অধ্যাপক ডা. মোঃ তাহমিনুর রহমান সজল
মুসলমানদের জন্য আল্লাহপাকের অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে একটি রোজা। তবে সঠিকভাবে রোজা পালন করতে হলে সুস্বাস্থ্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। রোজায় যেসব ব্যাপারে স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে সেগুলো হল-
বুক জ্বালাপোড়া বা বদহজম
আমাদের পাকস্থলি এসিড দিয়ে পূর্ণ। খাবার হজম করা এবং ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলা এ এসিডের কাজ। সাধারণত পাকস্থলির এবং খাদ্যনালীর জাংশান যা ভাল্ব হিসেবে কাজ করে। এই এসিডের বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত থাকে লাইনিং ইপিথেলিয়ামের অখণ্ডতার কারণে। যদি কোনও কারণে এই লাইনিং ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ভাল্ব ত্র“টিপূর্ণ হয় তাহলে বুক জ্বালাপোড়া করবে। রোজা রাখলে পাকস্থলিতে এসিড নিঃসরণ কম হয় কিন্তু খাবারের চিন্তা বা গন্ধ ব্রেইনকে উত্তেজিত করে এসিড নিঃসরণ বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে হার্টবার্ন বা বুক জ্বালাপোড়া করতে পারে। এ জন্য যারা আগে থেকেই আলসার, ডিসপেপসিয়া, বুক জ্বালাপোড়ায় ভুগছেন এবং যাদের নতুন করে এই লক্ষণ দেখা দিচ্ছে তাদের চিকিৎসকের পরামর্শমতো বিভিন্ন ধরনের এন্টাসিড ইফতারি, রাতের খাবার এবং সেহরির সময় খাওয়ার আগে বা পরে খেতে হবে। তৈলাক্ত, মশলাসমৃদ্ধ খাবার পরিহার করতে হবে।
ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র
যাদের ডায়াবেটিসের মাত্রা বেশি, অনিয়ন্ত্রিত এবং তিনবেলা ইনসুলিন নেন তাদের রোজা না রাখাই ভালো। কারণ এতে জীবনের ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে। তবুও যারা মনোবলের দিক থেকে শক্তিশালী তারা চিকিৎসকের পরামর্শমতো ইনসুলিন ইফতারি, রাতের খাওয়া এবং সেহরির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে রোজা রাখতে পারেন। তবে শর্ত হল যখনই খারাপ অনুভব করবেন সঙ্গে সঙ্গে রক্তের সুগার দেখে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। যারা ট্যাবলেট দিয়ে বা ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং পরিমিত খাদ্য গ্রহণ করে, বেশি কায়িক পরিশ্রম করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখেন তাদের চিকিৎসকের পরামর্শমতো রোজা করতে কোনও বাধা নেই। তবে ট্যাবলেটের বেলায় গ্লিবেনক্লামাইড যারা খান তাদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা যেমন রেটিনোপ্যাথি, নেফ্রোপ্যাথি এবং নিউরোপ্যাথি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রোজা রাখতে হবে।
মাথাব্যথা বা হেডেক
রোজা রাখা বা অভুক্ততার কারণে মাথাব্যথা হওয়া একটা খুবই সাধারণ রোগ। শরীরে পানি ও ফ্লুয়িডের স্বল্পতা, ক্ষুধা, অপর্যাপ্ত বিশ্রাম, চা ও কফি জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ এই মাথাব্যথার প্রধান কারণ। এজন্য ইফতার সেহরির সময় প্রচুর পানীয়, ফলের রস গ্রহণ করা উচিত। বিশ্রাম ও নিদ্রা এবং ভাজাপোড়া, তৈলাক্ত, চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। চা, সিগারেট, কফি কম খাওয়া ভালো। সূর্যালোকে না বের হওয়া উত্তম।
শরীরে পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশান
এটা রোজার মধ্যে একটি সাধারণ সমস্যা। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, ঘাম পায়খানা, প্রস্রাব দিয়ে পানি ও অন্যান্য ফ্লুয়িড প্রতিনিয়ত নির্গত হয়। এছাড়া শারীরিক পরিশ্রম এবং কিডনির কার্যকারিতাও এই লক্ষণের জন্য দায়ী। এজন্য রোজার সময় ইফতার, রাতের সেহরির সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানীয় গ্রহণ, কম শারীরিক পরিশ্রম করা, সূর্যালোকে না বের হওয়া উত্তম। বয়ষ্কদের বেলায় এই পানিশূন্যতা মারাÍক হতে পারে। পানিশূন্যতা হলে রোজাদারদের অস্বস্তি লাগা, অবসাদগ্রস্ত লাগা, মাংসপেশিতে ক্রাম্প, মাথাঘোরা, অস্বাভাবিকতা এবং হার্ট ফেইলুর বা মূর্ছা যেতে পারে। এজন্য এসব লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ফ্লুয়িড রিপ্লেসমেন্টের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কোষ্ঠকাঠিন্য বা কনস্টিপেশান
রোজার সময় অভুক্ততার কারণে, পানি বা রস জাতীয় খাবার কম গ্রহণ করলে, আঁশযুক্ত খাবার ফলমূল কম খেলে এবং আন্ত্রিক কোনও কারণে কোষ্ঠকাঠিন্যের হার বেড়ে যায়। এটা রোজাদারদের জন্য খুবই কষ্টকর এবং উত্তেজক। প্রচুর পরিমাণে পানি ও ফলের রস গ্রহণ, আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ লাল মাংস, চর্বিযুক্ত, তৈলাক্ত, ভাজাপোড়া খাবার কম খেলে এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেহরি বা ইফতারির সময় বেলের শরবত, ইসবগুলের ভুসির শরবত খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। এগুলো দিয়ে কাজ না হলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন করতে হবে।
মানসিক চাপ বা স্ট্রেস
অনেকক্ষণ খাবার ও পানীয় গ্রহণ না করা, দৈনন্দিন রুটিনে পরিবর্তিত হওয়া এবং ঘুম কম হওয়ার কারণে মানসিক চাপ বা স্ট্রেস তৈরি হতে পারে। সূর্যালোকে না যাওয়া, ক্রোধ দমন করা, চা, সিগারেট, কফি না খাওয়া, নতুন রুটিন সহজভাবে গ্রহণ করা এবং প্রয়োজন হলে ২/৩ দিন ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমটা ঠিক করে নিলে এর থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
মেদস্থূলতা বৃদ্ধি
যারা মেদস্থূল তারা রোজা রাখলে সাধারণত ওজন কমার কথা। এর কারণ হল পরিমিত খাদ্য গ্রহণ, নামাজ পরা এবং মানসিক শান্তি। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে এর উল্টো হতে পারে। মেদবহুল ব্যক্তি রোজার মধ্যে খাবার আরও বাড়িয়ে দেয়, তৈলাক্ত চর্বিযুক্ত খাবার মাংস, দুধ, আইসক্রিম, ফাস্টফুড বেশি গ্রহণ করলে। মেদস্থূলদের খাবার নির্বাচন অত্যন্ত সাবধানে করতে হবে যাতে ওজন
বেশি না হয়।
রোজার মধ্যে কোন ধরনের খাবার পরিতাজ্য
ষ খুব বেশি তেলে ভাজা খাবার যেমন পাকুড়া, সামুচা, চিকেন উইংগ, পেঁয়াজু, বেগুনি।
ষ বেশি সুগার বা মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমনÑ পুডিং, পায়েশ, ক্ষীর, আইসক্রিম, সব ধরনের মিষ্টি।
ষ বেশি চর্বিযুক্ত খাবার যেমন- মাংস, পরোটা, তৈলাক্ত তরকারি।
রোজার মধ্যে যেসব খাবার খাওয়া উচিত
ষ হোল গ্রেইন শস্য যেমনÑ মটর, টক দই, টক দইয়ের মধ্যে সিদ্ধ আলু, রায়তা, বেকড সমুচা।
ষ দুধজাত মিষ্টি এবং পুডিং যেমন রসমালাই, বরফি।
ষ চাপাতি বা সাধারণ রুটি তেল ছাড়া পরোটার সঙ্গে বেকড বা গ্রিল্ড মুরগির মাংস।
ষ অল্প তেলযুক্ত মাছ, মাংস, সবজি।
রোজার মধ্যে বেশি করে যে খাবারগুলো খাওয়া যাবে
ষ পানি ও তাজা ফল-মূলের রস
ষ আঁশযুক্ত ফলমূল সবজি।
ষ খেজুর
ষ ভাত-রুটি পরিমাণমতো সবজি ও মাছ, মাংস (লাল মাংস ছাড়া)। অল্প তেলে এবং মশলা দিয়ে পাক করা।
ষ গ্রিল্ড এবং বেকড মাছ, মাংস হলে বেশি ভালো হয়।
ষ টক জাতীয় ফলমূল, দই, রায়তা, বোরহানি
ষ বাসায় বানানো পেস্ট্রি, ক্ষীর, পুডিং
অধ্যাপক ডা. মোঃ তাহমিনুর রহমান সজল
উপাধ্যক্ষ এবং বিভাগীয় প্রধান, প্যাথলজি, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ, ধানমণ্ডি, ঢাকা