চল্লিশ পেরোলেই চালশে-এমন একটি কথা বেশ প্রচলিত আছে। তবে প্রবীণ বয়সে নাকি এর আগেও চোখে ছানি পড়তে পারে? ছানির সমস্যা কখন হয়, হলে করণীয় কী এবং এর আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি কী? – এসব বিষয়ে কথা বলেছেন বিশিষ্ট চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ইফতেখার মো. মুনির। তিনি গ্লুকোমা বিশেষজ্ঞ, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
পরিচালক ও কনসালটেন্ট, বাংলাদেশ আই হসপিটাল।
প্রশ্ন : চোখে ছানি পড়ার কথা বলা হলে প্রথমেই মনে হয়, এটি একটি বয়স্ক লোকের হবে। এর বাইরেও কম বয়সীদের এটি হতে পারে কি না? ছানি জিনিসটি কী এবং কারা ঝুঁকিপূর্ণ?
উত্তর : চোখের ভেতরে একটি লেন্স থাকে, আপনি তো জানেন চোখ ক্যামেরার মতো। ক্যামেরার ভেতরে যেমন একটি লেন্স থাকে যার সাহায্যে একটা জিনিস ফোকাস হয়; চোখের ভেতরের এই লেন্সটির কাজ হলো আমরা যেটা দেখছি সেটি ফোকাস করা। ফোকাস করে রেটিনায় পড়ে। এই লেন্সের কোনো অংশ যদি ঘোলা হয়ে যায়, তাহলে ব্যক্তি দেখতে পাবেন না। এই রোগটি হলো চোখের ছানি।
প্রশ্ন : এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে কারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন?
উত্তর : প্রথম হলো বয়স। আপনি যেটা এরই মধ্যে বলেছেন, যাঁদের বয়স ৬০ বা এর বেশি, তাঁদের যেমন চুল পাকে, দাড়ি পাকে একইভাবে চোখের লেন্সটাও পাকতে শুরু করে। চোখের লেন্স ভেতরে ভেতরে ঘোলা হয়ে যায়। সেটাকে আমরা বলি ছানি। সুতরাং আমরা বলি ছানি বয়সের কারণেও হয়ে থাকে। এটাকে আমরা বলি সেনাইল ক্যাটারেক্ট।
প্রশ্ন : তবে এটা কি যেকোনো বয়সেই হতে পারে?
উত্তর : হতে পারে। তবে সাধারণত এটি ৬০ বছরের পরেই বেশি হয়। তবে যেকোনো বয়সে হলে একে আমরা প্রাইমারি ক্যাটারেক্ট বলছি না। এর কারণ থাকে। যেমন : একটি শিশুর মায়ের পেট থেকে জন্ম হতেই পারে ছানি নিয়ে। কারণ হয়তো গর্ভাবস্থায় মায়ের জ্বর হয়েছিল বা উনি এমন কোনো ওষুধ ব্যবহার করেছেন যে কারণে বাচ্চার চোখে ছানি হয়েছে। এরপর সবচেয়ে প্রচলিত হলো চোখের অ্যালার্জি। অনেক শিশু আমাদের কাছে আসে চোখের অ্যালার্জি নিয়ে। চোখ চুলকায়, লাল হয়ে যায়। আমরা একটি ওষুধ দিই, স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ। এই শিশুটি হয়তো ওষুধ ব্যবহার করে অনেকদিন ভালো থাকে। বাবা-মা মনে করেন এই ওষুধে বাচ্চা খুব ভালো আছে। তখন ওষুধ দিতে থাকে। হয়তো চিকিৎসক বলে দিয়েছে এক মাস। উনি হয়তো সেটা না মেনে এক মাসের পরেও ওষুধ দিয়েই যাচ্ছেন। তখন দেখা যায় এর কারণে ছানি হয়ে যায়। আমরা বলি সেকেন্ডারি ক্যাটারেক্ট।
আরেকটি হলো চোখের আঘাতজনিত কারণে। কোনো দুর্ঘটনায় হতে পারে, পড়ে ব্যথা পেলে হতে পারে। যে কোনো বয়সে হতে পারে।
আরেকটি বিষয় বলতে পারি, যাদের কিছু রোগ রয়েছে যেমন ধরেন ডায়াবেটিস। তাঁদের ছানি হওয়ার হার স্বাভাবিক লোকের তুলনায় ছয়গুণ বেশি। যাঁদের ডায়াবেটিস থাকে তাঁদের ৬০ বছরের আগেই, ৪০ বা ৫০ বছরে ছানি পড়ে যেতে পারে।urgentPhoto
প্রশ্ন : ছানি পড়লে একজন মানুষের কী সমস্যা হয়?
উত্তর : প্রথম সমস্যা হলো উনি দেখতে পাবেন না। তবে সাধারণত কোনো ব্যথা থাকে না। দৃষ্টি আস্তে আস্তে অস্বচ্ছ হয়ে যায়। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই দৃষ্টি কমতে থাকে। এটা ছানির স্বাভাবিক লক্ষণ।
প্রশ্ন : ছানি সমস্যা সমাধানের কী চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে?
