বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরুর পর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের যে ঢল শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত আছে মঙ্গলবারও।
আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সোমবারই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি রোগী আসে। দুই দিন মিলে হাসপাতালে আসা বেশিরভাগই গুলিবিদ্ধ, বলছেন চিকিৎসকরা।
সোমবার বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষে আহত হয়ে সাতশর বেশি মানুষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন। তাদের মধ্যে ভর্তি করা হয় ১৬৩ জনকে। মঙ্গলবার সারা দিনে রোগী এসেছে ১৩৬ জন, যাদের ১৩ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গত দুই দিনে ঢাকা মেডিকেলে এসেছে ৫৮টি মরদেহ।
মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকার আশপাশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আহতদের সেখানে আনা হচ্ছে।
ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় বোমার আঘাতে আহত হয়ে জরুরি বিভাগে আসেন নুরুল ইসলাম এবং আমিনুল ইসলাম নামে দুই রিকশাচালক।
বোমার আঘাতে নুরুলের বাঁ হাতের আঙুল উড়ে গেছে, শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত নিয়ে ব্যথায় গোঙাচ্ছেন তিনি।
নুরুলের পাশে বসে তাকে ধরে আছেন আমিনুল ইসলাম, তার শরীরেও বোমার আঘাতের ক্ষত।
সেখানে আমিনুলের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন,“আমরা দুজন ভ্যান চালাই। দুপুর একটার দিকে আড়তে বইসা চা খাইতেছিলাম। এমন সময় আমাগো কাছে বোমা ফাডে। ওই বোমা লাগছে আমাগো গায়ে।”
জরুরি বিভাগের একজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হয়। পরিচয় প্রকাশে অনাগ্রহী এই চিকিৎসক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশের বিভিন্ন এলাকার হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন অথচ গতকাল (সোমবার) আসতে পারেননি, তার আজ আসছেন।
তিনি বললেন, “আজও যারা আসছেন, তারাও হামলা ও সংঘর্ষে আহতের ক্ষত নিয়ে আসছেন। দুই দিনে কত লোক এসেছেন, সেই সংখ্যা বলতে পারব না। তবে যারা আসছেন তাদের প্রায় নব্বই শতাংশ গুলিতে আহত। মারামারি করে আহত, এমন অনেকেও আসছেন।”
দেখা গেল, জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের ভর্তি করে পাঠানো হচ্ছে সার্জারি, অর্থোপেডিক ও নিউরোসার্জারি বিভাগে। এসব রোগীর ঠাঁই হচ্ছে ১০১, ১০২ ও ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে।
মঙ্গলবার ওই তিনটি ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, বেডে জায়গা না হওয়ায় মেঝে, বারান্দায় রাখা হয়েছে রোগী। স্থান সংকুলান না হওয়ায় কিছু রোগী পাঠানো হয়েছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। এত রোগীর ঢল যে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। রোগীদের চিৎকার, কান্নায় ওয়ার্ডগুলোর পরিবেশ ভারি হয়ে আছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের মেঝেতে শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন গোপালগঞ্জের হাফিজুর রহমান। তিনি নারায়ণগঞ্জের মদনপুর এলাকায় রিকশা চালান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে শুনে মদনপুর থেকে যাত্রাবাড়ী হয়ে গোপালগঞ্জ যাচ্ছিলেন। বিকাল ৫টার দিকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংর্ঘষের মাঝখানে পড়ে যান। এ সময় তার পেটে গুলি লাগে।
“গুলি পেটের একপাশ দিয়ে ঢুইকা আরেক দিক দিয়া বাইর হইয়া গেছে। পরে কিছু পোলাপান হাসপাতালে নিয়া আসছে আমারে। বাড়ির কেউ আসতে পারে নাই। আমি গরিব মানুষ, কই যামু, কী করমু; কিছুই বুঝতে পারতেছি না।”
নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি এলাকা থেকে পেটে, কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে এসেছেন সাফায়েত ইসলাম নামে এক কিশোর।
সাফায়েতের মা সুমনা বলেন, “জালকুড়ি আমার বাবার বাড়ি, বেড়াইতে আসছিলাম। পেটে গুলি লাগছে, বুকের হাড় ভেঙে গেছে। এখনও গুলি বের করতে পারে নাই। আমার পোলার ভবিষ্যৎ কী, জানি না।”
