১. ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল (১২ মে ১৮২০-১৩ আগস্ট ১৯১০)
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ছিলেন ব্রিটিশ সেবিকা, লেখিকা এবং পরিসংখ্যানবিদ।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (অক্টোবর ১৮৫৩-ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬) তার সেবামূলক কর্মকা-ের কারণে তিনি কিংবদন্তিতে পরিণত। গভীর রাত পর্যন্ত তিনি একা প্রদীপ হাতে যুদ্ধাহত যোদ্ধাদের তাঁবুতে হেঁটে বেড়াতেনÑ তখন থেকেই তাকে ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ বলে ডাকা হতো।
১৮২০ সালের ১২ মে ইতালির ফ্লোরেন্স নগরীর কাছে ব্রিটেনের ভিলা কলাম্বিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এই মানবদরদি নারী। তার বাবা উইলিয়াম অ্যাডওয়ার্ড নাইটিঙ্গেল এবং মা ফ্রান্সিস নাইটিঙ্গেল নী স্মিথ। তাদের পরিবারটি ব্রিটেনের অভিজাত, উচ্চবিত্ত পরিবার।
১৮৫৩ সালের ২২ অক্টোবর তিনি লন্ডনের ‘কেয়ার অব সিক জেন্টলওমেন’ ইনস্টিটিউটে তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে যোগ দেন। ১৮৫৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।
১৮৫৫ সাল থেকে তিনি সেবিকা প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। ১৮৫৯ সালে তিনি নাইটিঙ্গেল ফান্ডের জন্য সংগ্রহ করেন ৪৫ হাজার পাউন্ড। ১৮৬০ সালের ৯ জুলাই তিনি সেন্ট থমাস হসপিটালে নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল শুরু করেন। এই স্কুলটির নাম এখন ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং এবং মিডওয়েফারি’।
১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে তিনি এবং ডা. এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল মিলে চালু করেন ‘উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ’।
১৮৮৩ সালে রানী ভিক্টোরিয়া তাকে ‘রয়েল রেডক্রস’ পদক দেন। ১৯০৭ সালে তিনিই প্রথম নারী হিসাবে ‘অর্ডার অব মেরিট’ খেতাব পান। ১৯০৮ সালে তিনি লন্ডন নগরীর ‘অনারারি ফ্রিডম’ উপাধি পান। তার জন্মদিন ১২ মে এখন ‘ইন্টারন্যাশনাল সিএফএস অ্যাওয়ারনেস ডে’। নাইটিঙ্গেল পরিসংখ্যানের গ্রাফিক্যাল উপস্থাপনারও একজন পথিকৃৎ। তার লেখা বই এখন নার্সিং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠ্য। প্রথম জীবনে তিনি অঙ্কশাস্ত্রের ওপরও কাজ করেছেন।
১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে লন্ডনে নিজ বাড়িতে তার জীবনাবসান হয়। হ্যামশায়ারের সেন্ট মার্গারেট চার্চের কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
২. ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২) : খুব কম লোকই জানে যে, বিখ্যাত আমেরিকান কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান একজন স্বেচ্ছাসেবী নার্সও ছিলেন। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-৬৫) সময় হুইটম্যান সামরিক হাসপাতালগুলোতে নার্স হিসাবে কাজ করেছেন। রাজনৈতিক আদর্শে এবং কবিতায় তিনি ছিলেন রাজনৈতিক ও সামাজিক সমতাবাদী।
৩. মেরি টড লিংকন (১৮১৮-১৮৮২) : তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের স্ত্রী। উচ্চশিক্ষিত এবং অভিজাত এই নারী আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় অক্লান্তভাবে আহত যোদ্ধাদের সেবা করেছেন।
