১৯৬৫ সাল। মোহাম্মদ আসাফ উদ্দৌলা রাজশাহীতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তখন ডা. এম আর খানের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। সেইসময় এম আর খান রাজশাহী মেডিকেলের প্রফেসর ছিলেন। আসাফ উদ্দৌলা সাহেবের একমাত্র মেয়ের নাম প্রীতি। একদিন প্রীতি ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়ল। তার অবস্থা এতটাই সঙ্কটাপন্ন হলো যে ডাক্তাররা সবাই হাল ছেড়ে দিলেন। তার বাঁচার আশা নেই বললেই চলে। আসাফ উদ্দৌলা তখন মেয়েকে ব্যাংককে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। এমন সময় ডাক্তার এম আর খান এসে প্রীতিকে দেখলেন। তিনি তার চিকিৎসা করলেন। দিন কয়েক চিকিৎসা করার পর একপর্যায়ে রুগীকে ঢাকায় নিয়ে যেতে বললেন। সেইসাথে ঢাকায় নিয়ে কি কি করতে হবে তাও বলে দিলেন তিনি। আসাফ উদ্দৌলা মেয়েকে নিয়ে দ্রুত ঢাকায় এলেন। ঢাকায় বড় ডাক্তারদের অধীনে প্রীতির চিকিৎসা শুরু হলো। কিন্তু আসাফ উদ্দৌলা দেখলেন, ঢাকার ডাক্তাররা এম আর খানের প্রেসক্রিপশান অনুসরণ করছেন। চিকিৎসা পেয়ে প্রীতি ভালো হয়ে গেল।
পাঠক আপনারা হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমি কোন এম আর খানের কথা বলছি। ডা.এম আর খান, জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান, শিশুবন্ধু এম আর খান, সমাজসেবী এম আর খানের কথাই বলছি। যাঁর চিকিৎসার গুণে প্রাণ ফিরে পেয়েছে হাজার হাজার শিশু। দেশের প্রথম শিশুচিকিৎসক ও অধ্যাপক হিসেবে তিনি সুনামের সাথে আজীবন দায়িত্ব পালন করেছেন। এক কথায় তাঁকে বলা যায় ‘Father of the Paediatrics‘ অর্থাৎ বাংলাদেশে শিশুরোগ চিকিৎসার পথিকৃৎ।
এম আর খান নামে তিনি সর্বাধিক পরিচিত হলেও তাঁর পুরো নাম মো. রফি খান। বাবা মা, প্রতিবেশী সকলের কাছে খোকা নামে বেশী পরিচিত ছিলেন তিনি। মাত্র চার বছর বয়সেই মায়ের কাছে খোকা রফির হাতেখড়ি হয় প্রথম বর্ণ পরিচয় প্রথম ভাগ দিয়ে। তখন কাগজ কলমের তেমন একটা প্রচলন ছিল না। তাল পাতায় হাতের লেখা চর্চা করতে হতো। হাড়ির কালি আর সিমপাতার রস দিয়ে ঘটে বানানো কালিতে বাঁশের কঞ্চির কলমে তাল পাতায় লিখতে হতো। ঘটের কালির মধ্যে কলম ভিজিয়ে তালপাতায় অক্ষর লিখতেন তিনিও। লেখা শেষে তালপাতা পানিতে ধুয়ে আবার গুছিয়ে রাখতে হতো যত্ন করে পরের দিনের জন্য। পরে অবশ্য শ্লেটে লেখা শিখেছিলেন ।
এরপর ভর্তি হন রসুলপুর প্রাইমারী স্কুলে। স্কুল ঘরটি ছিল ছন পাতার ছাউনি দেয়া। বাঁশের চাটায়ের বেড়া দিয়ে ক্লাসগুলো ভাগ করা ছিল। মেঝেতে মাদুর পেতে বসতেন তাঁরা। দশ বছর বয়সে সাতক্ষীরা সদরের ঐতিহ্যবাহী প্রাণনাথ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় (পিএন স্কুল)-এ ভর্তি হন তিনি। পড়াশুনায় মেধাবী ছিলেন খুব। ছেলেবেলায় খুব ভাল ফুটবল খেলতেন। রসুলপুর স্কুল টিম লিডার হিসেবে তিনি ১৩টি ট্রফি লাভ করেন। বর্তমান ‘গোল্ড কাপ’ এর সময়ে গ্রামের সেই ট্রফি মূল্যহীন মনে হলেও এই পুরস্কারের উদ্দীপনা তাঁর জীবনে বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিক শক্তি যুগিয়েছিলো। সাতক্ষীরা প্রাণনাথ হাই স্কুলেও তিনি টিম লিডার ছিলেন। ১৯৪৩ সালে এ স্কুল থেকেই কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
