প্রথম বাঙ্গালি মুসলিম মহিলা চিকিৎ‍সক ডা. জোহরা বেগম কাজী

তিনি যখন চিকিৎসক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন তখন মেয়েরা নানা রকম অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের শিকার ছিল৷ অসুস্থ মেয়েরা চিকিৎসকের কাছে না যেয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নিত৷ কারণ তাদের ধারণা চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার চেয়ে মৃত্যুই ভাল৷ তখন অপচিকিত্‍সা আর বিনা চিকিৎ‍সায় মারা যেত মেয়েরা৷ মেয়েদের অধিকাংশ রোগকে জিন-ভূতের আছর বলে মনেকরত সবাই৷ সেসময় মেয়েরা মনেকরত বাড়ির বাইরে গিয়ে চিকিৎ‍সা করালে মেয়েদের ইজ্জত থাকেনা৷ একারণে মেয়েরা নিজের ইজ্জতকে বাঁচানোর জন্য বিনা চিকিৎ‍সায় মৃত্যুবরণ করত৷

তখন নারী চিকিৎ‍সকের কথা কারও পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না৷ কিন্তু এই অসম্ভব কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে ১৯৩৫ সালে আত্মপ্রকাশ করলেন প্রথম বাঙ্গালি মুসলিম মহিলা চিকিৎ‍সক ডা. জোহরা বেগম কাজী৷ এরকম করুণ পরিবেশের মধ্যে তিনি চিকিৎ‍সক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মেয়েদের চিকিৎ‍সা সেবা নিশ্চিত করতে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন৷ বিনা চিকিৎ‍সায় মেয়েদের অকাল মৃত্যু ঠেকাতে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনী বিভাগে স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগ খোলার প্রয়েজনীয়তা অনুভব করেন৷ তাঁরই প্রচেষ্টায় সেখানে স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগ খোলা হয়৷ সেই সময় মেয়ে রুগিরা যাতে হাসপাতালে আসে এবং সেখান থেকে চিকিৎ‍সা সেবা নিতে পারে সেজন্য ঢাকা মেডিকেলে তিনিই প্রথম মহিলাদের পৃথকভাবে চিকিৎ‍সা দেবার ব্যবস্থা করেন৷ ডা. জোহরা কাজী মহিলা রুগীদের বাড়ি বাড়ি যেতেন, তাদের ভূল ধারণাগুলি ভাঙ্গানোর চেষ্টা করতেন, তাদের রোগ সম্পর্কে বুঝাতেন এবং তাদেরকে এনে এই হাসপাতালে ভর্তি করাতেন৷ তিনি ঝাড়কুক ও ধর্মন্ধতা মুক্ত একটি সমাজ চেয়েছেন, যে সমাজে মেয়েদের চিকিৎ‍সা সেবা নিশ্চিত হবে৷ আর এজন্য তিনি চিকিত্‍সা সেবায় নিজের জীবন উত্‍সর্গ করেছেন৷

আজীবন চিকিৎ‍সা সেবায় নিয়োজিত ডা. জোহরা বেগম কাজী ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের মধ্য প্রদেশের রাজনান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন৷ বাংলাদেশের মাদারিপুর জেলার কালকিনি থানার গোপালপুর গ্রাম ছিল তাঁর আদি পৈত্রিক নিবাস৷ পিতার নাম ডাক্তার কাজী আব্দুস সাত্তার৷ তিনি ১৮৯৫ সালে মিডফোর্ড মেডিকেল স্কুল থেকে এলএমএফ এবং ১৯০৯ সালে কলেজ অব ফিজিশিয়ানস এন্ড সার্জনস অব ইন্ডিয়া থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন৷ তিনি ছিলেন কোরআনে হাফেজ ও মসজিদের ইমাম৷ নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন৷ মা মোসাম্মদ আঞ্জুমান নেসা৷ মা ছিলেন খুব সিদা সাদা প্রকৃতির৷ তাঁর মা রায়পুর পৌরসভার প্রথম মহিলা কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন৷ তাঁরা চারবোন ও দুই ভাই৷ বড় ভাই কাজী আসরাফ মাহমুদ৷ তাঁর বড় ভাই মাইক্রোবায়োলজিতে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন৷ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের অধ্যাপক এবং কবি হিসাবেও তাঁর বিশেষ খ্যাতি আছে৷ ছোট এক ভাই কাজী মোহসিন মাহবুব ও বড় দুই বোন অকালে মৃত্যুবরণ করেন৷ আর ছোট বোন ডাক্তার শিরিন কাজী৷ তিনি এদেশের দ্বিতীয় বাঙালি মহিলা চিকিৎ‍সক৷ ১৯৩৭ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন তিনি৷ ইংরেজী কবি হিসাবেও তাঁর খ্যাতি রয়েছে৷ ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির মহিলা কমিশনার নিযুক্ত হন৷