৪. ক্লারা বার্টন (১৮২১-১৯১২) : তিনি আমেরিকার ইতিহাসে বিখ্যাত নারীদের একজন। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি সেবিকা হিসাবে কাজ শুরু করেন। রেডক্রসের প্রতিষ্ঠাতা এই নারী আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও খাবার সরবরাহ করতেন।
৫. মেরি এলিজা মাহানি (১৮৪৫-১৯২৬) : তিনিই প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান পেশাদার নার্স। তিনি তার রোগীদের ভালো স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। তিনি আমেরিকান নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা। তার নামে দ্য মেরি মাহানি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়।
৬. মেরি সিকোল (১৮০৫-১৮৮১) : জ্যামাইকায় জন্ম নেওয়া এই নারী ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময় ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের নিষেধ সত্ত্বেও নিজ খরচে ক্রিমিয়ায় আসেন এবং আহত যোদ্ধাদের সেবা করেন। মায়ের কাছেই তার চিকিৎসাসেবা শেখার হাতেখড়ি।
৭. মেরি ব্রেকিনবিজ (১৮৮১-১৯৬৫) : তিনি গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায় নতুন ধারা প্রবর্তন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে যেখানে চিকিৎসাসেবা অপ্রতুল, সেসব এলাকায় সেবা পৌঁছে দেন। তিনি ব্রিটেনে ধাত্রীবিদ্যার ওপর প্রশিক্ষণ নেন।
৮. ফ্লোরেন্স গিনেস ব্ল্যাক (১৯০৭-১৯৮৩) : ছোটবেলায়ই তিনি নার্স হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করার পর নার্সিং প্রশিক্ষণ নেন এবং নার্সিং শিক্ষক হন। তিনি শিশুসেবায় পারদর্শী ছিলেন এবং স্নাতক পর্যায়ে শিশুসেবায় আগ্রহীদের পড়াতেন।
৯. এডিথ ক্যাভেল (১৮৬৫-১৯১৫) : তিনি বেলজিয়ামে নার্সিংয়ের পথিকৃৎ। তিনি সবাইকেই সাহায্য করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সব আহত সৈন্যকে সেবা দিতেন। আহত সৈন্য শত্রুপক্ষের কি না সেটা তার বিবেচ্য ছিল না। ফলে যুদ্ধ শেষে তিনি কোর্টমার্শালের মুখোমুখি হন এবং তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়।
১০. হেলেন ফেয়ার চাইল্ড (১৮৮৫-১৯১৮) : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সেবা দান করেন। যুদ্ধক্ষেত্রেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আলসার অপারেশন সংক্রান্ত জটিলতায় মারা যান। তার মৃতদেহ নিজ দেশ যুক্তরাষ্ট্রে আর আনা হয়নি। ফ্রান্সের বনিতে তাকে সমাহিত করা হয়।
১১. এলিজাবেথ গ্রেস নেইল (১৮৪৬-১৯২৬) : স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করলেও তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে। তিনি আসলে ছিলেন সাংবাদিক। কিন্তু নার্সিং সেক্টরের বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে তিনি নার্সদের তালিকাভুক্তির জন্য জনমত সংগ্রহ শুরু করেন। তিনি প্রথমে একজন প্রশিক্ষিত নার্স হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলেন এবং তারপর নিউজিল্যান্ডের হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে একটি সুশৃঙ্খল সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসেন।
১২. মার্গারেট স্যাঙ্গার (১৮৭৯-১৯৬৬) : তিনি নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সচেতন করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি মেয়েদের স্বাস্থ্যবিষয়ে সচেতন করার পাশাপাশি পরামর্শ দিতেন কখন সন্তান জন্মদানের সঠিক সময়।