মেট্রিক পাস করার পর তিনি কলকাতায় যান। ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেসময় মুসলিম ছাত্ররা ঐ কলেজে পড়ার সুযোগ পেত কম। হাতে গোনা মাত্র দু’চার জনকে ভর্তি করা হতো। কিন্তু তিনি তাঁর মেধার জোরে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজে পড়ার সময় তিনি হাজী মহসীন বৃত্তি লাভ করেন । ড. কুদরত-ই-খুদা ছিলেন তাঁর শিক্ষক। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন তিনি। ১৯৪৫ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৪৬ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। মাত্র ৩০ জন মুসলমান ছাত্র ভর্তি হবার সুযোগ পেয়েছিল সেবছর। এর আগে মুসলিম ছাত্রদের জন্য কোটা আরও অনেক কম ছিলো। এম আর খানের নেতৃত্বে ছাত্ররা এ বিষয়টি নিয়ে শেরে-বাংলা এ.কে ফজলুর হকের কেবিনেটের এম.এল.এ আবদুল হাকিম বিক্রমপুরীর সাথে আলোচনা করেন। তাঁদের এ উদ্যোগে মুসলিম ছাত্রদের ভর্তি কোটা বৃদ্ধি পায়। ১৯৫২ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর সাতক্ষীরায় ফিরে আসেন তিনি।
এরপর ১৯৫৬ সালে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান এবং বৃটেনের এডিনবার্গ স্কুল অব মেডিসিন-এ ভর্তি হন। সেখান থেকে একই সালে ডিটিএমএন্ডএইচ (Diploma in Tropical Medicine & Hygiene) ডিগ্রী লাভ করেন। স্কুল অব মেডিসিন লন্ডন থেকে তিনি ডিসিএইচ (Diploma in Child Health) ডিগ্রিও লাভ করেন। ১৯৬২ সালে ‘এডিনবার্গের রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান’ থেকে তিনি এমআরসিপি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ থেকে এফসিপিএস (Fellow of College of physicians and Surgeons) এবং ১৯৭৮ সালে এডিনবার্গ থেকে এফআরসিপি (Fellow of Royal College of physicians) ডিগ্রি লাভ করেন। রসুলপুরের ছনপাতার ছাউনি দেয়া এক বিদ্যালয়ে পড়াশুনার শুরু হয়েছিল অধ্যাপক এম আর খানের আর সমাপ্তি হলো লণ্ডন আর বৃটেনের নামকরা মেডিকেল কলেজ থেকে।
দিগন্তজোড়া মাঠ, বনজঙ্গল, পুকুর-খাল-বিল আর সবুজ-শ্যামলে ঘেরা চমৎকার নৈসর্গিক পরিবেশের এক গ্রাম রসুলপুর। রসুলপুর সাতক্ষীরা শহরতলীর একটি গ্রাম। গাছপালার ছায়ায় ঘেরা শান্ত, স্নিগ্ধ সেই রসুলপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত খান পরিবারে ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট এম আর খান জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আলহাজ্ব আব্দুল বারী খান, মা জায়েরা খানম। তাঁদের চার ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন মেজ।
বাবা আলহাজ্ব আব্দুল বারী খান সেইসময় এন্ট্রান্স পাস ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৪ সালে তিনি এন্ট্রান্স পাস করেন। সে সময় এদেশের কোন ছেলের এন্ট্রান্স পাস করার ব্যাপারটি ছিল বিশাল ঘটনা। আব্দুল বারী খান-এর এন্ট্রান্স পাসের খবর শুনে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোকজন তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। কর্মজীবনের পাশাপাশি আব্দুল বারী খান ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ সমাজসেবক। তাঁর বিভিন্ন সমাজকর্মের সুখ্যাতি আজও সাতক্ষীরাবাসীর মুখে শোনা যায়। মা জায়েরা খানম ছিলেন সরলমতি এক বিদূষী নারী। নিজের সন্তানদের পাশাপাশি পাড়াপ্রতিবেশী, শিশু-কিশোর এমনকি তরুণদের প্রতিও তিনি ছিলেন সমান মমতাময়ী। তিনি প্রতিবেশী মেয়েদেরকে শিক্ষিত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করার পাশাপাশি সাহায্য সহযোগিতাও করতেন অকাতরে। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা রমণী ছিলেন তিনি।
