ধুঁকছে মেডিকেল শিক্ষা

দেশের মেডিকেল শিক্ষা কার্যক্রম জোড়াতালি দিয়ে চলছে। মূল সমস্যা শিক্ষক সংকট। সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই রয়েছে এই সংকট। এরমধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে ৪৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর ৬৭টি অনুমোদিত বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৫৫ দশমিক ২২ শতাংশ শিক্ষকই নেই। অর্থাৎ প্রয়োজনের অর্ধেকেরও কম শিক্ষক রেখেই মেডিকেল শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে কলেজগুলো। এছাড়া অনেক মেডিকেল কলেজে ভৌত অবকাঠামো ও পর্যাপ্ত শিক্ষা সরঞ্জামেরও অভাব রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা এই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলছেন, এমবিবিএস কোর্সের শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর ফলে ভবিষ্যতের চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে নিম্নমানের। যা দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তবে এটিকে সমস্যা মনে করছে না স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটু মিঞা এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এতদিন শিক্ষক স্বল্পতা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি বড় ধরনের একটা পদোন্নতি হওয়ায় শিক্ষকের সঙ্কট খুব একটা নেই। এ কারণে মেডিকেল কলেজগুলোয় পাঠদান নিয়ে আর সমস্যা হবে না। এছাড়া নতুন সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় ভবনসহ শিক্ষার্থী ভর্তির মতো অবকাঠামো রয়েছে। তাই পুরোনো মেডিকেল কলেজসহ নতুন এসব মেডিকেল কলেজে আসন সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।

স্বাধীনতার পর প্রথম ২০ বছরে দেশে মেডিকেল কলেজ ছিল ৯টি (সরকারি ৬, বেসরকারি ৩)। ১৯৯২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৪৯টি মেডিকেল কলেজ অনমোদন দেয়া হয়। এরপর সব সরকারই মেডিকেল কলেজ অনুমোদন দিয়েছে। গত দেড় দশকে সরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ২০টি। এর ফলে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৪টিতে। এসব কলেজে শিক্ষার্থীর পরিমাণ ৫০ হাজারেরও বেশি। প্রতি শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে চার সহস্রাধিক।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে বর্তমানে শিক্ষকের পদ রয়েছে ৫ হাজার ৬৬৮টি। যার মধ্যে ফাঁকা রয়েছে ২ হাজার ৫৪৪টি পদ। সে অনুযায়ী সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় মোট পদের বিপরীতে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে ৪৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) জানিয়েছে, একটি মেডিকেল কলেজে বহু বিভাগ থাকে। তবে মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ন্যূনতম ১১টি বিষয় থাকা বাধ্যতামূলক। বিষয়গুলো হলো অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, কমিউনিটি মেডিসিন, ফরেনসিক মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, প্যাথলজি, মাইক্রোবায়োলজি, সার্জারি, মেডিসিন এবং গাইনি ও অবস। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এমবিবিএস (ব্যাচেলর অব মেডিসিন, ব্যাচেলর অব সার্জারি) ও বিডিএস (ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি) ডিগ্রি দেয়া হয়, সেগুলোর একটি সাধারণ নীতিমালা হলো প্রতি ১০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকতে হবে। আর প্রতি ২৫ শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম একজন পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী শিক্ষক থাকতে হবে। যদিও সরকারি চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ শর্ত পূরণ করতে পারছে না।

এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপক পদেই শিক্ষকের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি বলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানগুলোয় অধ্যাপকদের জন্য পদ রয়েছে ৮০১টি। এর মধ্যে ৫২৫টি খালি, যা সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় মোট অধ্যাপক পদের ৬৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। সহযোগী অধ্যাপকের পদ খালি ৬০ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ১ হাজার ৩৭১টি সহযোগী অধ্যাপক পদের ৮৩৬টিই খালি রয়েছে। এছাড়া সহকারী অধ্যাপক পদে ২ হাজার ১০০ পদের বিপরীতে ৮৩৩টি (৩৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ) এবং ১ হাজার ৩৯৬ প্রভাষক পদের বিপরীতে ৩৫০টি (২৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ) খালি রয়েছে।

