পবিত্র রমজানে মুসলমানমাত্রই রোজা রাখতে চান। কিন্তু ডায়াবেটিসের রোগীরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন, রোজা রাখতে পারবেন কি না বা বিশেষ কোনো সতর্কতা আছে কি না। কারণ, তাঁদের খাবারদাবার সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল হওয়া চাই।
কিছু বিশেষ সতর্কতা, নিয়ম আর শৃঙ্খলা মেনে চললে বেশির ভাগ ডায়াবেটিসের রোগীই নিশ্চিন্তে রোজা রাখতে পারেন। ডায়াবেটিসের রোগীদের ঝুঁকির মাত্রার ওপর ভিত্তি করে তাঁদের চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। লো রিস্ক, মডারেট রিস্ক, হাই রিস্ক এবং ভেরি হাই রিস্ক গ্রুপ।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা, ওষুধ সেবন বা ইনসুলিন গ্রহণের মাধ্যমে যাঁদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে, তাঁরা লো রিস্ক এবং মডারেট রিস্ক গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। অতি বয়স্ক, কিডনির জটিলতায়, স্বল্পমেয়াদি অন্য অসুস্থতায় আক্রান্ত, বারবার রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়ার প্রবণতা, হার্ট অ্যাটাক ও মস্তিষ্ক রক্তক্ষরণের (স্ট্রোক) শিকার ডায়াবেটিসের রোগীদের হাই ও ভেরি হাই রিস্ক গ্রুপে ফেলা হয়েছে। লো রিস্ক ও মডারেট রিস্ক গ্রুপের ডায়াবেটিসের রোগীরা রোজার শুরুতে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে কোনো প্রকার জটিলতা ছাড়াই রোজা রাখতে পারেন। অন্যদিকে হাই ও ভেরি হাই রিস্ক গ্রুপের লোকদের রোজা রাখতে হলে চিকিৎসকের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থেকেই রাখতে হবে।
https://www.youtube.com/watch?v=If68pXyV_90
রোজা পালনে ঝুঁকিপূর্ণ কারা
* অতি বৃদ্ধ বা ভগ্ন স্বাস্থ্যের রোগী।
* গত তিন মাসের মধ্যে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা অতিরিক্ত কমে (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) বা অধিক বেড়ে গিয়ে কিটো অ্যাসিডোসিস বা হাইপার অসমোলার স্টেট হওয়ার ইতিহাস রয়েছে।
* ঘন ঘন রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়ার প্রবণতা।
* হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলেও টের পান না যাঁরা।
* অনিয়ন্ত্রিত টাইপ ১ ডায়াবেটিস বা দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত টাইপ ২ ডায়াবেটিস।
* গর্ভকালীন ডায়াবেটিস।
* দীর্ঘমেয়াদি কিডনি জটিলতা (স্টেজ ৪ ও ৫) বা ডায়ালাইসিসের রোগী।
* হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের রোগী।
* দিনে একাধিকবার ইনসুলিন গ্রহণ করেন যাঁরা।
* মারাত্মক সংক্রমণ, যক্ষ্মা, ক্যানসার ইত্যাদি থাকলে
তা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি কিডনি জটিলতা (স্টেজ-৩), স্থিতিশীল হৃদ্রোগ বা স্ট্রোক, স্তন্যদাত্রী মা, অধিক কায়িক পরিশ্রমকারী ডায়াবেটিসের রোগীদের রোজা রাখার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
সচেতন না থাকলে রোজার সময় ডায়াবেটিস রোগীর কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন রক্তে চিনির স্বল্পতা বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া, রক্তে চিনির আধিক্য বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া, ডায়াবেটিস কিটো অ্যাসিডোসিস এবং পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন।
খাবার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা
পবিত্র রমজানে খাবার খাওয়ার সময়সূচি পরিবর্তিত হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তিত হবে ওষুধ বা ইনসুলিনের সময়সূচি ও মাত্রা। এর মধ্যে কোনো অসামঞ্জস্য হলে রক্তে শর্করার মাত্রা কমে বা বেড়ে যেতে পারে। এ জন্য রমজান মাসে রোজা রাখার জন্য ডায়াবেটিসের রোগীদের দরকার প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ।
ওষুধ ও ইনসুলিন
* রমজান শুরুর আগেই ওষুধের মাত্রা (ডোজ) ও সময়সূচি সমন্বয় করে নিন।
* চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনবারের ওষুধ এক বা দুইবারে পরিবর্তন করে আনুন।
* যাঁরা বড়ি খান, তাঁরা সকালের ডোজটি ইফতারের শুরুতে এবং রাতের ডোজটি অর্ধেক পরিমাণে সাহ্রির আধা ঘণ্টা আগে খাবেন।
* সকালের ইনসুলিন ডোজটি ইফতারের আগে, রাতের ডোজটি কিছুটা কমিয়ে সাহ্রির আধা ঘণ্টা আগে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নেবেন।
হাঁটা ও ব্যায়াম
রোজা রেখে দিনের বেলায় অধিক হাঁটা বা কায়িক পরিশ্রম না করাই ভালো। ইফতারের ১ ঘণ্টা পর বা তারাবিহর পর নির্ধারিত হাঁটা বা ব্যায়াম করা যেতে পারে। দীর্ঘ সময় নিয়ে তারাবিহ আদায় ব্যায়ামের বিকল্প হিসেবে কাজ করে।
ডায়াবেটিস পরীক্ষা
রোজা রাখা অবস্থায় যেহেতু রক্ত পরীক্ষায় কোনো বাধা নেই, তাই সাহ্রির বা ইফতারের ২ ঘণ্টা পর ও বিকেলে অথবা খারাপ লাগলে দিনের যেকোনো সময় ডায়াবেটিস পরীক্ষা করবেন।
দিনের যেকোনো সময় রক্তের গ্লুকোজ ৪ মিলি মোল/লিটার বা তার কম অথবা ১৬.৭ মিলি মোল/লিটার বা তার বেশি হলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
মনে রাখবেন
* রোজা রেখে কখনই আগের মাত্রার ওষুধ বা ইনসুলিন নেবেন না। নিজে নিজে ডায়াবেটিসের ওষুধ সমন্বয় করবেন না, এতে জটিল পরিণতি হতে পারে।
* সাহ্রির নির্ধারিত সময়ের শেষভাগে ও মাগরিবের আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাবার গ্রহণ করুন।
* রমজান মাসে দৈনিক ক্যালরির মাত্রা ঠিক রেখে শুধু খাদ্য উপাদান ও সময় পরিবর্তিত হবে।
* ইফতারে অতিভোজন বা সাহ্রিতে স্বল্পভোজন থেকে বিরত থাকুন।
* রোজা রাখা অবস্থায় ইনসুলিন নেওয়া যায়। তাই ইফতারের নির্ধারিত সময়ের ১০-১৫ মিনিট আগে ইনসুলিন গ্রহণ করুন।
* সাহ্রিতে কোনো অবস্থাতেই না খেয়ে বা সামান্য কিছু খেয়ে রোজা রাখবেন না।
লেখক: ডা. এ হাসনাত শাহীন
কনসালট্যান্ট, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও হরমোন রোগ বিভাগ
ইমপালস হাসপাতাল, তেজগাঁও, ঢাকা।