দাম যা-ই হোক, খোঁজাখুঁজি করলে কোনো দুষপ্রাপ্য ওষুধও হয়তো মিলবে দেশের সবচেয়ে বড় ওষুধের বাজার মিটফোর্ডে। কিন্তু রাত দুপুরে জরুরি দরকার পড়লে একমাত্র ভরসা লাজ ফার্মা। অলিগলিতে ছোট-বড় অসংখ্য ওষুধের দোকানের ভিড়ে একেবারে আলাদা সত্তা নিয়ে টিকে আছে নামটি। মানুষের মনে তৈরি করেছে আস্থা ও ভরসার স্থায়ী আসন। রাজধানীতে ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকা ওষুধের একমাত্র দোকান লাজ ফার্মার প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ লুতফর রহমানের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন টিটু দত্ত গুপ্ত ও মাসুদ রুমী।
-প্রায় চার দশক লেগেছে আস্থার এ শক্ত ভিতটি গড়তে। প্রকৃত অর্থেই ২৪ ঘণ্টা খোলা ওষুধের দোকান বলতে কলাবাগানের লাজ ফার্মাকেই বোঝে ঢাকা শহরের মানুষ। দোকানটির এ পরিচয়ের কথা ইতিমধ্যে জেনেছে অন্য শহরের হাসপাতাল, ওষুধ ব্যবসায়ী, আর মুমূর্ষু রোগীর উদ্বিগ্ন স্বজনরা। দিন-রাতের যেকোনো সময় ফোনে অর্ডার নেওয়া হয়, ক্যুরিয়ার সার্ভিসে সে ওষুধ পেঁৗছে যায় ঢাকার বাইরের গন্তব্যে।
লাজ ফার্মা কেবল একটি ওষুধের দোকান নয়। এখন এটি দেশি-বিদেশি মানসম্পন্ন ওষুধের একটি বাজার। ১০টিরও বেশি কাউন্টারে ১৪৮ কর্মী প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ক্রেতাকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ওষুধ ছাড়াও রয়েছে ফুড সাপ্লিমেন্ট, হার্বাল মেডিসিন, মেডিক্যাটেড হেয়ার শ্যাম্পু বা প্রসাধনীর আলাদা আলাদা কর্নার।
শুরুটা হয়েছিল আর দশটা ওষুধের দোকানের মতোই। জীবিকার সন্ধানে মোহাম্মদ লুতফর রহমান যশোর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন স্বাধীনতার দুই সপ্তাহ পর। ১৯৭২ সালের পহেলা জানুয়ারি। সঙ্গে নববিবাহিত স্ত্রী, আর আড়াই শ টাকা।
‘যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সদ্য স্বাধীন দেশটিতে তখন ভয়াবহ অরাজকতা। প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ওষুধের বাজারে তখন চরম নৈরাজ্য। দুই টাকার ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ২৪ টাকায়। এ কেমন পরিস্থিতি! দেশে ওষুধের উৎপাদন নেই, সরবরাহ অনিয়মিত। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য জরুরি যে জিনিস, তা নিয়ে এমন অরাজকতা দেখে খারাপ লাগল। মনে মনে ঠিক করলাম, ওষুধের ব্যবসা করব, এ ব্যবসায় একটা সুস্থ ধারা তৈরি করব। প্রথম থেকেই নিয়ত করেছিলাম সৎ থাকব, আজ পর্যন্ত তা বজায় রাখতে পেরেছি।’
বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে কথাগুলো বললেন লুতফর রহমান। তাঁর বিশ্বাস, ৩৯ বছর ধরে যে সততার চর্চা করেছেন, তারই ফসল আজকের লাজ ফার্মা। বললেন, ‘বাংলাদেশে ভালো মানের কোনো ওষুধ চালাতে হলে লাজ ফার্মাকে লাগবে। ওষুধের খোঁজে কোথাও যেতে হয় না আমাদের। প্রতিদিন সকালেই ওষুধ কম্পানির ৪০-৫০ রিপ্রেজেনটেটিভ দোকানে এসে ওষুধ দিয়ে যান। বিদেশি ওষুধও আমদানিকারকরা পেঁৗছে দিয়ে যান।’ লাজ ফার্মায় নিম্নমানের ভেজাল ওষুধ ঢোকার কোনো সুযোগই নেই বলে দাবি করলেন লুতফর রহমান। ‘ভেজাল ওষুধ যারা তৈরি বা বিক্রি করে তারাও সচরাচর এখানে আসে না। কারণ তারা জানে এখানে এসব ওষুধের স্থান নেই। আর আমরাও যাচাই করে দেখি। আমরা বেছে বেছে মানসম্পন্ন ভালো কম্পানির ওষুধ রাখি। তা ছাড়া, দীর্ঘদিন ওষুধের ব্যবসায় আছি। আমরা দেখলেও চিনতে পারি কোনটা ভেজাল। আমার মনে হয় ওষুধের সব ব্যবসায়ীই তা পারে। যারা ভেজাল ওষুধের ব্যবসা করে তারা জেনেশুনেই তা করে।’
আমদানি করা ওষুধের গড়পড়তা মান ভালো বলেই ধরে নেন তিনি। কারণ, নূ্যনতম মান বজায় রেখেই সংশ্লিষ্ট দেশ ওষুধটি রপ্তানি করছে। এখানে ড্রাগ অ্যাডমিনস্ট্রেশনেও মান যাচাই করা হয়। ‘মানের ক্ষেত্রে নয়, সমস্যা হয় দাম নিয়ে। অনেক সময় ইম্পোর্টাররা সাপ্লাই বন্ধ করে দাম বাড়িয়ে দেয়, মানুষকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ চড়াদামে কিনতে বাধ্য করে।’
দেশি ওষুধের মানের ব্যাপারেও তাঁর উঁচু ধারণা। গর্ব করে বলেন, ‘বাংলাদেশের ওষুধ এখন পৃথিবীর ৮০টিরও বেশি দেশে যাচ্ছে। বড় কম্পানিগুলো সাধারণত নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করে না। কারণ প্রতিযোগিতা আছে। সুনাম নষ্ট হলে দেশ-বিদেশে বাজার হারানোর ঝুঁকি আছে।’ যেসব ওষুধ দেশে তৈরি হয়, সেগুলোর আমদানি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে সরকার। ফলে দেশে এখন আমদানির বিকল্প অনেক ভালো ওষুধ তৈরি হচ্ছে। রোগীরা সেগুলো পাচ্ছে অনেক কম দামে। দেশি সেসব ওষুধের বাজার তৈরিতেও প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে লাজ ফার্মা। কানাডার মতো কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে চিকিৎসার খরচ বহন করে সরকার। স্বাস্থ্যবীমা আছে সেসব দেশে, বিল জমা দিলেই চিকিৎসা বা ওষুধের খরচ উঠিয়ে নেওয়া যায়। তাই সেখানে রোগীরা ওষুধ কিনতে কার্পণ্য করে না। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সব ওষুধ কিনে নেয়, পুরো কোর্স শেষ করে। আমাদের দেশের খুব কম মানুষই প্রেসক্রিপশনের সব ওষুধ একসঙ্গে কেনে। তারা টাকার হিসাব করে ওষুধ নেয়। প্রেসক্রিপশন হারিয়ে ফেলে, অথবা দোকানে আনে না। মুখে মুখে নাম বলে ওষুধ কিনে নিয়ে যায়। খামখেয়ালিপনা বা আর্থিক কারণে অনেকেই ওষুধের পুরো কোর্স শেষ করে না। তাই প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধ করার সময় বাংলাদেশে এখনো আসেনি বলে মনে করেন লুতফর রহমান। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার জন্য ডাক্তারদের বাধ্য করা উচিত। একশ্রেণীর ডাক্তার নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ওষুধ বিক্রি করার জন্য কম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। ওষুধের ব্র্যান্ড নামে লিখে কম্পানি থেকে মাসোহারা পান। অনেক অপ্রয়োজনীয় ফুড সাপ্লিমেন্ট তাঁরা গছিয়ে দিচ্ছেন নিরীহ রোগীদের। আর চেম্বারে বসেই সে টাকার ভাগ গুনে নিচ্ছেন। ওষুধ কম্পানির টাকায় কেনা আসবাবপত্রে সাজানো হয় তাদের চেম্বার, বাসা।