নতুন-পুরনো সবগুলোতেই ঘাটতি: প্রতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীর আসন পূর্ণ হলেও প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষকের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। দেশের পুরনো ৬ মেডিকেল কলেজের অন্যতম ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ মেডিকেল কলেজে প্রতি শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস কোর্সে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হয় ২৫০। ৫০ শিক্ষার্থী ভর্তি হয় বিডিএস কোর্সে। বর্তমানে কলেজটিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৭০০ জন। প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসকদের পোস্টগ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রিও দেয়া হচ্ছে। কলেজটিতে পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের শিক্ষার্থী আছেন ৩৪০ জন। অথচ এখানে অধ্যাপকের ৪২টি পদের বিপরীতে ৩০টি, সহযোগী অধ্যাপকের ৬৯টি পদের বিপরীতে ৪৩টি, সহকারী অধ্যাপকের ১১৯টি পদের বিপরীতে ৪৩টি এবং ৭৪টি প্রভাষক পদের বিপরীতে ২২টি খালি রয়েছে। মোট ৩০৪টি পদের মধ্যে খালি রয়েছে ১৩৮টি।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে বর্তমানে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। প্রতি বছর ১২৪ জন চিকিৎসক পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের জন্য ভর্তি হচ্ছেন। কলেজের ৩১০টি শিক্ষক পদের বিপরীতে খালি রয়েছে ১৬৪টি পদ। দেশে চিকিৎসা শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ। ১৯৪৬ সালের ১০ জুলাই মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি ও অটোল্যারিঙ্গোলজি- এ চার বিভাগ নিয়ে যাত্রা করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে কলেজের ৪২টি বিভাগে এমবিবিএস, বিডিএস ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। এখানে এমবিবিএস কোর্সে প্রতি বছর ২৩০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন। স্নাতকোত্তর কোর্সে ৪২টি বিষয়ে এমডি, এমফিল ও ডিপ্লোমা দেয়া হচ্ছে। কলেজটিতে ৪৪৯ শিক্ষক পদের বিপরীতে ফাঁকা রয়েছে ১২৭টি।

এদিকে নতুন মেডিকেল কলেজগুলোর অবস্থা আরও করুণ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যশোর, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ (কিশোরগঞ্জ) ও শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের শিক্ষক পরিস্থিতি মূল্যায়নে দেখা গেছে, এসব কলেজের বিভিন্ন বিষয়ের অধ্যাপকই নেই। সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকও খুব কম। এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা মূলত প্রভাষকদের ওপর নির্ভরশীল।

হাসপাতালও নেই অনেক কলেজের: স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, মেডিকেল কলেজগুলোর অন্যতম শর্ত হলো নিজস্ব হাসপাতাল থাকা, যাতে তাত্ত্বিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে চিকিৎসায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে অন্তত ২০টিরই নিজস্ব হাসপাতাল নেই। আবার যেগুলোয় এখন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, সেগুলোও তা পাচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর অনেক পর। আর এই কারণে এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজস্ব হাসপাতালে রোগী ভিজিটের সুযোগ পাচ্ছে না।
কেন শিক্ষক সংকট: সাধারণ নীতিমালা অনুসারে প্রতি ১০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকতে হবে। আর প্রতি ২৫ শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম একজন পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী শিক্ষক থাকতে হবে। সরকারি মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ শর্ত পূরণ করতে পারছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেডিকেল কলেজগুলোয় শিক্ষক নিয়োগের সরকারি প্রক্রিয়া জটিল বলেই এমন সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, দেশে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষকের অভাব নেই। কিন্তু নিয়োগের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে। আবার কলেজগুলোর মান উন্নয়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে তিনি বলেন, প্রতিবছরই শূন্য পদের হিসাব নিতে অধিদপ্তরকে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু সেই ঘাটতি পূরণে কোনো ব্যবস্থা মন্ত্রণালয় নেয় না।

দ্রুত ঘাটতি পূরণের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের: ভালো চিকিৎসক তৈরি করতে হলে দ্রুত মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষকের ঘাটতি পূরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশে মেডিকেল কলেজ বাড়ানোর চেয়ে বর্তমান মেডিকেল কলেজে দক্ষ শিক্ষক বেশি প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান ও একুশে পদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, দক্ষ শিক্ষক তৈরি করতে না পারলে দক্ষ চিকিৎসক তৈরি হবে না। শুধু মেডিকেল কলেজের বড় বড় বিল্ডিং বানানোর চেয়ে মানসম্মত শিক্ষক বেশি জরুরি। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেই এটা সম্ভব। তিনি বলেন, ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে কোনো চিকিৎসককে আনতে হবে না। শুধু আমাদের দেশের ব্রিলিয়ান্ট চিকিৎসকদের যথাযথ মূল্যায়ন করলেই হবে। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার ও দেশের বিশিষ্ট সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. মো. সাঈদ এনাম বলেন, দক্ষ শিক্ষকের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিয়েই দক্ষ হতে হয়। চিকিৎসা শিক্ষার এক পর্যায়ে শিক্ষকের সঙ্গে রোগীদের পাশে যেয়ে যেয়ে ছাত্রদের হাতে কলমে শিখতে হয়। চিকিৎসা শিক্ষায় দক্ষ বিশেষজ্ঞরা বলেই থাকেন, পেশেন্ট ইজ দা লিভিং বুক, বুক ইজ ডেড পেশেন্ট। সুতরাং দক্ষ শিক্ষকের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিয়েই দক্ষ হতে হয়। সেক্ষেত্রে মেডিকেল কলেজে খোদ দক্ষ শিক্ষকই না থাকেন কিংবা তাহলে দক্ষ চিকিৎসক আশা করা অবান্তর।

Exit mobile version