পৃথিবীতে প্রতি ১০ সেকেন্ডে এক জন ডায়াবেটিস রোগীর মৃতু্য হয় এবং দু’জন ডায়াবেটিস রোগী হিসেবে শনাক্ত হয়। ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত থাকলে স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন সম্ভব। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে নানা জটিলতা। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ব্যয়ভার একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবার জন্য বাজেটের ৫ থেকে ১০ শতাংশ। আমাদের দেশে ৮ শতাংশ লোক ডায়াবেটিসে আক্রানত্ম।
হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনির অক্ষমতা, অন্ধত্বসহ নানা প্রকার মারাত্মক পরিণতির অন্যতম কারণ ডায়াবেটিস। শুরম্নতেই নির্ণয়ের মাধ্যমে ডায়াবেটিস চিকিৎসা করলে এবং প্রতিরোধের ব্যবস্থা করলে জটিলতা বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
ডায়াবেটিসের উপসর্গ এবং লক্ষণসমূহ
সব সময় পিপাসার্ত থাকা, ঘন ঘন প্রস্রাব করা, হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া, ঘন ঘন ক্ষুধা লাগা, ক্ষত স্থান না শুকানো, হাত-পা অবশ বা শির শির করা, চোখে ঝাপসা দেখা, যৌন অনাগ্রহতা এবং যৌনাঙ্গের সংক্রমণ প্রভৃতি।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধের ব্যবস্থাসমূহ
০ প্রথম পর্যায়ের (বা মুখ্য) প্রতিরোধ ব্যবস্থা : কারও ডায়াবেটিস হতে না দেয়া বা বিলম্বিত করা এর উদ্দেশ্য।
০ দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিরোধ ব্যবস্থা : রোগের শুরম্নতেই ডায়াবেটিস নির্ণয় এবং দ্রম্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
০ তৃতীয় পর্যায়ের প্রতিরোধ ব্যবস্থা : সুচিকিৎসার মাধ্যমে ডায়াবেটিসের জটিলতাসমূহ হতে না দেয়া বা বিলম্বিত করা।
ডায়াবেটিসের উচ্চ ঝুঁকিতে যাদের অবস্থান
০ ৪০-এর উপর যাদের বয়স
০ যাদের বংশে ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে।
০ শারীরিক পরিশ্রমের কাজ যারা করেন না।
০ যাদের বিএমআই ২৫-এর ওপরে। (বিএমআই বা শরীরের ভরসূচক দ্বারা স্থূলতার পরিমাপ করা যায়। শরীরের ওজনকে কিলোগ্রামে প্রাকাশ করে এবং উচ্চতাকে মিটারে প্রকাশ করে ওজনকে উচ্চতার বর্গ দিয়ে ভাগ করলে বিএমআই পাওয়া যায়)।
০ যাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে।
০ যাদের হাইপারটেনশন আছে।
০ যারা শর্করা বা গস্নুকোজ অসহিষ্ণুতায় ভুগছেন। (যাদের রক্তে গস্নুকোজের পরিমাণ সুস্থ মানুষের গস্নুকোজের পরিমাণের চেয়ে বেশি কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের গস্নুকোজের তুলনায় কম)।
ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা এবং জটিলতা বৃদ্ধির কারণসমূহ
০ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ
০ বার্ধক্য ও প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধি
০ নগরায়ণ ও তার বিভিন্ন কুফল
০ অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ
০ দৈহিক ব্যায়ামের অভাব
০ ধূমপান
ডায়াবেটিস চিকিৎসা ও পদ্ধতিসমূহ
০ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ (ডায়েটিং)। ৫০ শতাংশ নতুন রোগীকে শুধু ডায়েটিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা করা সম্ভব।
০ ডায়েটিং + ওষুধ খাওয়া
০ ডায়েটিং + ইনসুলিন নেয়া
০ নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম।
০ শৃঙ্খলা এবং শিক্ষা।
খাদ্য নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যসমূহ
০ সুষম খাদ্য গ্রহণ
০ নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ
০ দেহের উচ্চতা অনুযায়ী কাঙ্ৰিত ওজনে ফিরে আসা এবং ধরে রাখা।
০ মনের সন্তুষ্টি এবং স্বসত্মি বজায় রাখা।
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণের নিয়মাবলী
০ একজন মানুষ সারাদিনে কতটুকু খাবার খাবেন তা নির্ভর করবে কী পরিমাণ শক্তি তার দরকার সেটার ওপর।
০ শক্তির পরিমাণ নির্ণীত হয় রোগীর বয়স, লিঙ্গ, ওজন, পেশা, পরিশ্রম ইত্যাদির ওপর
০ স্থূল আকৃতির মধ্য বয়সী বা বয়স্ক ব্যক্তির শক্তির প্রয়োজন ১০০০ থেকে ১৬০০ কিলো ক্যালরি
০ পাতলা গড়নের বয়স্ক ব্যক্তির শক্তির প্রয়োজন ১৪০০ থেকে ১৮০০ কিলো ক্যালরি
০ কর্মঠ যুবক হলে শক্তির প্রয়োজন ১৮০০ থেকে ৩০০০ কিলো ক্যালরি
০ এক গ্রাম শর্করায় চার কিলো ক্যালরি, এক গ্রাম আমিষে চার কিলো ক্যালরি এবং এক গ্রাম চর্বি জাতীয় খাবারে নয় কিলো ক্যালরি শক্তি থাকে
০ সারাদিনে প্রয়োজনীয় শক্তির ৫০% থেকে ৬০% আসবে শর্করা জাতীয় খাবার থেকে, ১০% থেকে ১৫% আসবে আমিষ জাতীয় খাবার থেকে এবং ৩০% থেকে ৩৫% আসবে চর্বি জাতীয় খাবার থেকে।
০ ভাত প্রতিদিন ২/৩ কাপ খেতে হবে। রম্নটি প্রতিদিন সকালে ২/৩টা এবং রাতে ২/৩টা করে খেতে হবে। সকালে এবং বিকেলে হাল্কা নাসত্মার ব্যবস্থা থাকা ভাল। সবুজ শাক-সবজি বেশি করে খেতে হবে। প্রতিদিন ৭-৮ ধরনের সবজি খেতে পারলে খুবই ভাল। প্রতিদিন ৩টি সবজির এবং ২টি ফলের সার্ভিং গ্রহণ করতে হবে। এক সার্ভং হলো একটি টেনিস বলের সমান আয়তন বিশিষ্ট। চর্বি এবং আমিষ জাতীয় খাদ্য কম করে খেতে হবে। কেক, মিষ্টি, আইসক্রিম, জেলি, ক্র্যাকার্স, কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিঙ্কস, ফাস্টফুড, চতুষ্পদ প্রাণীর মাংস, মগজ, কলিজা, চামড়া, ডিমের কুসুম, ঘি, মাখন, ভেজিটেবল অয়েল, ডালডা, চিংড়ি এবং আলগা লবণ খাওয়া বাদ দিতে হবে। তবে ননিবিহীন দুধ শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজন।
দৈহিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামের উদ্দেশ্যসমূহ
০ ব্যায়ামের ফলে শরীরের ইনসুলিন ভালভাবে কাজ করার সুযোগ পায় এবং রক্তে সুগারের পরিমাণ কমে যায়।
বিপাক প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যায়ামের প্রয়োজন।
০ স্থূল দেহে ওজন কমানোর জন্য।
০ শারীরিক কাজকর্মের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য।
০ জীবনের স্বসত্মি এবং মাধুর্য ফিরিয়ে আনার জন্য।
০ ব্যায়ামের মাধ্যমে ভাল কোলেস্টেরল ঐউখ বাড়ে এবং রক্তচাপ কমে। তাই ব্যায়াম করলে হৃদস্বাস্থ্যের উন্নতি হয়।
ব্যায়ামের নিয়মসমূহ