ছেলেবেলায় ডা. জোহরা বেগম কাজী তাঁর চিকিৎ‍সক বাবার সাথে ঘুরেছেন দেশময়৷ গরিব, দুস্থ আর অসহায় মানুষের-বিশেষ করে মহিলাদের যন্ত্রণাকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে৷ তাই সেই ছেলেবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখেছেন চিকিৎ‍সক হওয়ার৷ তাঁর এই স্বপ্নটা তখনকার সমাজের মেয়েদের জন্য দু:স্বপ্নের মতো ছিল৷ কারণ তখন মেয়েদের ঠিকমত স্কুলেই যেতে দেওয়া হত না৷ আর তিনি যে সময় চিকিৎ‍সা পেশায় আসেন সে সময় আমাদের দেশের অনেক ছেলেরা চিকিৎ‍সা বিদ্যা পড়া শুরুই করেনি৷ সেই কালে বিংশশতাব্দীর প্রায় শুরুতে একজন মুসলিম মহিলা চিকিৎ‍সা বিজ্ঞানে আগ্রহী হবেন এটা কল্পনা করাও যেত না৷

কিন্তু তিনি ছেলেবেলায় যে স্বপ্ন দেখেছেন সেই স্বপ্নের পিছনেই ছুটেছেন এবং ছুটতে ছুটতে একদিন সেই ছেলেবেলায় দেখা স্বপ্নটিই তাঁর জীবনে সত্যি হয়ে ধরা দেয়৷ তাঁর সেই স্বপ্নটা বাস্তবে রূপ পেতে শুরু করেছিল ১৯২৯ সাল থেকে৷ এই ১৯২৯ সালেই তিনি আলিগড় মুসলিম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বাঙালি মুসলিম আলিগড়িয়ান হিসাবে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাশ করেন৷ পড়ালেখায় ছিলেন খুব তুখোর৷ ক্লাসে সবসময় প্রথম হতেন ৷ কখনও দ্বিতীয় হতেননা৷ তিনি যখন রায়পুরায় খ্রীস্টানদের মিশনারী স্কুলে (স্কুলটির নাম বার্জিস মেমোরিয়াল গার্লস্ হাই স্কুল) চতুর্থ শ্রেণীতে পড়তেন তখন একদিন দুষ্টমী করে বললেন কংগ্রেসের আহ্বানে আগামী দিন সারা দেশের সব স্কুল বন্ধ থাকবে৷ কথাটি মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ামাত্র একটি আলাদা চাঞ্চল্যের ভাব দেখা দেয়৷ কথাটা শেষপর্যন্ত কর্তৃপক্ষের কান পর্যন্ত পৌঁছাল৷ পরে কর্তৃপক্ষ যখন জানতে পারলেন এটা জোহরা বেগম কাজীর মনগড়া কথা তখন তাঁর দুষ্টামির জন্য শাস্তি পেলেন তিনি৷ শাস্তিস্বরূপ তাঁর শিক্ষিক মিস সামিদা প্রতিদিন তাঁকে চার পৃষ্ঠা বাইবেল পড়তে দিলেন৷ তিনি অল্প সময়ের মধ্যে পুরা বাইবেলটাই মুখস্ত করে ফেললেন৷ একদিন শিক্ষক তাঁকে চার লাইন বাইবেলের অংশ মুখস্থ বলতে বললেন৷ তিনি গোটা বাইবেলই ধারাবাহিকভাবে পড়তে শুরু করলেন৷ তাঁর মেধা এবং আগ্রহ দেখে খুবই খুশি হলেন তিনি৷ এই মিশনারী স্কুল থেকে তিনি পরে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন৷ স্কলারশিপের টাকা দিয়ে তিনি সবসময় তাঁর পড়াশুনার খরচ চালিয়েছেন৷ তাঁর প্রিয় খেলা ছিল ব্যাডমিন্টন ও টেবিলটেনিস ৷ তিনি সাইকেল চালাতে পারতেন৷

