০ হাজার অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন ছিল না। এই অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার হয়েছে চিকিৎসক, হাসপাতাল-ক্লিনিক মালিকদের স্বার্থে। স্বাভাবিক প্রসবের জন্য ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এত সময় নষ্ট করতে চান না অনেক চিকিৎসক।
জরিপ সূত্র বলছে, সরকারি হাসপাতালে বেলা দুইটার আগেই অধিকাংশ অস্ত্রোপচার হয়। বিকেলে চিকিৎসকেরা ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চলে যান।
গত সপ্তাহে একাধিক জেলা হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ অস্ত্রোপচার সকালের দিকে হয়। বরিশাল জেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সকাল ১০টা থেকে বেলা দুইটার মধ্যে অস্ত্রোপচার হয়। গোপালগঞ্জ জেলা হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেছেন, অধিকাংশ অস্ত্রোপচার বেলা দুইটার আগেই হয়। তবে জরুরি প্রয়োজনে রাতেও হয়। একই তথ্য পাওয়া যায় ঠাকুরগাঁও জেলা থেকেও।
বিএসএমএমইউর স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, অনেক ক্ষেত্রে রোগীর পক্ষ ও চিকিৎসক ঝুঁকি এড়াতে চান, যদি হঠাৎ করে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। এসব কারণে অস্ত্রোপচারকে নিরাপদ মনে করেন তাঁরা।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন এবং গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাভাবিক প্রসবের ভয় থাকে অনেক মায়ের। অনেক মা প্রসবযন্ত্রণা পেতে চান না। অনেক মা মনে করেন, স্বাভাবিক প্রসবে তার যৌনাঙ্গের ক্ষতি হবে। এসব মা অস্ত্রোপচারে আগ্রহ দেখান। গবেষণায় দেখা গেছে, অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় কিছুসংখ্যক মা স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ করিয়ে নেন।
জনস্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে: অস্ত্রোপচারের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে বলে মন্তব্য করেন বিএসএমএমইউর মেডিসিন অনুষদের ডিন এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, অস্ত্রোপচারের সময় বেদনানাশক/চেতনানাশক ওষুধ দেওয়া হয়। এর প্রভাব পড়ে মা ও নবজাতকের ওপর।
আইসিডিডিআরবির জনসংখ্যা কার্যক্রমের প্রধান পিটার কিম স্ট্রিটফিল্ড বলেন, একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, অস্ত্রোপচারে গর্ভ নষ্টের ঝুঁকি ও নবজাতক মৃত্যুহার বাড়ে। শিশুকে মায়ের দুধ শুরু করাতে সমস্যা দেখা দেয়। এতে জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত ও বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বাড়ে। প্রসব-পরবর্তীকালে মায়ের মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চহারে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের সঙ্গে অপরিণত শিশু জন্মের সম্পর্ক আছে, এতে শিশুর প্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বেশি। একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেছেন, দুটি সন্তান জন্ম দেওয়ার পর অন্য কোনো কারণে মায়ের পেটে অস্ত্রোপচার দরকার হলে ঝুঁকি বাড়ে।
করণীয়: একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, নিশ্চিত কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ (অ্যাবসলিউট ইন্ডিকেটর) আছে, যা দেখে বলা যায় অস্ত্রোপচার লাগবে। কিছু ক্ষেত্রে (যেমন—জোড়া শিশু) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রসবের সময়ে হঠাৎ কোনো বিপর্যয় এড়াতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে অস্ত্রোপচার দরকার হয়ে পড়ে। যে কারণেই অস্ত্রোপচার করা হোক না কেন, চিকিৎসককে তা ব্যবস্থাপত্রে লিখতে হবে। তিনি মনে করেন, চিকিৎসককে যদি জবাবদিহি করতে হয়, তাহলে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার কমে যাবে।