১৩. সোফিয়া ম্যানারহেইম (১৮৬৩Ñ১৯২৮) : একজন ব্যাংক কর্মচারী হিসাবে জীবন শুরু করেছিলেন ব্যারনেস সোফিয়া ম্যানারহেইম। ১৯০২ সালে তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার পর তিনি নার্সিংয়ে যোগদান করেন। নিজের দেশ ফিনল্যান্ডে ফিরে আসার আগে তিনি লন্ডনের সেন্ট টমাস হসপিটালের নাইটিঙ্গেল স্কুলে প্রশিক্ষণ নিতে যান। ফিনল্যান্ডে আধুনিক নার্সিংয়ের ভিত্তিভূমি তৈরিতে তার বিরাট অবদান চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হবে।
১৪. হ্যাজেল ডব্লু. জনসন-ব্রাউন (১৯২৭-) : তিনি আফ্রিকান-আমেরিকান জেনারেল। তিনি সেনাবাহিনীতে কর্মরত নার্সদের প্রধান হিসাবে কাজ করেছেন। ওয়ালটার রিড আর্মি স্কুল অব নার্সিংয়ে তিনি ডিন ছিলেন। এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের পরও তার বর্ণগত কারণে তিনি প্রথম ওয়েস্ট চেস্টার অব নার্সিং থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন।
১৫. জয়েস স্লিনস্কি : ৪৫ বছর ধরে তিনি পেশাদার নার্স হিসাবে কাজ করেন। খুব বেশি দিন হয়নি তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন। এর আগে ৩৯ বছর ধরে তিনি ই.আর হিসাবে এডিসনের জন এফ কেনেডি মেডিক্যাল সেন্টারে কাজ করেছেন।
১৬. জেনি প্রিন্টিস : এখনও ধাত্রী নার্স হিসাবে কাজ করছেন। তিনি স্বাভাবিক ও বাড়িতে সন্তান প্রসব বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করেছেন। তিনি সাউথ ডাকোটাতে ‘পুশ’ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল নারীদের সেই অধিকার আদায় করা যাতে তারা তাদের বাচ্চাদের নিজের পছন্দমতো স্থানে জন্ম দিতে পারে।
১৭. ভার্জিনিয়া অ্যাভেনেল হেনডারসন (১৮৯৭-১৯৯৬) : নার্সিংয়ের তাত্ত্বিক উন্নতি সাধনের জন্য তাকে ‘নার্সিংয়ে প্রথম নারী’ হিসাবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তিনি আর্মি স্কুল অব নার্সিং থেকে স্নাতক এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নার্সিংয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ‘সার্বিক স্বাস্থ্যগত সমস্যায় নার্সদের প্রত্যেককেই সেবা করা উচিত’Ñ তার এ তত্ত্বটি নার্সিংয়ে এক বিরাট অবদান বলে স্বীকৃত।
১৮. ক্রিশ্চিয়ান রেইম্যান ( ১৯১৬-১৯৭৯) : ডেনমার্কে জন্মগ্রহণকারী ক্রিশ্চিয়ান রেইম্যান আন্তর্জাতিক নার্সিং সম্প্রদায়ে তার অবদানের কারণে সুপরিচিত। তিনি ছিলেন ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব নার্সেস-এর প্রথম সার্বক্ষণিক কার্যনির্বাহী সম্পাদক। ১৯৩৪ সালে সাইরাকিউসে পারিবারিক খামার তত্ত্বাবধানের জন্য তিনি ইতালি চলে যান, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি নার্সিংয়ের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন।
১৯. মার্থা ব্যালার্ড (১৭৩৪Ñ১৮১২) : তিনি ধাত্রী হিসাবে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করেছেন। তিনি বিশিষ্ট নার্স ক্লারা বার্টনের দাদি। তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন ডাক্তারি বিষয়ে নিজের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ডায়েরি লেখার জন্য।
২০. ডরোথি ডিক্স (১৮০২-১৮৮৭) : তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উন্মাদাশ্রমের চিকিৎসা বিষয়ে নানান অসঙ্গতি ও অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের সময় তিনি সেনাবাহিনীর নার্সদের তদারকির কাজ করেছিলেন। ডিক্স ছিলেন একজন সক্রিয় কর্মী ও সাহসী বক্তা।
সুত্র : সাপ্তাহিক ২০০০