আলিগড় মুসলিম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করার পর দিল্লির পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ‘লেডি হাডিং মেডিকেল কলেজ ফর ওমেন’ এ ভর্তি হন এবং সেখান থেকে প্রথম বাঙালি মুসলিম ছাত্রী হিসাবে প্রথমে এইচএসসি এবং পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমবিবিএস পাস করেন৷ তাঁকে ভাইসরয় সম্মানজনক ডিগ্রি প্রদান করা হয়৷ তিনি একমাত্র যিনি ইংল্যান্ড থেকে অনারারি এমআরসিইওজি পেয়েছেন৷ এছাড়া তাঁকে তঘমা-ই-পাকিস্তান খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল৷

তাঁর চিকিৎ‍সক হওয়ার পিছনে তাঁর মা-বাবার ভূমিকা ছিল অনেক বেশী৷ মেয়েদের পড়াশুনার ব্যাপারে জোহরার মা বাবার আগ্রহ ছিল খুব বেশী৷ আর তাই নিজের মেয়েকে সবসময় উৎ‍সাহ দিতেন৷ চিকিৎ‍সক হতে যেয়ে ডা. জোহরা বেগম কাজীকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে৷ তাঁর অনেক নিকট আত্নীয় বলেছেন তিনি চিকিৎ‍সক হয়ে নিজ বংশের মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছেন৷ কিন্তু সমস্ত বাধা আর গঞ্জনা অতিক্রম করে ১৯৩৫ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করার পর কর্মজীবনে প্রবেশ করেন৷ তিনি প্রথমে ইয়োথমাল ওয়েমেন্স (পাবলিক) হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে যোগদেন৷ এখানে তিনি দশ মাস ছিলেন৷ এরপর বিলাসপুর সরকারী হসপিটালে যোগ দেন৷ তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন ‘কর্মেই জীবনের সার্থকতা’৷ মানুষের সেবার জন্য মহাত্মা গান্ধী নির্মাণ করেন সেবাগ্রাম৷ এই সেবাগ্রামে অবৈতনিকভাবে কাজ করেন ডা. জোহরা বেগম কাজী৷ এছাড়াও তিনি ভারতের বিভিন্ন বেসরকারী ও সরকারী প্রতিষ্ঠানে ডাক্তার হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করেছেন৷

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন৷ ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে যোগ দেন৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় অবসর সময়ে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে অনারারি কর্ণেল হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন৷ মিডফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান ও অনারারি প্রফেসর ছিলেন৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় অবসর সময়ে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে অনারারি কর্নেল হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭৩ সালে চাকরি থেকে অবসর নেবার পর বেশকিছু বছর হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালে কনসালটেন্ট হিসাবে চিকিৎ‍সা সেবা প্রদান করেন৷ পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেলে অনারারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন৷

তিনি শিক্ষক হিসাবে বেশ কড়া ছিলেন কিন্তু ছাত্রদের খুব আগ্রহ সহকারে শেখাতেন৷ জোহুরা বেগম কাজী ছাত্রদেরকে খুব আপন মনে করতেন৷ তবে ছাত্ররা কখনও নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তিনি তাদেরকে কঠোরভাবে শাসন করতেন৷ নিজে ব্যক্তিগতভাবে নিয়মানুবর্তীতা মেনে চলতেন৷ সাতটার ক্লাস ঠিক সাতটায় শুরু হবে কখনও এক সেকেন্ড দেরী হবে না৷ ছাত্রদের পাশ করানোর ব্যাপারে তিনি মনে করতেন, কোন ছাত্র জানলেই শুধু পাশ করবে অন্যথায় নয়৷ তিনি ছাত্রদের সবসময় শিখাতে চাইতেন৷ ছাত্রদেরকে শেখানোর ব্যাপারে তাঁর কোন বিরক্তি ছিল না৷ ছাত্ররা কোন প্রশ্ন করলেও তিনি কখনও বিরক্ত হতেন না৷