এম কিউ কে তালুকদার বলেন, প্রসবযন্ত্রণা শুরু হলে মাকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাভাবিক প্রসবের জন্য চিকিৎসক শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন, চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। এটাই মেডিকেল এথিকস বা নৈতিকতা।
অর্থ বড় বাধা
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার গৃহিণী অনামিকা দের প্রথম সন্তানের জন্ম হয় ২০০২ সালে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা স্বাভাবিক প্রসবের পক্ষেই ছিলেন সব সময়। অনামিকা বলেন, ‘শুক্রবার আমার ব্যথা শুরু হয়। হাসপাতালে ভর্তি হই শনিবার সকালে। চিকিৎসকেরা আমাকে নজরে রেখেছিলেন। কষ্টের সময়ও বারবার স্বাভাবিক প্রসবের কথাই বলছিলেন। তাঁদের মত ছিল, যদি স্বাভাবিক প্রসবে কোনো সমস্যা হয়, তাহলেই অস্ত্রোপচার করবেন। রোববার দুপুরে আমার মেয়ে হয়।’ তাঁর দ্বিতীয় সন্তান জন্ম নেয় সাতমসজিদ সড়কের একটি হাসপাতালে ২০০৮ সালে। বললেন, ‘কষ্ট শুরু হলে সকাল ছয়টায় বাসার কাছে ওই হাসপাতালে যাই। আমাকে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই হাসপাতালের লোকজন বলতে থাকেন, অস্ত্রোপচার দরকার। আমি এর প্রতিবাদ করি। তারা বেলা তিনটায় অস্ত্রোপচারের সময়ও ঠিক করে ফেলে। আমি স্বামীকে ভর্তি বাতিল করে অন্য হাসপাতালে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকি। এর মধ্যে সকাল সাড়ে ১০টায় আমার ছেলের জন্ম হয়। চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের সুযোগই পাননি।’
একটি সেবামূলক বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্বাভাবিক প্রসবের খরচ সর্বোচ্চ তিন হাজার ৭০০ টাকা এবং অস্ত্রোপচারে খরচ সর্বনিম্ন সাত হাজার ৯০০ টাকা। এর বাইরে কেবিন ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই।
সরকারি জেলা হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসবের সময় রোগীর পক্ষকে ৫০০ টাকার ওষুধ কিনলেই চলে, আর অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে কিনতে হয় কমপক্ষে দুই হাজার টাকার ওষুধ। গোপালগঞ্জ জেলা হাসপাতালের একজন স্বাস্থ্যকর্মী জানিয়েছেন, স্বাভাবিক প্রসবের পর রোগীকে এক দিন হাসপাতালে রাখা হয়, আর অস্ত্রোপচারের পর পাঁচ থেকে সাত দিন।
অর্থের সঙ্গে অস্ত্রোপচারের সম্পর্ক স্পষ্ট। অস্ত্রোপচারের খরচ বহন করতে পারে এমন শ্রেণীর মধ্যে এই হার অনেক বেশি। একাধিক গবেষণা ও মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অর্থের সংশ্লিষ্টতা থাকলে অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্মহার বাড়ে।
সরকারি আর্থিক লেনদেন আছে এমন স্বাস্থ্য কর্মসূচি অস্ত্রোপচারকে বেশি উৎসাহিত করছে। ইউরোপিয়ান জার্নাল অব পাবলিক হেলথ (ভলিউম ২০, ইস্যু ৪) বলছে, মেক্সিকোতে শর্ত সাপেক্ষে নগদ অর্থ প্রদান কর্মসূচি গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র নারীদের মধ্যে অস্ত্রোপচারের হার বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশেও এ রকম উদাহরণ আছে। সরকার মাতৃ ও শিশুমৃত্যুহার কমানোর লক্ষ্যে ৩৩টি উপজেলায় ডিমান্ড সাইড ফাইন্যান্সিং (ডিএসএফ) কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। কর্মসূচির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, এসব উপজেলায় অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মহার সাধারণ উপজেলার চেয়ে বেশি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর একটি কারণ আর্থিক প্রণোদনা। একটি স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে চিকিৎসক ৬০ টাকা, নার্স ৪০ টাকা, ওয়ার্ড বয় ২৫ টাকা এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ২৫ টাকা—মোট ১৫০ টাকা প্রণোদনা ভাতা পান, কিন্তু অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে প্রণোদনা ভাতা তিন হাজার টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গবেষক বলেছেন, দুই হাজার ৮৫০ টাকা প্রণোদনা ভাতা বেশি হওয়ার কারণে চিকিৎসক ও নার্সদের অস্ত্রোপচারে আগ্রহ বেশি।