ছেলেবেলায় এম আর খান সবধরণের ফলগাছেই চড়তে পারতেন এবং ফল পেড়ে খেতেন। সেইসময় তিনি এক আত্মীয়ের নারিকেল গাছ থেকে প্রায়ই ডাব পেড়ে এনে ডাবের পানি পান করতেন। অন্যরা এই কাজ করলে গাছের মালিক তেড়ে আসতেন। কিন্তু এম আর খানের বেলায় তিনি মাফ করে দিতেন। কখনও ধরা পড়লে গাছের মালিক সেই আত্মীয় বলতেন-‘ও রফি! নারকেল পেড়েছো! খাও, খাও! যতো খুশি খাও।’ তাঁর প্রতি সেই আত্মীয়ের এই বিশেষ পক্ষপাত আর স্নেহ বৎসল্যের কথা তাঁর মনে সুখের স্মৃতি হিসেবে বিরাজ করছে ।
তাঁদের বাড়ির সামনের অংশে পুরুষদের ওযু, গোসল করার জন্য একটা বড় পুকুর ছিল। আর মহিলারা ব্যবহার করতেন বাড়ির পেছনের পুকুর। গ্রামে আরও কয়েকটি পুকুর ছিল। ছেলেবেলায় তাঁরা গ্রামের সব পুকুরেই সাঁতার কাটতেন। গোছলের সময় চলতো দীর্ঘ সাঁতার ও জলবিহার। সেটা তাঁদের জন্য খুব আনন্দের একটা বিষয় ছিল। তাঁর এক আত্মীয় সম্পর্কে বড় ভাই, তাঁর সারাক্ষণের দুর্ভাবনা, এভাবে পুকুরের পানি ঘোলা করলে পুকুরের মাছ মারা যাবে। পুকুরে তাঁদেরকে সাঁতার কাটতে আর ঝাপাঝাপি করতে দেখলেই তিনি ধাওয়া করতেন। তাড়া খেয়ে সেই পুকুর ছেড়ে দৌড়ে আরেক পুকুরে, সেখান থেকে আবার ধাওয়া খেয়ে পুকুর ছেড়ে খালে গিয়ে ঝাঁপ দিতেন। ছেলেবেলায় সেটা ছিল তাঁদের নিত্যদিনের ঘটনা।
রসুলপুরে যাত্রাগান, পালাগান, জারিগানের আসর, কবি-গানের লড়াই, সার্কাস দলের প্রদর্শনী, হিন্দু সম্প্রদায়ের কীর্তন বা বয়াতীয় আসর বসতো। বাক্সটাইপ বায়োস্কোপ ছিলো। বাক্সের ছিদ্রের সাথে চোখ লাগিয়ে একসঙ্গে ৪/৫ জন মিলে সেই বায়োস্কোপ দেখতেন তাঁরা। বায়োস্কোপওয়ালা সুর ও ছন্দে দৃশ্য বর্ণনা করে যেতেন। তার দুই একটা ছন্দ আজও মনে আছে এম আর খানের। পায়ে নাচের তাল রেখে বায়োস্কোপওয়ালা সুরে সুরে বলতো-
“কি মজাদার দেখা গেল, লাট সাহেবের বাড়ী এলো…।” মাঝে মাঝে গ্রামে আসতো যাত্রাদল। তাদের যাত্রাপালা চলতো সারারাত ধরে। মঞ্চের তিন দিক ঘিরে বসতেন তাঁরা শ্রোতা-দর্শকরা। বেশিরভাগই ছিলো উপমহাদেশের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ওপর লেখা। যাত্রাগান শুনতে শুনতে সেই বালক বয়সে তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন। মধ্যরাতে বা শেষ রাতের দিকে পরিবারের মুরুববীদের কেউ তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে করে বাড়িতে পৌঁছে দিতেন।
১৯৫২ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত সাতক্ষীরায় ফিরে আসেন এম আর খান। চিকিৎসা পেশা শুরুর আগেই শুভাকাঙ্খী এবং এলাকার লোকজনের অনুরোধে পৌরসভার কমিশনার পদে নির্বাচন করেন তিনি। রহস্যময় কারণে হেরে যান । নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে মামলা করেন। প্রিজাইডিং অফিসার সংশ্লিষ্টদের ব্যালট বাক্স হাজির করতে বললেন। কিন্তু তারা হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে তা পুড়িয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে ঝামেলায় পড়ে যান প্রিজাইডিং অফিসার। তিনি এম আর খানের বাবাকে এই মামলা তুলে নিতে অনুরোধ করেন। বাবার চাপের মুখে মামলা তুলে নেন তিনি। শুরু হয় ষড়যন্ত্র। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সভাপতি এই অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। ডিটেনশন দেয়া হয় এক মাসের। বাবা আ. বারী খান তখন খুলনা জেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান ছিলেন খান এ সবুর। তাঁদের উদ্যোগে ছাড়া পান তিনি। এরপর তিনি খুলনায় ডাক্তারী শুরু করেন।
