‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ এমনটি পৃথিবীর যে-কোনো মা-বাবা’র জন্য চিরন্তন সত্য কথা। অতি আদর, যত্ন আর সোহাগে লালিত সন্তানের চোখ দিয়ে মা-বাবা দেখতে পান ভবিষ্যৎ সফলতা, উজ্জ্বলতা আর সাহসিকতার স্বপ্ন।
এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে যেয়ে বর্তমান প্রতিযোগিতাময় যুগের মা-বাবা’রা সন্তানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন এক গাদা বই-খাতা আর স্কুলে সন্তানকে পাঠাবার সময় বলে দেয়া হয় ‘তোমাকে ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে’। শুধু পড়াশুনাই শেষ নয়, শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের জন্য যে সকল কর্মকাণ্ড দরকার সেখানেও বেঁধে দেয়া হলো নিয়ম; যেমন : ‘বৃহস্পতিবার স্কুল থেকে ফিরে এক ঘণ্টা কার্টুন দেখবে’ অথবা ‘শুক্রবার বিকেলে একঘণ্টা ক্রিকেট খেলবে’। অবুঝ মা-বাবা শিশুর কোমল, নিপুন মস্তিষ্কে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছেন সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু এ ধরনের চাপ একটি শিশুর মস্তিষ্কের সেরিব্রাল হেমিস্ফেয়ার কিংবা মেরুদণ্ডের স্পাইনাল কর্ড কতটা সহ্য করতে পারে? আর করতে পারলেও তার স্বকীয়তা নিয়ে প্রশ্ন জাগাটা খুব স্বাভাবিক।
এ ধরনের প্রশ্ন আর আশ্চর্য নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে Columbia University-র National Center of addiction and substance abuse-এ। তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল নিচে তুলে ধরা হলো-
তাদের গবেষণার হাইপোথেসিস ছিল এরকম-
“শিশুদের উপর অতিরিক্ত চাপ তাদেরকে মাদকাশক্তির দিকে ঠেলে দেয়”। এই ‘চাপ’ বলতে মানসিক, পড়াশুনা বিষয়ক, পারিবারিক, সামাজিক সব ধরনের চাপ বুঝানো হয়েছে।
১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলে মেয়েদের ভেতর যারা প্রায় একঘেয়েমী-তে থাকে তাদের মধ্যে পঞ্চাশ ভাগই ধুমপান, এলকোহল সেবন, মদ্যপান ইত্যাদিতে আসক্ত হয়।
চাপে থাকা ছেলেমেয়েদের যারা সপ্তাহে ২৫ মার্কিন ডলার বা তার বেশি খরচ করে তাদের মাদকাসক্ত হবার সম্ভাবনা প্রায় দ্বিগুণ।
কম চাপে থাকা শিশুদের চাইতে যারা বেশি চাপে থাকে এমন শিশুদের মাদকাসন্ত হবার সম্ভাবনাও প্রায় দ্বিগুণ। এ ধরনের চাপ ছেলেদের চাইতে মেয়েদের মাঝে বেশি (প্রতি তিন জন মেয়েদের মধ্যে প্রায় এক জন, আর প্রতি চার জন্য ছেলেদের মধ্যে এক এর চাইতে কম)।
এই গবেষণায় বাচ্চাদের জন্য সবচাইতে বেশি চাপ অনুভূত হয়েছে পড়াশুনার চাপ।
১২০০ ছাত্র-ছাত্রী বিশিষ্ট একটি স্কুলের বাচ্চাদের মাদকাসক্ত হবার প্রবণতা ৮০০ ছাত্র-ছাত্রী বিশিষ্ট একটি স্কুলের বাচ্চাদের চাইতে প্রায় দ্বিগুণ বেশি।
প্রথম এলকোহল সেবনের গড় বয়স ১২ বছর। সিগারেট আর মারিজুয়ানার জন্য সে বয়স যথাক্রমে সাড়ে বার এবং চৌদ্দ বছর।
এ সকল তথ্য সংগ্রহের পর National Center on Addiction and Substance Abuse-এর প্রেসিডেন্ট জোসেফ ক্যালিকেনো বললেন, ‘এটা মা-বাবাদের জন্য অশনী সংকেত। তাদের অবশ্যই বাচ্চাদের নিয়ে সতর্ক হওয়া উচিত- তারা কি করছে, কি করতে চাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে ইত্যাদি জানা উচিত’।
গবেষকদল তাদের সার্ভের জন্য এক হাজার নয়শত সাতাশি জন (বয়স ১২-১৭ বছর) এবং পাঁচশত চার জন অভিভাবকের (যাদের ভেতর ৪০৩ জনের ছেলে-মেয়েও রয়েছে) ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন।
এই গবেষণা থেকে তারা আরো হতাশাব্যাঞ্জক তথ্য পেয়েছেন। ৫৬% শিশুর বর্তমানে কোনো বন্ধু নেই যারা নিয়মিত ড্রিঙ্ক করে, ২০০২ সালে যে সংখ্যা ছিল ৫২%। মারিজুয়ানা এবং সিগারেটের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ২০০২ সালে যথাক্রমে ৬২% এবং ৫৬% ছিল যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৬৮% ও ৭০%।
এসকল তথ্য এবং গবেষণা শুধুমাত্র আমেরিকার শিশুদের এবং কিশোর-কিশোরিদের থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে হয়তো ঢাকা শহরের শিশুদের মাঝেও এধরনের আচরণ দেখতে পাওয়াটা খুব অস্বাভাবিক হবে না, কারণ প্রচণ্ড চাপে থাকতে হয় তাদের। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে ৭.৩০ টার দিকে দেখা যাবে এক ঝাক শিশু তাদের চাইতে বড় ব্যাগ কাঁধে নিয়ে যাচ্ছে স্কুলে। প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার জন্য মা-বাবারাও ভীষণ চাপের মধ্যে রাখছে বাচ্চাদের। আর যেখানে সেখানে যত্রতত্র গড়ে উঠা স্কুলগুলোতে শিশুদের খেলাধূলার জন্য নাই ছোট্ট একটা মাঠ-ঢাকার আকাশ এখন কালো ধোঁয়া আর সু-উচ্চ অট্টালিকায় ছেঁয়ে যাচ্ছে; আর ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিশুরা, তারা হারাচ্ছে তাদের সুনিপূণ স্বকীয়তা আর সে সাথে তাদের উপর বিভিন্ন ধরনের চা প তাদেরকে অন্য পথে যেতে বাধ্য করবে, যেমনটি করেছে আমেরিকার শিশুদের। তাই আমাদের সকলকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য।