রোজার শেষে চলে এসেছে খুশির ঈদ। সবাই প্রিয়জনের সাথে ঈদ করতে বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। কেউ কেউ হয়ত দীর্ঘদিন পরে পুরো পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ী যাচ্ছেন। ঈদ ভ্রমণে আপনি ও আপনার পরিবার সুস্থ থাকতে প্রয়োজন পূর্ব প্রস্তুতি। আপনি আপনার ভ্রমণে অবশ্যই একটি আলাদা ওষুধের ব্যাগ সাথে রাখুন। আর সঙ্গে নিন স্বাস্থ্যসমস্যা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ।
এবার প্রশ্ন হল, ঘুরতে যাওয়ার সময় নিজের ব্যাগে ঠিক কোন কোন ওষুধগুলিকে জায়গা করে দিতে হবে? কি কি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং কি কি ঔষধ সাথে রাাখতে হবে তা নিয়েই আজকে আমাদের আলোচনা। আসুন জেনে নেওয়া যাক।
গ্যাসের ওষুধ : গ্যাসের ওষুধ বলতে আমরা সাধারণত আমরা সেই সব ওষুধ বুঝি যা আমরা পেট জ্বালা পোড়া করলে খেয়ে থাকি। যেমন- ওমিপ্রাজল, প্যানটোপ্রাজল, র্যাবিপ্রাজল, অ্যান্টাসিড ইত্যাদি। ঈদে বেশিরভাগ মানুষই ভাজাপোড়া খান। যা থেকে হতে পারে পেটের গ্যাস। তাই ভ্রমণের আগে অবশ্যই সাথে রাখুন গ্যাসের ওষুধ। শুধুমাত্র পেট জালাপোড়া করলেই কেবল গ্যাসের ওষুধ খেতে হবে। মনে রাখবেন মাত্রাতিরিক্ত গ্যাসের ওষুধ সেবন করা ক্ষতিকর, যা আপনার হাড় ক্ষয়েরও কারণ হতে পারে।
বমির ওষুধ : অনেকেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবেন। যা থেকে হতে পারে ’মোশন সিকনেস’ বা ‘যানবাহনের ঝাকুনির কারনে বমি’। রাস্তার মাঝখানে হয়তো ওষুধের দোকান পাবেন না। তাই সাথে অবশ্যই রাখুন বমির ওষুধ, যেমন- ডমপেরিডন। গর্ভবতী মায়েরা এটা বিশেষভাবে সাথে রাখবেন। এছাড়া ভ্রমণকালে যতটা পারেন কম খাওয়াদাওয়া করবেন এবং প্রচুর পরিমানে ফ্লুইড জাতীয় খাবার খাবেন।
ব্যথার ওষুধ : অনেকেই আছেন যারা কোমর ব্যথায় ভুগছেন। তাদের জন্য দীর্ঘ জার্নি করা মুশকিল। তাই সাথে রাখুন আপনার চিকিৎসক এর পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথার ওষুধ এবং মাসল রিলাক্সেন্ট। জেনে রাখা ভাল এইসব ওষুধ শুধুমাত্র চিকিৎসক এর পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে। উদাহরণ সরুপ – ন্যাপ্রোক্সেন, মায়োল্যাক্স ইত্যাদি। এছাড়াও যাদের কোমর ব্যথা আছে তারা অবশ্যই ভ্রমণের সময় লাম্বার করসেট বেল্ট ব্যাবহার করবেন। তাহলে আপনারা রাস্তার ঝাকুনির কারনে যেই কোমর ব্যথা হয় তা থেকে মুক্তি পাবেন। এছাড়া যাদের পায়ে বা গোড়ালিতে ব্যথা আছে তারা অবশ্যই ভ্রমণের সময় নরম জুতা কিংবা কেডস জুতা ব্যবহার করবেন। জুতা শক্ত হলে সিলিকন সোল বা হিল প্যাড ব্যবহার করতে পারেন, যা আপনাকে ভ্রমণের সময় আরাম দেবে।
সর্দি, কাশির ওষুধ : ঘুরতে গিয়ে সর্দি, কাশির ফাঁদে পড়লে অ্যান্টিঅ্যালার্জিক ওষুধ খেতেই পারেন। এই ওষুধগুলি কিন্তু এই সমস্যা সমাধানে অত্যন্ত কার্যকরী। যেমন- ফেক্সোফেনাডিন, সেট্রিজিন ইত্যাদি। সেই সঙ্গে নিয়মিত ভেপার নিন ও গার্গল করুন। তাহলেই এই সমস্যা থেকে দ্রুত মুক্তি পাবেন। চেস্টা করবেন বেশি রোদে না যেতে এবং যতটা সম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলতে।
পেট খারাপ বা লুজ মোশান থেকে সাবধান : ভ্রমনের সময় পেট খারাপ কিংবা লুজ মোশানের খপ্পরে পড়লে ঝামেলার শেষ থাকবে না। তবে এই পরিস্থিতিতে সমস্যার সমাধান করতে পারে ওআরএস স্যালাইন। এক্ষেত্রে এক লিটার পানিতে এক প্যাকেট এসএমসির ওরস্যালাইন মিশিয়ে ধীরে ধীরে পান করুন। এতেই কিন্তু উপকার পাবেন। এছাড়াও ডিহাইড্রেশনেও কিন্তু মুখে খাওয়ার স্যালাইন যথেষ্ট উপকারী। এছাড়াও চিকিৎসক এর পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ইমার্জেন্সি এন্টিবায়োটিক ওষুধ সাথে রাখতে পারেন।
ডায়বেটিস এর ওষুধ : ডায়বেটিস রোগীদের জন্য ভ্রমণের আগে অবশ্যই ডায়বেটিস এর ওষুধ সাথে রাখতে হবে। যেকোন কারনে রাস্তায় যদি আপনার উপসর্গ দেখা যায় তাহলে চিকিৎসক এর পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। এছাড়াও ডায়বেটিস রোগীদের অনেক সময় রক্তে সুগারের পরিমান কমে যায় বা “হাইপোগ্লাইসেমিয়া” হয়ে যায়। তাই ডায়বেটিস রোগীরা অবশ্যই সাথে মিস্টি কিছু রাখুন। হাইপোগ্লাইসেমিয়া-এর উপসর্গ বা লক্ষণগুলো হল-
* মাথা ঘুরা
* হতচকিত বা অচেতন অবস্থা
* মাথা ধরা বা ঝিমঝিম করা
* প্রচুর খিদে পাওয়া
* বুক ধড়ফড় করা
* অতিরিক্ত ঘামা
* অত্যন্ত দুর্বল বোধ করা
* শরীর কাঁপতে থাকা ও শীতল হয়ে আসা
যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন তারা হাইপো অবস্থা এড়াতে চিকিৎসকের নির্দেশমত এবং সময়মত খাওয়াদাওয়া করেন। পকেটে সবসময়ে চিনিযুক্ত খাবার রাখুন। বেশি খারাপ বোধ করলেই সাথে সাথে রক্তে শর্করার পরিমাপ মেপে দেখবেন এবং সেটি কমে যাবার আগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।
হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের ওষুধ : যাদের হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট আছে তারা অবশ্যই সাথে রাখুন ইনহেলার এবং চিকিৎসক এর পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ। রাস্তায় ধুলাবালিতে অনেকের অ্যাজমা এর এ্যটাক হতে পারে। তাই সাথে অবশ্যই এই ওষুধ গুলো রাখা জরুরি। সাথে ভ্রমণকালে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করুন। মাস্ক আপনাকে শুধুমাত্র ধুলাবালি থেকেই রক্ষা করবে না বরং রক্ষা করবে নানা রকম বায়ুবাহিত রোগ থেকে- যেমন করোনা, যক্ষা ইত্যাদি।
প্রেসারের ওষুধ : যারা ব্লাড প্রেসার জনিত সমস্যায় ভুগছেন তাদের সাথে অবশ্যই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী প্রেসারের ওষুধ রাখতে হবে।। পথে ওষুধ খাওয়ার সময় হবে তা যথাযথভাবে খেয়ে ফেলতে হবে। এছাড়াও যাদের হৃদপিণ্ডে সমস্যা/ বুক ধড়ফড় করে তাদের সেই অনুযায়ী ওষুধ সাথে রাখা জরুরি। এতে করে অনেক বড়সড় দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
গর্ভবতী মহিলাদের জন্য পরামর্শ : ভ্রমনকালীন সময়ে গর্ভবতী মহিলাদের ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র সাথে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় ভ্রমণের সময় বমি হওয়াটা স্বাভাবিক। এজন্য সাথে রাখা জরুরি বমির ওষুধ। আবার অনেকের মাইগ্রেন এবং রাস্তার ধূলাবালিতে সমস্যা থাকে।গর্ভাবস্থায় সব ধরনের ঔষধ সেবন করা যায় না।তাই ডাক্তারকে নিজের সমস্যার কথা বলে প্রয়োজন মত ঔষধ সাথে রাখাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ।
ফাস্ট এইড কিট : ভ্রমণের সময় যেকোন কারনেই ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। কারো হয়ত হাত পা ছিলে যেতে পারে। তাই অবশ্যই সাথে রাখুন ফাস্ট এইড বক্স। ফাস্ট এইড বক্স হলো একটি ছোট বাক্স বা থলি যাতে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য সবরকম জরুরী উপকরণ মজুদ থাকে। প্রয়োজনের সময় প্রাথমিক চিকিৎসা বাক্স সাথে থাকলে খুব দ্রুত ও সহজেই যেকোন দূর্ঘটনার মোকাবেলা করা যায়। ভ্রমণে এই বাক্সটি হতে পারে অসময়ের ভাল বন্ধু।
এই বক্সে যা যা রাখবেন তা হলো-
– জীবানুনাশক সলিউশন, যেমন ডেটল , হ্যাক্সিসল ইত্যাদি
– ওয়ান টাইম ব্যান্ড এইড
– পুড়ে যাওয়া প্রতিরোধকারি মলম, যেমন বার্ন ক্রিম, কাচি
– রোল ব্যান্ডেজ/ ক্রেব ব্যান্ডেজ
– অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম, যেমন- স্যাভলন, ডেটল, হাইড্রোজেন-পার-অক্সাইড, পভিসেভ ইত্যাদি।
– তাপমান যন্ত্র বা থার্মোমিটার।
ভ্রমণের সময় আবহাওয়া পরিবর্তন এর কারণে শরীর খারাপ হতেই পারে। উপরোক্ত ওষুধ এবং সাবধানতা অবলম্বন করলে এই শরীর খারাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে অসুস্থতা বাড়াবাড়ি পর্যায় পৌছালে অবশ্যই নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসক এর শরনাপন্ন হন।
লেখক : ডা. তাহমীদ কামাল
ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