রসুলপুর গ্রামের মেয়ে তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয় আনোয়ারা বেগম আনুর সাথে ডা. এম আর খান ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আনোয়ারা বেগম ও ডা. এম আর খান দম্পতির একমাত্র মেয়ের নাম দৌলতুন্নেসা (ম্যান্ডি)।
খুলনায় ডাক্তারি করার সময়ই এম আর খান অনুভব করেন শিশুদের সঠিক চিকিৎসা এদেশে নেই। এ ব্যাপারে উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নেয়া প্রয়োজন। উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ১৯৫৬ সালে তিনি সস্ত্রীক বিদেশে পাড়ি জমান। বিদেশে পড়াশুনা শেষ করে তিনি ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার কেন্ট এবং এডিনবার্গ গ্রুপ হাসপাতালে যথাক্রমে সহকারী রেজিস্টার ও রেজিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কিন্তু বিদেশে ভাল চাকরি ছেড়ে নাড়ির টানে চলে আসেন দেশে। বৃটেনে এমআরসিপি পাস করার পর সিক চিলড্রেন হাসপাতালের প্রধান ডা. ডিকশন এম আর খান-কে সেখানে ভাল সুযোগ দিতে চাইলেন। বললেন- ‘তোমার মেয়ে ম্যান্ডি এখানে পড়ে। তোমার স্ত্রীও এই সমাজে সম্মানিতা। তুমিও ভাল ইনকাম করো। কেন দেশে ফিরতে চাও?’ উত্তরে এম আর খান বললেন, ‘আমার দেশ খুব গরীব। এই গরীবদের চিকিৎসা করার কেউ নেই। আমরা এদেশে পড়ে থাকলে তাদেরকে দেখবে কে?’ ডা. ডিকশন বললেন, দেশে তোমাকে খুব স্ট্রাগল করতে হবে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ডা. এম আর খান উত্তরে বলেছিলেন- ‘God will help us।’
দেশে ফেরার পর সত্যিই স্ট্রাগলের সম্মুখীন হতে হলো তাঁকে। ১৯৬২ সালে দেশে ফিরে দেখেন কাজ নেই। কিন্তু এম আর খানের তখন কাজের প্রয়োজন। কারণ তিনি শিশুরোগ বিষয়ের ওপর যে ডিগ্রী নিয়েছেন তা কাজে লাগাতে হবে। শেষে ১৯৬৩ সালে ডা. খান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসোসিয়েট প্রফেসর অব মেডিসিন পদে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (শিশুস্বাস্থ্য) পদে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে যোগ দেন এবং এক বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৭০ সালে তিনি অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালে তিনি ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিসিন এন্ড রিসার্চ (আইপিজিএমআর)-এর অধ্যাপক ও ১৯৭৩ সালে এই ইনস্টিটিউটের যুগ্ম-পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের নভেম্বরে ডা. খান ঢাকা শিশু হাসপাতালে অধ্যাপক ও পরিচালকের পদে যোগদান করেন। একই বছর অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে পুনরায় তিনি আইপিজিএমআর-এর শিশু বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং দক্ষতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালে অধ্যাপক ডা. এম আর খান তাঁর সুদীর্ঘ চাকুরী জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
তিনি দেশ-বিদেশে উল্লেখযোগ্য মেডিকেল কলেজের উচ্চতর ডিগ্রী/সম্মান প্রদানের ক্ষেত্রে পরীক্ষক হিসেবেও কাজ করছেন। বাংলাদেশে শিশু স্বাস্থ্যের ওপর এফসিপিএস (FCPS), ডিসিএইচ (DCH) এবং এমসিপিএস (MCPS) ডিগ্রী পরীক্ষার পরীক্ষক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালের নভেম্বর থেকে অদ্যবধি IPGMR-এর ভিজিটিং প্রফেসর, জুন ‘৮৯ থেকে আইসিডিডিআর’বি-এর অনারারি কনসালট্যান্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ থেকে এ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ একাডেমী অব সাইন্স-এর কাউন্সিলর, ১৯৮৮ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউট্রিশন বিভাগের ‘এমএসসি’ ‘এমফিল’ ও পিএইচডি কোর্সের তিনি পরীক্ষক। অন্যদিকে ১৯৭৮ সালে ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তাঁর ছিলো অনন্য ভূমিকা। এছাড়া তিনি ধানমন্ডি ৩নং সড়কের বাসভবনে তাঁর নিজস্ব চেম্বারে প্রতিষ্ঠা করেন নিবেদিতা মেডিকেল ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ লি.।