প্রেসক্রিপশনে ব্র্যান্ড নাম লেখা নিষিদ্ধ করলেই এ ধরনের অনৈতিক ব্যবসা বন্ধ হবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি। বিশাল অঙ্কের ফালতু খরচ থেকে তখন বেঁচে যাবে ওষুধ কম্পানিগুলো। সে টাকা তারা ওষুধের গবেষণায় বা মান উন্নয়নে ব্যয় করতে পারবে। ওষুধের দামের ক্ষেত্রেও ছাড় দিতে পারবে, যাতে সরাসরি উপকৃত হবে দেশের গরিব মানুষ।
ওষুধের বাজারে নৈতিকতা বজায় রাখার, সঠিক দামে মানসম্পন্ন ওষুধ রোগির কাছে পেঁৗছে দেওয়ার দায়িত্ব কেবল ব্যবসায়ীদের নয়। এটি ওষুধ কম্পানি, ড্রাগ অ্যাডমিনস্ট্রেশন, আমদানিকারক, ডাক্তার সবার দায়িত্ব। তারা সবাই দায়িত্ব পালন করছে কি না, সে হিসাব করে নিজের দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতা থেকে তিনি বিচূ্যত হননি বলে জানালেন লুতফর রহমান। ‘ইচ্ছে করলে তো আমরা সারা ঢাকা শহরেই শাখা খুলতে পারতাম। কিন্তু তখন সেবার মান বজায় রাখতে পারতাম না। তবু শহর বড় হচ্ছে দেখে, টাফ্রিক জ্যামের অবস্থা আর মানুষের যাতায়াতের সমস্যার কথা মাথায় রেখে আমরা তিনটি শাখা খুলেছি। তবে ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে শুধু কলাবাগানের মূল দোকান।’
ফার্মগেট, যাত্রাবাড়ীসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ‘২৪ ঘণ্টা সেবা’ চালুর চেষ্টা করেছে কয়েকটি ওষুধের দোকান। কিছু কিছু হাসপাতালেও ‘২৪ ঘণ্টা খোলা’র সাইনবোর্ড ঝুলানো আছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেসব উদ্যোগের ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। বছরের পর বছর অপেক্ষা করে মানুষের আস্থার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ধৈর্য রাখতে পারেনি তাদের অনেকেই। তাই আক্ষরিক অর্থেই ২৪ ঘণ্টা খোলা ওষুধের দোকান একটিই, লাজ ফার্মা।
বাংলাদেশে ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার ঝক্কির কথাও বললেন লুতফর রহমান। তিনি জানান, নিরাপত্তাজনিত সমস্যার কথা। রাতে অনেক সময় ড্রাগ এডিক্টরা আসে। ঘুমের ওষুধ চায়। না দিলে চেঁচামেচি করে, হুমকি দেয় কর্মীদের। রাতের বেলা ডিউটি শেষ করে যাওয়ার সময় সমপ্রতি একজন কর্মীকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিল নেশাকারীদের একটি দল। টহল পুলিশ তাকে বাঁচিয়েছে।
২৪ ঘণ্টার দোকান হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যাওয়ায় বাড়তি সুবিধা রয়েছে লাজ ফার্মার। অবস্থানগত কারণে এমনিতেই পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ নজর থাকে এ এলাকায়। ‘২৪ ঘণ্টা সেবা’র নতুন কোনো দোকানের ক্ষেত্রে এ সুবিধাগুলো পাওয়া কষ্টকর হবে। দিনে রাতে খোলা রাখলে ট্যাঙ্ও দ্বিগুণ ধার্য করা হয়।