উত্তর : ছানির চিকিৎসা একটি, কেবল অস্ত্রোপচার। চশমা দিয়ে হয়তো সাময়িকভাবে কিছুটা রোধ করা যায়। ওষুধ দিয়ে ছানির কোনো চিকিৎসা হবে না। আগে আমরা যেটি করেছি সেটি হলো আইসিসিই। চোখের ভেতর যেই লেন্স ঘোলা হলো, সেই পুরো লেন্সটাকে তুলে এনে ফেলে দিলাম। ১২০০ বা হাজার পাওয়ারের চশমা দিয়ে দিলাম। এটি ছিল একসময়ের চিকিৎসা। এখন তো মানুষ ভুলেই গেছে সেটা।
এখন যেটি করা হয়, সেটি হলো ফ্যাকো সার্জারি। যেটি আধুনিক চিকিৎসা। এখানে লেন্সটা পক্ব হওয়ার জন্য আমরা অপেক্ষা করি না। আমরা যদি দেখি একজন মানুষের ছানি পড়েছে, উনি স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছেন না, তখনই আমরা সার্জারি করি এবং ফ্যাকো সার্জারি একটি আধুনিক চিকিৎসা।
এর মধ্যেই একটি চিকিৎসা আছে ইনসেশন ক্যাটারেক্ট সার্জারি। এতে ফ্যাকো মেশিন লাগে না। তবে এটি ফ্যাকো মেশিনের মতো প্রায়ই আধুনিক একটি অস্ত্রোপচার। এখানে সেলাই করা লাগে না। খরচ অত্যন্ত কম। এটিও বাংলাদেশে হয় এবং এটি গ্রামাঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়। আর আধুনিক চিকিৎসায় সবচেয়ে ভালো হলো ফ্যাকো ইমালসিফিকেশন সার্জারি বা আমরা সংক্ষেপে বলি, ‘ফ্যাকো সার্জারি’।
প্রশ্ন : এতে আপনারা কী করে থাকেন?
উত্তর : আমরা যদি চোখের মডেলটা একটু চিন্তা করি, দেখবেন যে চোখ আকারে বেশ বড়; তার ভেতর লেন্সটা থাকে প্রায় ৯ মিলিমিটার। এই লেন্সকে আমরা যখন বের করব তখন উপায় কী? যদি ৯ মিলিমিটার ইনসেশন দিয়ে চোখ কাটি, তাহলে বের করা সম্ভব। আর ফ্যাকোতে আমরা একটি ছোট্ট দুই থেকে তিন মিলিমিটার টানেল ইনসেশন দিই। দিয়ে ফ্যাকোর যে টিপটা রয়েছে এটি একটি কলমের মতো, এটি চোখের ভেতর ঢোকে। এবং ফ্যাকো একটি আল্ট্রাসাউন্ড। এই আল্ট্রাসাউন্ড এনার্জির সাহায্যে লেন্সকে ভাগ করা হয়। প্রথমে দুই ভাগ, এরপর চার ভাগ, ছয় ভাগ, আট ভাগ- এভাবে ভাগ করা হয়।
ভাগ করে টুকরো টুকরো করে আমরা বের করে গলিয়ে নিয়ে আসছি। সুতরাং এই পথের ভেতর দিয়ে চলে আসছে। এরপর এই টানেলের ভেতর দিয়ে ভাঁজ করা যায় এমন একটি লেন্স আবার চোখের ভেতর বসিয়ে দিচ্ছি। শেষ পর্যন্ত কোনো সেলাই লাগছে না। এটি হলো আদর্শ ফ্যাকো সার্জারি।
প্রশ্ন : এই ফ্যাকো সার্জারিতে কী অজ্ঞান করার দরকার হয় বা রোগীরা ব্যথা পাবেন?
উত্তর : ভালো প্রশ্ন করেছেন। আজকাল আমরা এই কাজটি করি শুধুমাত্র চোখের ড্রপ দিয়ে বা জেল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে। আগে আমরা একসময় চোখের ইনজেকশন দিয়ে চোখকে অবশ করে নিতাম। তবে এটি এত ভালো পদ্ধতির হয়েছে, এখন রোগীর জন্য বিষয়টি খুব সহজ। সহজ একটি ওষুধ দিয়ে অস্ত্রোপচারটি করি আমরা। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে অস্ত্রোপচার হয়ে যায়। এটি করার পর আমরা সাধারণত কোনো ব্যান্ডেজ করি না। রোগী খালি চোখে চলে যাচ্ছেন, একটা কালো চশমা পরে। সুতরাং এটা আজকাল অনেক সহজ হয়েছে।
প্রশ্ন : কোনো মানুষের যদি দুই চোখেই ফ্যাকো করার প্রয়োজন পড়ে, আপনারা কি একবারে সেটি করেন?