অধ্যাপক ডা. এম আর খান তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে বহু জাতীয় ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটির সক্রিয় সদস্য/উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। যেমন : সভাপতি, শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ; চেয়ারম্যান ও ডাইরেক্টর, ইন্সস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ এন্ড হসপিটাল, মিরপুর; পৃষ্ঠপোষক, সাতক্ষীরা শিশু হাসপাতাল; চেয়ারম্যান, শিশু হাসপাতাল যশোর; সদস্য, একাডেমী কাউন্সিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি ‘মা ও শিশু’ স্বাস্থ্যের কল্যাণে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন শিশু বিষয়ক সংগঠন, সংস্থা ও হাসপাতালের সঙ্গে জড়িত থাকার পাশাপাশি তিনি নিজ উদ্যোগে এ দেশের শিশুদের কল্যাণে একটি ট্রাস্ট গঠন করে দেশবাসীর দৃষ্টি কেড়েছেন। শিশুদের সুস্থ মানসিক বিকাশ সাধনে সহায়ক অবদান রাখাই নিরহঙ্কারী, সদালাপী এই প্রবীণ চিকিৎসকের আজীবনের প্রধান লক্ষ্য। এছাড়া নিজের এলাকার দরিদ্র ও অসহায় মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য নীরবে কাজ করে চলেছেন তিনি। পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত প্রায় সব সম্পত্তিই দান করেছেন সাতক্ষীরা জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে।
এতসব দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি লেখালেখি ও গবেষণার কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর ৩৭টি গবেষণাধর্মী রচনা প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া তিনি শিশুরোগ চিকিৎসা সংক্রান্ত বই লিখেছেন ৭টি। যা দেশে ও বিদেশে বহুল প্রশংসিত।
এম আর খান শিশুরোগ চিকিৎসা ও সমাজ সেবার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত করে তাঁর প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করেছেন। ১৯৮৬ সালে শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে অসামান্য অবদানের জন্য স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি। ১৯৮৭ সালে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজে বায়ো গ্রাফিক্যাল সেন্টার (IBC) থেকে প্রকাশিত International ‘WHO is WHO’ Intellectuals, UK-এর ৭ম সংস্করণে তাঁর জীবনপঞ্জি অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯০ সালে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব কর্তৃক সংবর্ধনা ও পদক গ্রহণ করেন। ১৯৯১ সালে ম্যানিলা ভিত্তিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের এসোসিয়েশন অব পেডিয়েট্রিকস কর্তৃক পদক পান তিনি। ১৯৯২ সালে ওয়াল্ড এসট্রোলজিক্যাল সোসাইটি কর্তৃক সংবর্ধনা ও পদক অর্জন করেন। ১৯৯২ সালে শেরে বাংলা জাতীয় স্মৃতি সংসদ কর্তৃক স্বর্ণপদক গ্রহণ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তাঁকে আরো অনেক সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী: জন্ম:১৯২৮ সালের ১ আগস্ট এম আর খান জন্মগ্রহণ করেন। বাব-মা: বাবা আলহাজ্ব আব্দুল বারী খান, মা জায়েরা খানম। তাঁদের চার ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন মেজ।