লুতফর মনে করেন, ওষুধের ব্যবসার সঙ্গে অন্য ব্যবসার তুলনা চলে না। এখানে নৈতিকতা, মানবিকতা জড়িত। শুধু লাভের নয়, সেবার মানসিকতার থাকতে হবে বলে মনে করেন তিনি।’ ভেনটোলিন ইনহেলারের সাপ্লাই যখন কমে যায়, দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ, শ্বাসকষ্টের জরুরি রোগীরা যখন যেকোনো দামেই এটি কিনতে বাধ্য, লাজ ফার্মায় তখনো এ ওষুধ স্বাভাবিক দামেই বিক্রি হয় স্টকের সর্বশেষ ফাইলটিও। প্রেসক্রিপশন নিয়ে যারা ওষুধের দোকানে আসেন, তাঁরা তো অসহায়। পরিবারের অসুস্থ কারো জন্য ওষুধ নিতে এসেছেন, অথবা নিজেরাই রোগী। সেবার মানসিকতা নিয়েই তাঁদের গ্রহণ করতে হবে। খারাপ ব্যবহারের কোনো অভিযোগ পেলে তার চাকরি থাকবে না।
বিদেশে ফার্মেসিতে মানুষ হাতে সময় নিয়ে ঢোকে। একটা প্রেসক্রিপশনের ওসুধ খুঁজে প্যাকেট করে বিল পরিশোধ করতে গড়ে ১৫ মিনিট সময় লাগে সেখানে। তবে আমাদের দেশে ক্রেতাদের তাড়া একটু বেশিই। সেটি মাথায় রেখেই হাসিমুখে তাদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে লাজ ফার্মার কর্মীরা। শুরুরও শুরু আছে। ১৯৭২ সালে ঢাকায় এসেই তো আর ওষুধের দোকান দেননি লুতফর রহমান। মাসে ২২০ টাকা বেতনে একটি চাকরিতে ঢুকেছিলেন। কিছু দিন পর তা ছেড়ে দিয়ে বশিরউদ্দিন রোডের এক ডাক্তারের চেম্বারে ওষুধ সরবরাহ করার সাব-কন্ট্রাক্ট নেন। সেই ডাক্তার সরকারি কারখানায় ওষুধ সরবরাহ করতেন। হেঁটে, সাইকেলে চড়ে দোকানে দোকানে ঘুরে ওষুধ সংগ্রহ করে ডাক্তারের দোকানে দিতেন। প্রথমে আয় ছিল দিনে ৩০ থেকে ৪০ টাকা, কয়েক দিনের মধ্যে তা গিয়ে দাঁড়াল ৩০০ টাকায়। ব্যাংকেও জমতে থাকল টাকা, কলাবাগান প্রথম লেনের মুখে লাজ ফার্মার গোড়াপত্তন করার পুঁজিও তৈরি হয়ে গেল একসময়। তাঁর জীবনীমূলক বই ‘জীবনধারা’তে তিনি নিজেই এসব কথা লিখেছেন।
চার দশক পর সেই লাজ ফার্মায় এখন দিনে কত বিক্রি হয়, পুঁজি কত দাঁড়িয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে বিল গেট্স কিংবা ওয়ারেন বাফেট হয়তো গড়গড় করে বলে দিতেন বিলিয়ন ডলারের হিসাব। কিন্তু লুতফর রহমান সতর্ক হয়ে গেলেন। যেমনটি হন বাংলাদেশের ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী। কারণটাও খোলসা করে বললেন কানাডায় ১০ বছর কাটিয়ে আসা বাংলাদেশের এ ব্যবসায়ী। ‘জানেন-ই তো এ দেশের বাস্তবতা। ট্যাঙ্রে ঝামেলা আছে। এখানে তো সেল্সের ওপর ট্যাঙ্ ধরে, প্রফিটের ওপর নয়।’ ট্যাঙ্ েগোঁজামিল দেওয়ার কথাও অকপটে স্বীকার করে তিনি বললেন, ‘আমি তো প্রচুর ট্যাঙ্ দিতে চাই। তারাই তো নিতে জানে না। অবাস্তব মনগড়া একটা হিসাব দেয়।’
তবে ক্রেতাদের তিনি কখনো ঠকান না বলে জানালেন। নূ্যনতম লাভ রেখে ওষুধ বিক্রি করেন, তিন শতাংশ ডিসকাউন্ট দেন ক্রেতাদের, কখনো কখনো আরো বেশি। সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে একটি আধুনিক চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। এ লক্ষ্যে সাভারের হেমায়েতপুরে পাঁচ বিঘা জমি কিনেছেন। বিদেশ থেকে আধুনিক যন্ত্রপাতি আনা হবে। মানবিক গুণসম্পন্ন ভালো চক্ষু বিশেষজ্ঞের খোঁজ করা হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যেই হাসপাতাল চালু করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তিনি।
