শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চাইল্ড হেলথ ইনস্টিটিউটের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড. আহসান উল্লাহ আল বাকি বলেন, শিশুদের মিথ্যা বলার অনেকাংশ নির্ভর করে পারিবারিক কালচারের ওপর। সামাজিক ব্যবস্থা, শিশুর পারিপাশর্ি্বক পরিবেশ ও বন্ধুদের দ্বারাও প্রভাবিত হতে পারে। তবে শিশুদের মিথ্যা বলার প্রবণতা কোনো রোগ নয়। পিতা-মাতাকে অবশ্যই এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
শক্তিশালী সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনই পারে এ সমস্যা দূর করতে। কল্পনা ও বাস্তবতার জগৎ সম্পর্কে শিশুকে গল্পচ্ছলে বুঝিয়ে বলুন। কল্পনা করুক। তবে বাস্তবতা ভুলে গিয়ে নয়! অনেক সময় কল্পনাপ্রবণতায় মিথ্যা বলার অভ্যাস শিশুর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায়। তাই খুব বেশি চিন্তিত হওয়ারও কিছু নেই।শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এনআইসিভিডির পেডিয়াট্রিক বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর আবদুল্লাহ শাহরিয়ার বলেন, শিশুদের মিথ্যা বলার প্রবণতা কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিক কারণে হয়ে থাকে। অনেক শিশু কৃতিত্বের জন্য মিথ্যা বলে। কেউ বা অন্যের অনুকরণে বলে মিথ্যা। এর প্রতিকার হিসেবে শিশুদের পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে দূরে রাখতে হবে। তারা যেন হতাশা বা হীনম্মন্যতায় না ভোগে। রাগ বা বকাঝকায় উল্টা ফল হতে পারে। সব সময় কাজে খুঁত ধরা, খিটমিট করা, ভয় দেখানো বা হুমকি দেওয়া_ এগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের মিথ্যা বলার প্রথম কারণ শাস্তির ভয়। হয়তো টিফিন খেতে ইচ্ছা করে না। আর না খেলে মায়ের বকুনি শুনতে হবে। এর বিকল্প হিসেবে সব শিশুই আশ্রয় নেবে মিথ্যার। শিশুরা তখনই মিথ্যা বলে যখন বুঝতে পারে, সে কিছু একটা ভুল করেছে। দ্বিতীয় কারণ হলো, অপ্রত্যাশিত কাজ এড়াতে মিথ্যার আশ্রয় নেয় শিশুরা। প্রায়ই দেখা যায়, রাতে ঘুমানোর আগে দাত ব্রাশ করতে চরম অনীহা শিশুদের। হোমওয়ার্ক এড়াতে, স্কুলে যেতে কিংবা পড়তে বসতে শুরু হয় তাদের বাহানা। পেটে ব্যথা, মাথা ব্যথা_ এগুলো তো তাদের সব সময়ের সমস্যা! ছয় বছরের শিশু আবিরের মা ফারহানা ফেরদৌসী জানান, বানিয়ে বানিয়ে কথা সব সময়ই বলে তার শিশু। তবে কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছেন মিথ্যা কথা বলছে সে। যেমন_ স্কুলে গিয়ে টিফিন খাচ্ছে না। জানতে চাইলে বলছে, টিফিন খাচ্ছে। কিন্তু স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানলেন, প্রতিদিনই খাবার ফেলে দেয় আবির। গৃহিণী রাজিয়া সুলতানা জানালেন চার বছরের চঞ্চল তার নামের মতোই চঞ্চল। দন্ত স্থির থাকে না। আজকাল সে জানালা দিয়ে এটা-ওটা ফেলে দিচ্ছে। জানতে চাইলে অকপটে অস্বীকার করছে। তা করছে স্বাভাবিকভাবেই শাস্তির ভয়ে। তবে ছেলেকে বোঝানোর জন্যও তো তার দোষ স্বীকার করাটা জরুরি!
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত শাহানা পারভিন জানান, মেয়ে টুকটুকির বয়স যখন পাঁচ বছর। তখন থেকেই মনগড়া কাহিনী বলতে পছন্দ করত সে। প্রথম প্রথম মেয়ের এ গল্পভরা কাহিনী মুগ্ধ করত সবাইকে। কিন্তু ক্রমেই যে এটি অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে তা বুঝতে বুঝতে দেরি হয়ে গেছে অনেক। এখন মেয়ের বয়স আট। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে এমন সব কাহিনী বলে যার কোনো ভিত্তি নেই। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যাপারটি যে আদৌ সম্ভব নয় তা এখনও বুঝতে পারছে না টুকটুকি।বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের এ ফ্যান্টাসি জগৎটিই তার ভবিষ্যৎ সৃজনশীলতার মূল ভিত্তি। কিন্তু যখনই শিশু কল্পনা আর বাস্তবকে এক করে ফেলে, সমস্যাটা শুরু হয় তখন থেকেই। সকালে উঠতে এত দেরি হলো কেন? এর উত্তরে শিশু যদি বলে, জানালা দিয়ে আসা পরীটার সঙ্গে কাল রাতে অনেক গল্প করেছি তাই দেরি হয়েছে! কি দেবেন এর উত্তর? অনেক সময় দেখা যায়, এ কল্পনা এতটাই তীব্র আকার ধারণ করেছে যে, শিশুটি তার নিজের মনগড়া কাহিনী নিজেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।
অভিভাবকরাও ব্যাপারটি খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে নেন না। কিন্তু এক সময় দেখা যায় বানিয়ে কথা বলা থেকেই মিথ্যা বলা রপ্ত করছে শিশু। সেই ছোট্টটি থাকতে আমরা শিশুর হাতে তুলে দিই মায়াবী রূপকথার গোটা রাজ্য। তাদের কল্পনার জগৎজুড়ে বিচরণ করতে থাকে গল্পের পরী, রাজকন্যা অথবা রাজপুত্ররা। কখনও তারা উড়ে বেড়ায় পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চেপে, কখনও বা ডাইনির নিষ্ঠুরতায় শিহরিত হয়। শিশুদের সেই কল্পরাজ্যে হানা দেয় কার সাধ্য! বেশ কিছুদিন হলো বানিয়ে কথা বলছে ঐশী। কখনও মনে হয়, এটা তো ওর কল্পনারই জগৎ! আবার কখনও মনে হয়, না! যেন ভয় পেয়ে মিথ্যা কথাগুলো বলছে সে। শিশুদের এ ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলার প্রবণতায় স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কিত হয়ে পড়েন অভিভাবকরা।
মাহফুজ আল মেহেদী