গত ৪ ফেব্রুয়ারি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় ১৭ জন স্কুল-ছাত্রছাত্রীর মৃত্যুর কারণ নিপাহ ভাইরাসজনিত মস্তিষ্কের প্রদাহ। ১৯৯৮-৯৯ সালে মালয়েশিয়ার ‘নিপাহ’ নামক গ্রামে এই ভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে বলে একে পরবর্তী সময়ে নিপাহ ভাইরাস নামে অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশে ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় প্রথমে ‘অজ্ঞাত’ রোগ হিসেবে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ১৩ জন আক্রান্ত হন এবং নয়জন মারা যান। পরবর্তী সময়ে এটি নিপাহ ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত হয়। মহাখালীর জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ২০০১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত মোট নয়টি ‘আউটব্রেক’ বা নিপাহ ভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাব শনাক্ত করেছে। শূকর ও বাদুড় এই ভাইরাসের বাহক। বাংলাদেশে বাদুড় থেকে এটি ছড়িয়েছে। নিপাহ ভাইরাসজনিত মস্তিষ্কের প্রদাহ সম্পর্কে পাঠককে সচতন করতে আজকের এই আয়োজন।
মস্তিষ্কের প্রদাহকে ডাক্তারি ভাষায় এনকেফালাইটিস বলা হয়ে থাকে। ভাইরাস মূল ঘাতক। জাপানিজ এনকেফালাইটিসের কথা আমরা অনেক দিন থেকেই জানি, এর টিকাও আছে। নিকট অতীতে ‘অজ্ঞাত রোগ’ নামে একধরনের আতঙ্ক-মাখা রোগে হঠাৎ করেই মানুষের মৃত্যু ঘটতে থাকলে নতুন আরেক ভাইরাসের সন্ধান মেলে প্রথমে মালয়েশিয়ায়, পরে সিঙ্গাপুর, ভারত এবং আমাদের বাংলাদেশে।
নিপাহ ভাইরাস মস্তিষ্কের প্রদাহ ঘটায়
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের ‘নিপাহ’ গ্রামে ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম এক ‘অজ্ঞাত’ ভাইরাসের আক্রমণে মস্তিষ্কের প্রদাহের প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং মে ১৯৯৯ পর্যন্ত বেশ কিছু লোক এতে আক্রান্ত হন, যাদের মধ্যে ৩৯ শতাংশ মারা যান। নিপাহ ভাইরাস ১৯৯৪ সালে অস্ট্রেলিয়ায় আবিষ্কৃত হেনড্রা ভাইরাসের অনুরূপ। মূলত শূকরের সংস্পর্শে আসা মানুষজন এতে আক্রান্ত হলেও বাদুড় এই ভাইরাসের প্রাকৃতিক পোষক বা হোস্ট।
নিপাহর প্রাদুর্ভাব
রোগতত্ত্বের ভাষায়, হঠাৎ করে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট লোকালয়ে কোনো রোগ বেশি পরিমাণে দেখা দিলে তাকে ‘রোগের প্রাদুর্ভাব’ বা ডিজিজ আউটব্রেক হিসেবে অভিহিত করা হয়।
১৯৯৮-৯৯ সালে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরের পর ২০০১ সালের জানুয়ারিতে ভারতের শিলিগুড়িতে এক মাসে ৬৬ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন, যাঁদের ৭৪ শতাংশ মারা যান এবং এঁদের অধিকাংশই ছিলেন হাসপাতালের স্টাফ এবং রোগীর সংস্পর্শে আসা আত্মীয়স্বজন। তখন থেকেই এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে শুরু করে। এর পরপরই ২০০১ সালের এপ্রিল-মে মাসে বাংলাদেশের মেহেরপুরে প্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। পরবর্তী সময়ে বিস্তর গবেষণার পর এটি নিপাহ ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত হয়। এরপর ২০০৩ সালে নওগাঁয়, ২০০৪ সালে রাজবাড়ী ও ফরিদপুরে, ২০০৫ সালে টাঙ্গাইলে, ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়ায়, ২০০৮ সালে মানিকগঞ্জে, ২০১০ সালে ফরিদপুরে এবং এ বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় এ রোগ দেখা দেয়।
৩১ জানুয়ারি ২০১১ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৫২ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং ১১৩ জন (৭৪%) মারা গেছেন। ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া নিপাহ ভাইরাসের আক্রমণে এ পর্যন্ত ২৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং ১৭ জন মারা গেছেন। ৪ ফেব্রুয়ারির এই প্রাদুর্ভাবের ব্যাপারে অনুসন্ধান চলছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে রোগ নিরীক্ষণে আরও ৩৯ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে আইইডিসিআর সূত্রে জানা গেছে।
কীভাবে ছড়ায়
নিপাহ একটি ভাইরাসজনিত ভয়াবহ ব্যাধি। বাংলাদেশে মূলত বাদুড় থেকে মানুষে সংক্রমিত হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। বাদুড়ের লালা, কিংবা মল-মূত্রের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। বাংলাদেশে কাঁচা খেজুড়ের রস খুব জনপ্রিয় পানীয়। খেজুড় গাছের রস যদি বাদুড়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয় তবে ওই রস থেকে কিংবা বাদুড়ে খেয়েছে এমন ফল থেকে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
লক্ষণ কী
তীব্র জ্বরসহ মাথাব্যথা, কাশি, পেটে ব্যথা, খিঁচুনি, প্রলাপ বকা এবং বমি ও চোখে অন্ধকার দেখাসহ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এই রোগের লক্ষণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়, উচ্চরক্তচাপ এবং হূদস্পন্দন বেড়ে যায়।
চিকিৎ সা
নিপাহ ভাইরাসের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিকারমূলক চিকিৎ সা নেই, লক্ষণভিত্তিক চিকিৎ সা দিতে হয়। নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে প্রেরণ করা প্রাথমিক কাজ, দেরি না করে। বর্তমানে হাতীবান্ধায় বিশেষজ্ঞ দল সার্বক্ষণিক কাজ করছে। রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক রাখা ও দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রতিরোধ
যে এলাকায় রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় বা দিয়েছে (বর্তমানে হাতীবান্ধায়) সেসব এলাকায় বাদুড় এবং শূকরের (যদি থাকে) সংস্পর্শ থেকে সাবধান থাকতে হবে।
খেজুরের কাঁচা রস বর্জন করতে হবে।
বাদুড়ে খাওয়া কোনো ধরনের আংশিক ফল খাওয়া যাবে না।
যে কোনো কাঁচা ফলমূল পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে খেতে হবে।
আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে সাবান-পানি দিয়ে দুই হাত ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে।
রোগীর সেবাযত্ন করার সময় সম্ভব হলে মুখ ঢেকে ও হাতে গ্লাভস পরে নিতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সাবান-পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়েনেবেন
হঠাৎ কোনো একজন আক্রান্ত হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
একটু পরিবেশ-সচেতন হলে আমরা প্রাণীবাহিত বিভিন্ন রোগবালাই থেকে সহজেই বাঁচতে পারি। রোগতত্ত্বের তথ্য-উপাত্ত এটাই আমাদের শেখায়।
ডা. ইকবাল কবীর
সহকারী অধ্যাপক, রোগতত্ত্ব বিভাগ, নিপসম, মহাখালী
সুত্র : প্রথম আলো