উত্তর : করা সম্ভব। তবে করি না। কারণ জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমরা যে ওষুধ বা স্যালাইন ব্যবহার করছি সেটা যদি কোনো কারণে সংক্রামক হয় তাহলে যেন একটি চোখ অন্তত সুরক্ষিত থাকে। কোনো কারণে সমস্যা হলে যেন দুই চোখে একসঙ্গে অসুবিধা না হয়। এটা একটি বিরাট ব্যাপার। এ জন্য আদর্শগতভাবে কখনো একসঙ্গে দুই চোখ অস্ত্রোপচার করি না।
প্রশ্ন : দুটি সার্জারির মধ্যে কতদিনের বিরতি দিতে হবে?
উত্তর : একদিন পরেই অস্ত্রোপচার করা যায়। দ্বিতীয় দিনে যখন দেখলাম, উনি ভালো আছেন তখন সেদিন বা তৃতীয় দিন করতে পারি। তবে একদিনে করা হয় না।
প্রশ্ন : আমরা অনেক সময় সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাই, অমুক হাসপাতালে একদিনে অনেকগুলো সার্জারি হয়েছে। ছানির অস্ত্রোপচার হয়েছে এবং পরবর্তীতে চোখে সংক্রমণ হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দুর্ভাগ্যজনকভাবে অন্ধত্বের দিকে চলে যাচ্ছে। এটা হওয়ার কারণ কী? এটি রোধ করার জন্য আধুনিক এবং মানসম্পন্ন সার্জারি যাঁরা করেন তারা কী পদ্ধতি মেনে চলেন?
উত্তর : এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অনেক সময় সংক্রমণ হতে পারে। এর প্রথম কারণ হলো ওটিতে যদি সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করা না হয় এটি হতে পারে।
আরেকটি হলো যে স্যালাইনটি আমরা ব্যবহার করছি, যদি এর মধ্যে কোনো সংক্রমণ থাকে, আমরা তো জানি না, এটা তো বিদেশ থেকে আসছে। এর মধ্যে যদি কোনো সংক্রমণ হয় তাহলে হতে পারে। তৃতীয় হলো যেই যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহৃত হয়, সেটা যদি কোনো কারণে সংক্রমিত হয় তাহলে সংক্রমণ হতে পারে। এটাকে প্রতিরোধ করার জন্য আমরা যেখানে অস্ত্রোপচার করি সবগুলো অটোক্ল্যাপ করে নেই। এটি করার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো সংক্রমণ পাই না। যেখানে এই সমস্যাগুলো হয় সেখানে সাধারণত ওই ওষুধের মাধ্যমে হয় বা স্যালাইনের মাধ্যমে হয়। যেখানে চিকিৎসকদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না।
প্রশ্ন: সেই ক্ষেত্রে যদি সংক্রমণ দেখা যায় তাহলে কি শুরুতেই ওষুধ দিয়ে ভালো করা যায়?
উত্তর : অবশ্যই ভালো করা যায়। যদি আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে দেখতে পাই তার সংক্রমণ হচ্ছে, আজকাল ওষুধের মাধ্যমে এবং অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন চোখের মধ্যে দিয়ে ভালো করি। তাতেও ভালো না হলে চোখের ভেতর যে পানি আছে সেটি পরিষ্কার করে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। আজকাল ইনফেকশন হয়ে গেছে এ রকম অনেক কেস আমরা ঠিক করতে পেরেছি।
প্রশ্ন: সার্জারি করার পর রোগী তো বাসায় চলে যান। তবে রোগী কী রকম সমস্যা অনুভব করলে দেরি না করে, চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত?
উত্তর : উনি অস্ত্রোপচার করার পরের দিন থেকে চোখে ভালো দেখার কথা। যদি উনি কোনো কারণে ভালো না দেখেন বা তাঁর চোখ দিয়ে যদি পানি পড়ে, বা চোখটা লাল হয়ে যায় বা চোখে ব্যথা হয় বুঝতে হবে, কোনো ঝামেলা হচ্ছে। তখন অবশ্যই সে চিকিৎসকের কাছে চলে আসবেন।
প্রশ্ন: চোখের অনেক আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে এখন লেজারের একটি সম্পর্ক আছে। ছানির অস্ত্রোপচারে লেজারের ভূমিকা কী?
উত্তর: হ্যাঁ, আমরা এখন করছি। একে বলা হয় লেজার ক্যাটারেক্ট সার্জারি। আমরা আদর্শ সার্জারিতে চোখের ভেতরে যে কাটি, ভাগ করি সেটি এখন লেন্স করে দিচ্ছে। লেজার একটি কম্পিউটারের সাহায্যে অস্ত্রোপচার করে দিচ্ছে। একদম নিখুঁতভাবে করে দিচ্ছে। যে কারণে এর ফলাফল অত্যন্ত ভালো। এতে রোগীরা খুব খুশি। কারণ এর ফলাফল সাধারণ ফ্যাকো সার্জারির তুলনায় অনেক ভালো। এবং এটি বাংলাদেশে ভালোভাবে হচ্ছে, আমরাই করছি।