‘আমার সারা জীবনের সব আয় এ হাসপাতালকে দিয়ে যাব। এখানে খুবই অল্প খরচে চোখের উন্নতমানের চিকিৎসা পাবে দেশের সাধারণ মানুষ।’ ১৯৯২ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত কানাডায় ছিলেন লুতফর রহমান। সেখানে সপরিবারে বসবাস করেছিলেন। বাংলাবাজার নামে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরও চালিয়েছিলেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াও শেষ হয়েছে কানাডায়। তাঁর অবর্তমানে দোকানটি আগলে রেখেছিল আনোয়ার নামে বিশ্বস্ত একজন কর্মী। এখনো তিনি পুরো ব্যবসার মধ্যমণি। লুতফর রহমান তাঁকে ছেলের মতোই দেখেন। কানাডা থেকে ফিরে এসে জানাব লুতফর লাজ ফার্মার আরো বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। স্বল্প পরিসরে যতখানি সম্ভব দিয়েছেন আধুনিকতার ছোঁয়া। লাজ ফার্মাকে এনে দাঁড় করিয়েছেন আজকের এ অবস্থায়।
পাট ব্যবসায়ী বাবা চেয়েছিলেন ছেলে পাটের একজন বড় রপ্তানিকারক হবেন। কিন্তু পাট ব্যবসা তাঁর ভালো লাগেনি। তবে ব্যবসায়ী তো তিনি হয়েছেনই। বাংলাদেশের একক বৃহত্তম ওষুধের দোকানটি তাঁর। এটিকে ওষুধের একটি পরিপূর্ণ সুপার স্টোর হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছে ছিল তাঁর। এখানে স্থানাভাবে তা হয়ে ওঠেনি। এটুকুই শুধু অপূর্ণতা। আজ ৬১ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে জীবনের হিসাব মিলিয়ে পরিতৃপ্ত লুতফর রহমান। তাঁর প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান লাজ ফার্মার নামের সঙ্গে মিশে আছে মেয়ে লাইজু আর ছেলে জয়ের নাম। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গেই বেড়ে উঠেছে তাঁর দুই সন্তান। মেয়ে কানাডায় প্রতিষ্ঠিত। আর ছেলে টরন্টোয় গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বাবার প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছেন। প্রতিষ্ঠানটিও এত দিনে দাঁড়িয়ে গেছে, অনেকটা যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলছে রাতদিন ২৪ ঘণ্টা। পরিবারের, ব্যবসার সব সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছেন লুতফর রহমানের সহধর্মিণী সৈয়দা মাহফুজা রহমান মীনা, লেক সার্কাস গার্লস হাইস্কুলের সাবেক শিক্ষিকা। এরমধ্যে লেখালেখিতেও হাত পাকিয়েছেন লুতফর রহমান। রহমান মোহাম্মদ লুত্ফর নামে লিখেন তিনি। গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী মিলিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ এবারের বই মেলায় তাঁর ‘সোনার মেডেল’ বইটি বের হয়েছে। ‘আমার নিয়ত ছিল, কামিয়াব হয়েছি। এখন আমার কাজ নেই। লেখালেখি করেই কাটিয়ে দিতে চাই বাকি সময়।’ কলাবাগানে নিজবাড়ির অফিসকক্ষে বসে কথাগুলো যখন বলছিলেন, তখন রাত প্রায় ১১টা। নাতিদের একজন কাঁচের দরজায় উঁকিঝুঁকি মারছিল। সাদা ফতুয়া পরা, চলনে বলনে সাদামাটা লুতফর রহমানের অবয়বেও যেন তখন উঁকি মারছিল যশপ্রার্থী এক লেখক সত্তা, চার দশকের ব্যবসায়ী সত্তা ছাপিয়ে।
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