০ এ্যারোবিক ব্যায়াম খুব ভাল। এটা এমন ধরনের কাজ বা ব্যায়াম যাতে নিশ্বাস ও হৃৎপি-ের গতি বেশ কিছু সময় ধরে বাড়ে। হাঁটাহাঁটি, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, মেঝে ঘষা, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করা এ সবই এ্যারোবিক ব্যায়ামের উদাহরণ। সপ্তাহের অধিকাংশ দিন মাঝারি ধাঁচের ব্যায়াম ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সবচেয়ে ভাল। এর সঙ্গে সপ্তাহে দুই তিন দিন শরীর পোক্তকারী কিছু ব্যায়াম করা যেতে পারে।
০ ব্যায়াম শুরম্ন করার আগে ৫ থেকে ১০ মিনিট হাল্কাভাবে ব্যায়াম করে গা গরম বা শরীরকে ব্যায়ামের জন্য প্রস্তুত করে নিতে হবে।
০ তারপর ৫ থেকে ১০ মিনিট বেশি জোালোভাবে ব্যায়াম করতে হবে।
০ শেষে ৫ থেকে ১০ মিনিট হাল্কাভাবে ব্যায়াম করতে হবে।
০ ওজন হ্রাসের জন্য মাঝারি ধাঁচের কিন্তু অধিকক্ষণ ধরে (১ ঘণ্টা) ব্যায়াম করার জন্য পরামর্শ দেয়া যেতে পারে।
০ বেশি জোরালো বা কষ্টসাধ্য ব্যায়াম তাদের জন্য প্রযোজ্য যাদের হৃদস্বাস্থ্য মোটামুটি ভাল।
০ এ্যাজমা রোগীদের বাড়িতে ব্যায়াম করা ভাল। প্রথমে হাল্কা এবং পরবতর্ীতে বেশি জোরালো ব্যায়াম করা যাবে। একটানা ব্যায়াম না করা ভাল।
০ শিশুদেরও ব্যায়াম করা উচিত
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নির্ণয় এবং নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রাগুলো
অভুক্ত অবস্থায় শিরার রক্ত সুগার মান (এফবিএস) যদি লিটারপ্রতি ৭ মিলিমোলের সমান বা বেশি হয় তাহলে ডায়াবেটিস হয়েছে বলে বুঝতে হবে। আবার অভুক্ত অবস্থায় ৭৫ গ্রাম গস্নুকোজ খাওয়ার ২ ঘণ্টা পরে যদি রক্ত সুগার মান লিটারপ্রতি ১১.১ মিলিমোলের সমান বা বেশি হয় তা হলেও ডায়াবেটিস হয়েছে বলে বুঝতে হবে। রক্তের এইচবি এওয়ান সি লেভেল ৭%-এর নিচে থাকলে এবং এফবিএসের মান লিটারপ্রতি ৬.১০ মিলিমোলের নিচে অথবা খাওয়ার পরে রক্ত সুগার মান লিটারপ্রতি ৮ মিলিমোলের নিচে থাকলে ডায়াবেটিস সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বলে বোঝা যাবে। গস্নুকোমিটারের সাহায্যে সহজেই রোগী রক্ত-সুগার মান নির্ণয় করতে পারেন।
যেসব বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে
০ হাইপারটেনশন এবং কোলেস্টেরল সুনিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
০ পায়ের যত্ন নিতে হবে এবং পায়ের পাতা নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে।
০ চক্ষু, দাঁত এবং ত্বকের যত্ন নিতে হবে
০ হাইপোগস্নাইসেমিয়া থেকে সাবধান থাকতে হবে।
০ ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে।
০ নিয়মিত ওষুধ খেতে ভুলে যাওয়া থেকে সাবধান থাকতে হবে।
জনসচেতনতার মাধ্যমে জনগণকে স্বাস্থ্যসম্মত জীবন-যাপন প্রণালী গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। আহারে বিহারে, শরীরের যত্নে, ওষুধ সেবনে এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণে শৃঙ্খলা অপরিহার্য। রোগ সম্পর্কে এবং রোগ প্রতিরোধের যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া রোগী এবং রোগীর পরিবারের সদস্যদের জরম্নরী কর্তব্য।
ডা. মফিজুর রহমান খান
উপদেষ্টা ই-হেলথ২৪ ডটকম ডটবিডি