স্বাস্থ্য খাত দেশের সর্বাধিক দুর্দশাগ্রস্ত খাতগুলোর একটি। এ খাতের দুর্দশা মোচনে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এখানে মোটাদাগে কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো।
এক. দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেও দুই যুগ ধরে মেডিকেল শিক্ষায় উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব, শিক্ষা উপকরণের অভাব, উপযুক্ত ল্যাব ও হাসপাতাল না থাকায় শিখনে ঘাটতি, উপযুক্ত হোস্টেলের অভাব এবং লেজুড়ভিত্তিক শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতির দৌরাত্ম্যসহ নানা কারণে তাদের বেশির ভাগ চিকিৎসক হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে তাদের বড় অংশের কাছে রোগীরা নিরাপদ নয়। তাই প্রথমে সরকারি ও বেসরকারি খাতে কর্মরত জুনিয়র থেকে মধ্যম সারির সব চিকিৎসককে ৬ থেকে ১২ মাসের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে এ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। রাষ্ট্রের ভুল নীতির জন্য শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পায়নি। তাই রাষ্ট্রকে এর খরচ বহন করতে হবে। জাতিকে রক্ষা করতে রাষ্ট্রকে এ খরচ করতেই হবে।
দুই. পোস্টগ্র্যাজুয়েট, এমবিবিএস, নার্সিং, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টসহ মেডিকেল শিক্ষার সব ক্ষেত্রে গুণগত মানের উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে উপযুক্ত শিক্ষক পদায়নসহ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
পাশাপাশি সরকারি–বেসরকারি সব মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ, আইএসটি, ম্যাটসসহ মেডিকেল শিক্ষার সব স্নাতক ও ডিপ্লোমাধারীকে মেডিকেল লাইসেন্সিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণের ভিত্তিতে মেডিকেল প্র্যাকটিসের অনুমতির ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য বিএমডিসিকে শক্তিশালী করে অতিসত্বর মেডিকেল লাইসেন্সিং পরীক্ষা এবং তা নবায়নের পরীক্ষা চালু করতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে কেবল চীন বা অন্য দেশ থেকে প্রাপ্ত মেডিকেল স্নাতকদের জন্য লাইসেন্সিং পরীক্ষা চালু করা হয়েছে।
তিন. কমিউনিটি ক্লিনিক আইন সংশোধন করে এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সেবাকে একীভূত করে প্রমোটিভ ও প্রিভেন্টিভ সেবার ওপর জোর দিয়ে জিপি সেন্টারের আদলে গ্রামীণ এলাকায় প্রাইমারি স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালু করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পারফরম্যান্সভিত্তিক ‘ক্যাপিটেশন অর্থায়ন’ পদ্ধতি, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ পদ্ধতি বা পারফরম্যান্সভিত্তিক পারিতোষিক দেওয়ার শর্তে চুক্তিভিত্তিক জনবল নিয়োগপদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।
চার. জেলা ও উপজেলা শহরে প্রতিটি ওয়ার্ডে একই আদলে একই ধরনের প্রাইমারি স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালু করতে হবে। আর মেট্রো-মেট্রোপলিটন শহরে ক্যাচমেন্ট এরিয়া নির্ধারণ করে একটি ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি’র ভিত্তিতে ‘কৌশলগত ক্রয়পদ্ধতি’ অনুসরণ করে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাইমারি স্বাস্থ্যসেবা ক্রয় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত এবং ইউনিসেফের অর্থায়নে বাস্তবায়নকৃত ‘আলো ক্লিনিক’ মডেলের বেনিফিট প্যাকেজ এবং স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।
উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে কাঠামোগত পরিবর্তন, উপযুক্ত জনবল নিয়োগ ও যন্ত্রপাতি সরবরাহের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার কার্যকর রেফারাল সেন্টার, সার্বক্ষণিক জরুরি সেবা ও সেকেন্ডারি সেবার শক্তিশালী কেন্দ্র হিসেবে এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করা, যেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও বেসিক সেকেন্ডারি সেবার জন্য জনগণকে অন্যত্র যেতে না হয়। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে সার্ভিস হাসপাতাল বিবেচনার পরিবর্তে কেবল মেডিকেল শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ হাসপাতাল হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
তাই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের মতো বেড সংখ্যার বেশি রোগী ভর্তির সুযোগ বন্ধ করতে হবে। বরং জেলা হাসপাতালকে সেকেন্ডারি চিকিৎসার হাব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কালে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের উদ্যোগে প্রণীত ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস স্ট্যান্ডার্ড বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