চিকিৎ‍সক হিসাবে তাঁর খুব প্রশংসা ছিল৷ তিনি খুব আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎ‍সা সেবা দিতেন৷ তিনি খুব পরিশ্রমী চিকিৎ‍সক ছিলেন৷ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনে তিনি সহযোগিতা করেছেন৷ তবে রাজনীতিতে জড়িত কোন ছাত্রকে অবশ্যই পড়াশুনা করেই পাশ করতে হতো৷ সেইসময় কেন্দ্রীয় ভাবে ও সারা দেশব্যাপী পরিচিত অনেক ছাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করত ৷ ‘৫৮ সালে আইয়ুবের মার্শাল ল-র পরে তাদের অনেকেরই অবদান ছিল কিন্তু ছাত্র হিসাবে তাদের পাশ করতে হলে অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরা যে সময় দিত তার চেয়ে কম সময় দিলে কিছুতেই পাস করা সম্ভব ছিল না৷ এটাই ছিল তখনকার নিয়ম৷ আর এই নিয়ম সফল ভাবে পালন করেছিলেন তিনি৷ ছাত্ররা তাঁর ক্লাসে খুব মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনত৷

ডা. জোহরা বেগম কাজী কাউকে কিছু না জানিয়ে রাতে হাসপাতালে চলে যেতেন৷ রুগীদের যথাযথ চিকিৎ‍সা হচ্ছে কিনা তা দেখাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য৷ তাঁর কোন অবসর সময় ছিল না৷ অধ্যাপকদের নির্দিষ্ট কক্ষে তিনি সময় কাটাতেন না৷ সময় পেলে জুনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে তিনি ক্লাসের বিষয়বস্তু আলোচনা করতেন৷ তিনি সবসময় বলতেন এই পেশায় ফাঁকি বা অবহেলার অবকাশ নেই৷

কোনরূপ বিলাসিতা করতেন না তিনি৷ বিলাসিতা করা ছিল তাঁর কাছে নৈতিকতা বিরোধী কাজ৷ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরও বিদেশী সংস্কৃতি থেকে তিনি ছিলেন দূরে৷ তিনি প্রচার বিমুখ ছিলেন৷ অনেককে তিনি ডাক্তারি পড়িয়েছেন, অনেক গরীব ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছেন৷ সবার বিপদে আপদে উনি অবারিতভাবে সাহায্য করেছেন৷ অনেক রুগীকে তিনি নিজে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন৷ রুগীদের যাবার পয়সা না থাকলে তাদেরকে পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন৷ অনেক ছেলেমেয়েদের তিনি ডাক্তারি পড়িয়েছেন, বিদেশে পাঠিয়েছেন৷ তিনি দরিদ্র ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন৷ প্রতিবেশীদের কাছেও তিনি ছিলেন খুব প্রিয়৷ প্রতিবেশীরা কোন কাজের কথা বললে তিনি তা সঙ্গে সঙ্গে করে দিতেন৷

ডা. জোহরা বেগম কাজী প্রচুর পড়াশুনা করতেন৷ পড়াশুনা ছাড়া তাঁর আর কোনকিছুর প্রতি আগ্রহ ছিল না৷ তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গ্রামে যেয়ে মাদ্রাসার ছাত্রদের বলতেন তোমরা সবকিছু পড়বে৷ আমি ডাক্তার বলে শুধু ডাক্তারিই পড়তে হবে এমন কোন কথা নয়৷ তোমরা সবাই পড়বে৷ ১৯২০ সালের প্রেক্ষাপটে মুসলিমরা মনে করত সাধারণ স্কুলে পড়াশুনা করলে তাদের সন্তানরা খৃস্টান হয়ে যাবে৷ কিন্তু তিনি এই ধারণার সাথে একমত পোষণ করেননি৷ কারণ তিনি নিজে খ্রীস্টানদের স্কুলে পড়তেন৷ এই স্কুলের ছাত্রীনিবাসে ছিলেন তিনি৷ তিনি বাইবেল ক্লাসে যেতেন কিন্তু তাঁকে তো কেউ খ্রীস্টান বানাতে চায়নি৷

সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তিনি৷ মুমুর্ষু রুগিদের বাড়িতে যেয়ে খোঁজ খবর নিতেন এবং কোন রুগি মারা গেলে তিনি তার বাড়িতে ছুটে যেতেন ৷ তার পরিবারকে সান্ত্বনা দিতেন এবং প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য দিতেন৷ তিনি সবসময় তাঁর রুগিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন৷ চিকিৎ‍সক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করার পরও তিনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যপন করেছেন৷ তিনি নিজেকে একজন মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ হিন্দু, খ্রীস্টান বা মুসলমান এটা তাঁর কাছে কোন মুল্যবান কথা নয়৷ তিনি একজন মানুষ এটাই বড় কথা৷ তিনি সারাজীবন জাতপাতের উর্ধ্বে উঠে মানুষের সেবা করেছেন৷ এছাড়া রুগীর ব্যাপারে তিনি হিন্দু মুসলিম আলাদা করে দেখতেননা৷

মহাত্মা গান্ধীর পরিবারের সাথে তাঁদের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক৷ উভয় পরিবারের মধ্যে যাতায়াতও ছিল৷ একসময় মহাত্না গান্ধী প্রতিষ্ঠিত সেবাগ্রাম আশ্রমে তিনি, তাঁর বাবা এবং তাঁর ছোট বোন বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎ‍সা সেবা প্রদান করেছেন৷ গান্ধী পরিবারের সাথে তাঁদের সম্পর্ক এতটাই সুগভীর ছিল যে গান্ধী এবং তাঁর স্ত্রী, তাঁদের পাশে বসে বিভিন্ন খাবার পরিবেশন করতেন৷ তাঁর ছোট বোনের বিয়েতে পিতার অবর্তমানে মহাত্না গান্ধী কন্যা সম্প্রদান করেন৷ কোন কারণে দুই পরিবারের সাথে দেখাসাক্ষাতে বিলম্ব হলে মহাত্না গান্ধী তাঁদের চিঠি দিতেন৷ চিঠিগুলি বর্তমানে জাতীয় মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে৷

দেশ বরেণ্য অনেক ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যেও এসেছেন ডা. জোহরা বেগম কাজী ৷ তাদের মধ্যে কমরেড মোজাফফর আহমেদ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সুফিয়া কামাল৷ শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন তাঁর মামা৷ তাঁর মার খালাত ভাই ছিলেন তিনি৷ কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন তাঁর বড় ভাই কাজী আসরাফ মাহমুদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু৷ নজরুল ইসলাম এসে তাঁদের বাড়িতে ছিলেন এবং যাওয়ার সময় তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি করবে? উত্তরে তিনি বলেন- আমি পড়ব, পড়াব এবং লোকের সেবা করব৷ নজরুল ইসলাম তাঁকে দোওয়া করে গেলেন৷ জোহরা বেগম কাজীর আত্মবিশ্বাস ছিল খুব বেশি৷ আর তাইতো তিনি জীবনের শেষ পর্যায়ে অসুস্থ অবস্থায় এসেও বিশ্বাস করতেন সুযোগ পেলে আজও তিনি চিকিৎ‍সা করতে পারবেন৷

রাজনীতির সংগে তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠতা ছিল৷ কয়েকপুরুষ যাবত তাঁর পরিবারের সাথে বামপন্থী আন্দোলনের মানুষদের সম্পর্ক ছিল৷ একারণে তিনি নিজেও রাজনীতি সচেতন ছিলেন৷ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করলে গুলিবিদ্ধ ছাত্রদেরকে তিনি জরুরি চিকিৎ‍সা দেন এবং নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক ছাত্রদের তিনি নিরাপদে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন৷

১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি সহযোগিতা করেছেন তিনি৷ ‘৬০ এর দশকে আইয়ুবের সামরিক শাসন বিরোধী যে উত্তাল ছাত্র আন্দোলন চলছিল সেই আন্দোলনকে তিনি সমর্থন করেছিলেন৷ ৬০ এর দশকে যখন ছাত্রাবাসগুলিতে পুলিশি হামলা হয়েছে তখন মহিলা ছাত্রাবাসের দায়িত্ব তাঁর হাতে ছিল৷ সেইসময় মেয়েদের রক্ষাকরার একটা বড় দায় তিনি নিয়েছিলেন৷

তিনি শিক্ষা বিস্তারের আশা নিয়ে নরশিংদির রায়পুরের হাতিরদিয়া গ্রামের জমিদার পরিবারর সদস্য, সমাজসেবক ও সাবেক এমপি রাজউদ্দিন ভুঁইয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন৷ তাঁরই পৃষ্টপোষকতায় সেখানে নির্মিত হয় স্কুল ও কলেজ৷ শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য৷ ৷ বৈবাহিক জীবনে নিঃসন্তান হলেও দুইমাস বয়সে পারিবারিক বন্ধুর ভাগ্নে আবিদ ইকবালকে পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন৷

২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর তিনি ৯৭ বত্‍সর বয়সে শেষ নি;শ্বাস ত্যাগ করেন৷ প্রথম বাঙ্গালী মহিলা চিকিৎ‍সক ডা. জোহরা বেগম কাজী মেয়েদের বিভিন্ন কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে তাদেরকে আলোর পথ দেখিয়েছেন৷ তিনি মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন৷ সমাজ থেকে অজ্ঞতা দূর করার জন্য তিনি দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করেছেন ৷ এই মহীয়সী নারী তাঁর কর্মের মাধ্যমে আমাদেরকে আলোর পথ দেখাবেন সবসময়৷

সংক্ষিপ্ত জীবনী:

জন্ম: ডা. জোহরা বেগম কাজী ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের মধ্য প্রদেশের রাজনান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন৷

মা ও বাবা: পিতার নাম ডাক্তার কাজী আব্দুস সাত্তার ও মা মোসাম্মদ আঞ্জুমান নেসা৷

পড়াশুনা: ১৯২৯ সালেই তিনি আলিগড় মুসলিম মহিলা স্কুল থেকে প্রথম বাঙালি মুসলিম আলিগড়িয়ান হিসাবে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাশ করেন৷ ১৯৩৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমবিবিএস পাস করেন৷

কর্মজীবন: ১৯৩৫ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করার পর কর্মজীবনে প্রবেশ করেন৷ তিনি প্রথমে ইয়োথমাল ওয়েমেন্স(পাবলিক) হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে যোগদেন৷ এখানে তিনি দশ মাস ছিলেন৷ এরপর বিলাসপুর সরকারী হসপিটালে যোগ দেন৷ তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন ‘কর্মেই জীবনের সার্থকতা’৷ মানুষের সেবার জন্য মহাত্মা গান্ধী নির্মাণ করেন সেবাগ্রাম৷ এই সেবাগ্রামে অবৈতনিকভাবে কাজ করেন ডা.জোহরা বেগম কাজী৷ এছাড়াও তিনি ভারতের বিভিন্ন বেসরকারী ও সরকারী প্রতিষ্ঠানে ডাক্তার হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করেছেন৷

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন৷ ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে যোগ দেন৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় অবসর সময়ে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে অনারারি কর্ণেল হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন৷ মিডফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান ও অনারারি প্রফেসর ছিলেন৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় অবসর সময়ে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে অনারারি কর্নেল হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭৩ সালে চাকরি থেকে অবসর নেবার পর বেশকিছু বছর হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালে কনসালটেন্ট হিসাবে চিকিৎ‍সা সেবা প্রদান করেন৷ পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেলে অনারারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন৷

বিয়ে: নরশিংদির রায়পুরের হাতিরদিয়া গ্রামের জমিদার পরিবারর সদস্য, সমাজসেবক ও সাবেক এমপি রাজউদ্দিন ভুঁইয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন৷ বৈবাহিক জীবনে নিঃসন্তান হলেও দুইমাস বয়সে পারিবারিক বন্ধুর ভাগ্নে আবিদ ইকবালকে পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন৷

মৃত্যু: ২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর তিনি ৯৭ বৎ‍সর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷

তথ্যসূত্র: ডা. জোহরা বেগম কাজীর উপর লেজার ভিসন কর্তৃক নির্মিত প্রামাণ্য চিত্রের সিডি৷ গ্রন্থণা, চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা ও পরিচালনা- মাহবুবুল আলম তারু৷;
মেহেরুন্নেসা মেরীর লেখা অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী, প্রকাশক- এইচ. এম. ইব্রাহিম খলিল, ন্যাশনাল পাবলিকেশন৷

সুত্র: গুণিজন ডটওআরজি

Exit mobile version