পড়াশুনা: মায়ের হাতে পড়াশুনার হাতেখড়ি হয়। এরপর রসুলপুর প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হন। সাতক্ষীরা প্রাণনাথ হাই স্কুলেও থেকে ১৯৪৩ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
মেট্রিক পাস করার পর তিনি কলকাতায় যান। ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৪৫ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৪৬ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর সাতক্ষীরায় ফিরে আসেন তিনি।
এরপর ১৯৫৬ সালে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান এবং বৃটেনের এডিনবার্গ স্কুল অব মেডিসিন-এ ভর্তি হন। সেখান থেকে একই সালে ডিটিএমএন্ডএইচ (Diploma in Tropical Medicine & Hygiene ) ডিগ্রী লাভ করেন। স্কুল অব মেডিসিন লন্ডন থেকে তিনি ডিসিএইচ (Diploma in Child Health) ডিগ্রিও লাভ করেন। ১৯৬২ সালে ‘এডিনবার্গের রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান’ থেকে তিনি এমআরসিপি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ থেকে এফসিপিএস (Fellow of College of physicians and Surgeons) এবং ১৯৭৮ সালে এডিনবার্গ থেকে এফআরসিপি (Fellow of Royal College of physicians) ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবন: ১৯৫২ সালে কলিকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর সাতক্ষীরায় ফিরে আসেন এম আর খান। উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ১৯৫৬ সালে তিনি সস্ত্রীক বিদেশে পাড়ি জমান। বিদেশে পড়াশুনা শেষ করে তিনি ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার কেন্ট এবং এডিনবার্গ গ্রুপ হাসপাতালে যথাক্রমে সহকারী রেজিস্টার ও রেজিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসোসিয়েট প্রফেসর অব মেডিসিন পদে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (শিশুস্বাস্থ্য) পদে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে যোগ দেন এবং এক বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৭০ সালে তিনি অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালে তিনি ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিসিন এন্ড রিসার্চ (আইপিজিএমআর)-এর অধ্যাপক ও ১৯৭৩ সালে এই ইনস্টিটিউটের যুগ্ম-পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের নভেম্বরে ডা. খান ঢাকা শিশু হাসপাতালে অধ্যাপক ও পরিচালকের পদে যোগদান করেন। একই বছর অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে পুনরায় তিনি আইপিজিএমআর-এর শিশু বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং দক্ষতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালে অধ্যাপক ডা. এম আর খান তাঁর সুদীর্ঘ চাকুরী জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
সংসার জীবন: রসুলপুর গ্রামের মেয়ে তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয় আনোয়ারা বেগম আনুর সাথে ডা. এম আর খান ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আনোয়ারা বেগম ও ডা. এম আর খান দম্পতির একমাত্র মেয়ের নাম দৌলতুন্নেসা (ম্যান্ডি)।
তথ্যসূত্র: গুণিজন ডটওআরজি [শিশুবন্ধু জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান স্মারকগ্রন্থ, প্রকাশক-মিসেস আনোয়ারা খান, প্রকাশকাল-১ আগষ্ট ২০০৮]