পুরান ঢাকার আগামাসি লেইনে থাকেন শাহাদাত হোসেন। সোমবার দুপুরে চানখাঁরপুল এলাকায় মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন বায়তুল মোকাররম এলাকায় ফুটপাতের দোকানের এই কর্মচারী।
শাহাদাতের বন্ধু আরিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এইখানে মিছিলে অনেক লোক আসছিল। পুলিশ গোলাগুলি শুরু করলে একটা গুলি শাহাদাতের পেটে লাগে। আমিও সাথে ছিলাম, ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসছি।”
সোমবার বিকালে যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন আবুল বাশার নামে একজন। বাশারের ভাবি ফারজানা শেখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের বাসা যাত্রাবাড়ীতেই। শেখ হাসিনার পদত্যাগ করার খবর পেয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। সেখানে পুলিশ গুলি শুরু করলে তার পেটে লাগে।”
১০২ ওয়ার্ডের একজন চিকিৎসক নামপ্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোগীর অনেক চাপ। একটা বেডে দুইটা-তিনটা রোগী, ফ্লোরেও রোগী। আমাদের নাকে-মুখে অবস্থা।”
মঙ্গলবার ২৫ বেড রোগী ধারণক্ষমতার ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে মঙ্গলবার রোগী ভর্তি ছিলেন ৫৭ জন, তাদের ৫০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ। ১০২ নম্বর ওয়ার্ডেও মঙ্গলবার রোগী ভর্তি ছিলেন ৫৮ জন, তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ৩৬ জন। মঙ্গলবার সকালেও ছয়জন রোগী এসেছেন ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে, তাদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ।
গত কয়েকদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন এমন কোনো রোগী ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে ছিল না। সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ ১৩ রোগীকে সেখানে ভর্তি করা হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, “মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১৭০০ জনের বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছে হাসপাতালে। এর মধ্যে সোমবার সবচেয়ে বেশি রোগী এসেছে। হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে ২৯২ জনকে।
“বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরুর পর প্রথম দিকে আহতদের মধ্যে ছাত্র বেশি হলেও পরে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ আহত হয়ে আসতে থাকেন। আহতদের মধ্যে বুলেট ইনজুরির রোগী ছিল। কিছু রোগী এসেছে নাক, কান, গলা ও চোখের ইনজুরি নিয়ে।”
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “কোটা আন্দোলনের পর থেকে এ পর্যন্ত যত রোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন তাদের অর্ধেকের বেশিই গুলিবিদ্ধ ছিল। সময় গড়ানোর সঙ্গে বেড়েছে গুলিবিদ্ধ রোগীর সংখ্যাও।
“প্রথম দুই-তিন দিন যারা আসছিল তাদের মধ্যে বুলেট ইনজুরি কম ছিল। আমরা এমনিই ট্রিটমেন্ট দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। এরপর থেকে যারা আসছেন তাদের মধ্যে বুলেট ইনজুরি বেশি। গতকালও (সোমবার) যেটা দেখলাম বুলেট ইনজুরি বেশি আসছে। মোটামুটি ৫০ শতাংশ বা তার বেশি রোগী বুলেট ইনজুরি নিয়ে আমাদের এখানে এসেছে।”
দুই দিনে ঢাকা মেডিকেলে ৫৯ মরদেহ
গণআন্দোলনে সরকার পতনের প্রেক্ষাপটে ঢাকার থানাকেন্দ্রিক ও বিভিন্ন এলাকায় চলা সহিংসতায় ক্রমেই বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেককে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। কয়েকজন হাসপাতালে আনার পর মারা গেছেন।
মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মরদেহ এসেছে ২১টি।
ঢাকা মেডিকেলের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. বাচ্চু মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নতুন করে ২১ জনের মরদেহ রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪ জন পুলিশ ও একজন বিজিবি সদস্যের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে এখনও ৭ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।”
সোমবার যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৩ জনের মরদেহ এসেছে যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে।