এনজিওনির্ভর এইডস চিকিৎসা!

এইচআইভি/এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাতে পারছে না। কারণ, এসব পরীক্ষা ব্যয়বহুল এবং পরীক্ষার সুযোগও সীমিত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসার পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে কয়েকটি এনজিওর ওপর। অভিযোগ উঠেছে, চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে এইডস রোগীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব কারণে দেশে এইচআইভি/এইডসের ঝুঁকি বাড়ছে।
সরকারের জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, দেশের ৪৫২ জন এইডস রোগীকে নিয়মিত এআরভি (অ্যান্টিরেট্রোবাইরাল) ওষুধ দেয় আশার আলো সোসাইটি, মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ ও কনফিডেনশিয়াল অ্যাপ্রোচ টু এইডস প্রিভেনশন (ক্যাপ) নামের তিনটি এনজিও। এইডস রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার দায়িত্বও এনজিওদের।
জাতিসংঘের এইডসবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনএইডসের দেশীয় সমন্বয়কারী সলিল পানাকাডান প্রথম আলোকে বলেন, এইডস রোগীদের চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারেরই নেওয়া উচিত। এনজিওরা বিদেশি অর্থসাহায্য নিয়ে রোগীদের সেবা করছে। বিদেশি অর্থ বন্ধ হলে এনজিওদের সেবা বন্ধ হয়ে যাবে।
পরিস্থিতি: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে এইচআইভি-সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা ১২ হাজার। জাতীয় কর্মসূচি গত বছরের ১ ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবসে জানিয়েছিল, দেশে শনাক্ত হয়েছে এমন সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা এক হাজার ৭৪৫ জন। এদের মধ্যে এইডস রোগী ৬১৯ জন। এরই মধ্যে ২০৪ জন মারা গেছে। দেশে প্রথম এইচআইভি-সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে এইচআইভির প্রাদুর্ভাব এখনো সীমিত পর্যায়ে আছে, বর্তমানে তা ১ শতাংশেরও নিচে। কিন্তু সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের একটি এলাকায় শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে এই হার ১০ শতাংশের বেশি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরাস বিশেষজ্ঞ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ কোনো রোগে আক্রান্ত হলে তাকে কেন্দ্রীভূত মহামারি (কনসেন্ট্রেটেড এপিডেমিক) বলা হয়। এর ভয় হচ্ছে, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী থেকে রোগ দ্রুত সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
চিকিৎসার আয়োজন: সরকারি সূত্র বলছে, দেশে এইচআইভি পরীক্ষার ৯৬টি ভিসিটি কেন্দ্র (ভলান্টারি কাউন্সেলিং অ্যান্ড টেস্টিং) আছে। এসব কেন্দ্রে বিনা মূল্যে রক্তে এইচআইভি ভাইরাস পরীক্ষা করা হয়। কেন্দ্রগুলো চালাচ্ছে কয়েকটি এনজিও।
এসব কেন্দ্র মূলত নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকেন্দ্রিক। যেমন, কিছু কেন্দ্রে শুধু যৌনকর্মীদের, আবার কিছু কেন্দ্রে হিজড়াদের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। সাধারণ মানুষের জন্য এ রকম কেন্দ্রের সংখ্যা খুবই কম এবং সেগুলো শুধু ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম শহরে।
সূত্র জানায়, এইচআইভি/এইডস রোগ পরীক্ষা ও চিকিৎসার পুরোটাই হচ্ছে জেনেভাভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফান্ডের আর্থিক সহায়তায়। এআরভি কেনারও অর্থ দিচ্ছে গ্লোবাল ফান্ড। বর্তমান ধারায় ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত এই অর্থ পাওয়া যাবে।
আশার আলো সোসাইটির নির্বাহী প্রধান হাবিবা আক্তার বলেন, সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হয় সিডি-ফোর পরীক্ষার ক্ষেত্রে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল; আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং ক্যাপ—এই তিনটি জায়গায় সিডি-ফোর পরীক্ষা করা হয়। আইসিডিডিআরবিতে ফি দিতে হয় দুই হাজার ৫০০ টাকা, বাকি দুটোয় এক হাজার টাকা করে।
নজরুল ইসলাম বলেন, সিডি-ফোর রক্তের শ্বেত কণিকার একটি উপাদান। প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে সাধারণত ৯০০ থেকে ১২০০ সিডি-ফোর থাকে। এইচআইভি-আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে সিডি-ফোর উপাদান কমতে থাকে এবং মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। রক্তে সিডি-ফোরের পরিমাণ ২০০-এর নিচে নেমে গেলে তাকে এআরভি দিতে হয়। আবার সিডি-ফোরের পরিমাণ ২০০ থেকে ৩৫০-এর মধ্যে থাকলে এবং কোনো একটি রোগের লক্ষণ দেখা দিলে (যেমন, ডায়রিয়া) তাকে এআরভি দিতে হয়।
হাবিবা বলেন, ঢাকার বাইরে সিডি-ফোর পরিমাপের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় অনেক অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে এইচআইভি-সংক্রমিত ব্যক্তিদের। তিনি বলেন, এইচআইভি-সংক্রমিত ব্যক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে, অন্য রোগে আক্রান্ত হলে তার সিডি-ফোর পরীক্ষা করার দরকার হয়। এ অবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তিকে ঢাকায় আনা সম্ভব হয় না, অনেকে আসতে চায় না। তিনি বলেন, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে এইচআইভি-আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেশি বলে এই দুটি অঞ্চলে সিডি-ফোর পরীক্ষার যন্ত্র বসানো দরকার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সরকার এরই মধ্যে আটটি সিডি-ফোর পরীক্ষার যন্ত্র কিনেছে। এসব যন্ত্র আটটি সরকারি মেডিকেল কলেজে স্থাপন করার কথা থাকলেও তা এখনো করা হয়নি। অন্যদিকে এসব যন্ত্র চালানোর লোকবলও নেই।
বৈষম্যের অভিযোগ: যশোরের এক দম্পতি এইচআইভিতে সংক্রমিত। এ জন্য জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল একজনের চোখে অস্ত্রোপচার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এই দম্পতিকে চিকিৎসা-সহায়তা দিচ্ছে আশার আলো সোসাইটি। এই সংস্থার নির্বাহী প্রধান হাবিবা আক্তার বলেন, এইচআইভি-আক্রান্তের বিষয়টি জানানো উচিত মনে করে গত ১২ জুলাই তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে তা জানান। কিন্তু বিষয়টি জানার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চোখে অস্ত্রোপচার করতে অস্বীকৃতি জানায়।
এ ব্যাপারে জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউটের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এইচআইভি-সংক্রমিত বা এইডস রোগীর অস্ত্রোপচারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এ প্রতিষ্ঠানে নেই। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক দীন মোহাম্মদ নূরুল হক বলেন, এ বিষয়ে তিনি অবগত নন। খোঁজ নিয়ে পরে জানাবেন।
হাবিবা বলেন, একই ধরনের অজুহাত দেখিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েক মাস আগে এক মহিলার অ্যাপেন্ডিসাইটিসের অস্ত্রোপচারে অস্বীকৃতি জানান চিকিৎসকেরা।

এ ব্যাপারে নজরুল ইসলাম বলেন, এইচআইভি/এইডসকে সরকারের মূলধারার চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত না করলে এ ধরনের বৈষম্য হবেই। তিনি বলেন, এখন এনজিওরা কোন ধরনের সেবা দিচ্ছে, তা দেখারও কেউ নেই। প্রকল্পের টাকা শেষ হলেই এনজিওরা সেবা বন্ধ করে দেবে। তিনি বলেন, সরকারকে দায়িত্ব নিতেই হবে।
সুত্র : প্রথম আলো

Exit mobile version