পাঁচ. হাসপাতালে সহায়ক জনবল নিয়োগ করার বর্তমান প্রচলিত ‘আউটসোর্সিং’ পদ্ধতি পরিবর্তন করে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি হাসপাতালে একটি উপযুক্ত কমিটির মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিকভাবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। আবার জেলার ভেতর তিন বছর পর ট্রান্সফারের বিধান রেখে আগের মতো স্থায়ী নিয়োগেও ফিরে যাওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রকিউরমেন্ট রুল কিংবা সার্ভিস রুলে কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন হলে তা করা যেতে পারে। অন্যদিকে নতুন নীতিমালা তৈরির ভিত্তিতে সম্পূর্ণ লাইনচ্যুত বেসরকারি খাতকে দ্রুত লাইনে ফিরিয়ে আনতে হবে। বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালের টেকনিক্যাল জনবলের কমপক্ষে ৭০ শতাংশ নিজস্ব জনবল হতে হবে।
ছয়. চিকিৎসার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য উচ্চতর হাসপাতালের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক রেফারাল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া কোনো বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রেশন প্রদান এবং তা নবায়ন করা যাবে না। এ দুটি শর্ত মেনে চলতে বাধ্য করলে যত্রতত্র এবং যেনতেনভাবে বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রচলন বন্ধ হবে।
সাত. স্বাস্থ্য খাতকে পথে আনতে অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ স্বাস্থ্য খাতের সব অঙ্গ সংস্থার সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে। আবার ব্যয়ভীতি দূর করে প্রদত্ত বরাদ্দ খরচে উৎসাহিত করতে স্বাস্থ্য খাতের জন্য প্রকিউরমেন্ট রুল ও অডিট পদ্ধতি সহজতর করতে হবে। তবে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর, মেডিকেল এডুকেশন অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এবং নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন কীভাবে হবে, তা ভাবনায় আনা কঠিন।
আট. মেডিকেল ক্যাডার ও স্বাস্থ্যসেবাকে সিভিল সার্ভিস থেকে আলাদা করে জুডিশিয়ারি সার্ভিসের মতো ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট এলাকার মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে সব সরকারি–বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক নিয়োগের বিধান চালু করতে হবে। ফলে একজন যেখানে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তাঁকে সেখানেই থাকতে হবে। এতে ট্রান্সফারের জন্য দৌড়ঝাঁপ বন্ধ হবে।
স্বাস্থ্য খাতে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে চারটি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করতে হবে—চিকিৎসা, মেডিকেল শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রশাসন ও জনস্বাস্থ্য। একজন ব্যক্তি যে ধারায় নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তাঁকে সে ধারাতেই সেবা প্রদান করতে হবে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য প্রশাসনকে এমনভাবে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালকেও জবাবদিহির আওতায় আনা যায়।
নয়. দেশের প্রত্যেক মানুষের কাছে একটি ইউনিক হেলথ আইডি প্রদান, হাসপাতাল অটোমেশন ব্যবস্থা চালু করা এবং সব নাগরিককে একই রকম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য বার্ষিক এক থেকে দুই লাখ টাকার ইনপেশেন্ট (হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যে সেবা নিতে হয়) স্বাস্থ্যসেবার বিধান রেখে পারিবারিক স্বাস্থ্য কার্ড প্রবর্তন করতে হবে। এতে জনগণের সাধারণ ইনপেশেন্ট সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি কার্যকর রেফারাল পদ্ধতি চালু করা সহজ হবে। আর বিকল্প অর্থায়নের মাধ্যমে (যেমন সরকারি থোক বরাদ্দ, প্রত্যেক ফোন গ্রাহক থেকে মাসে ১০, ২০ বা ৩০ টাকা সংগ্রহ, জনহিতৈষী ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের অনুদান ইত্যাদি) জরুরি সেবা ও দুরারোগ্য ব্যাধির সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
দশ. ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজারে সব ধরনের ওষুধের মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ১৯৮২ সালে প্রণীত ‘মার্ক আপ’ সংশোধন করে যৌক্তিকভাবে নতুন মার্ক আপ নির্ধারণ করা যেতে পারে। অন্যদিকে ওষুধের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য সব ধরনের ওষুধের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে বায়ো-একুইভ্যালেন্স বা বায়ো-সিমিলার টেস্ট চালুর ব্যবস্থা করতে হবে।
এসব বিষয় সম্পাদনের জন্য একটি ‘শক্তিশালী ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি’ গঠনের বিধান রেখে একটি ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে। আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার এসব বিষয় মাথায় রেখে স্বাস্থ্য খাতকে দ্রুত ঢেলে সাজাতে অগ্রগামী হবে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক