সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে শনাক্ত হওয়া এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬১৯। এর আগে এইডসে মারা গেছেন ২০৪ জন। এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৭৪৫ জন। তবে সরকারের ধারণা, দেশে সাত হাজার ৭০০ জন এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তি থাকতে পারে। তবে বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে বাংলাদেশে এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা ১২ হাজারের মতো। এইডস আক্রান্ত ৪৫২ জনকে কয়েকটি সংস্থা থেকে বিশেষ সেবা দেওয়া হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকারি এ হিসাব চালু থাকলেও আজ ১ ডিসেম্বর ‘বিশ্ব এইডস দিবস ২০১০’-এ
আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হবে নতুন পরিসংখ্যানযুক্ত প্রতিবেদন। সেখানে পাওয়া যাবে নতুন চিত্র। এমন পরিস্থিতিতে এবারের বিশ্ব এইডস দিবস সামনে রেখে আয়োজিত বিভিন্ন পর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠক, সেমিনার-সভার আলোচনায় প্রায় একই অভিযোগ তোলা হচ্ছে, এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে সরকারের দিক থেকে যথেষ্ট গুরুত্ব নেই। রাজনৈতিক অঙ্গন ও সংসদে এ বিষয়টি উপেক্ষিত বলেও আলোচনা হচ্ছে। সবখানেই উঠছে এক দাবি_এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধের ইস্যুটিকে একপাশে ফেলে না রেখে মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একে জাতীয় পরিকল্পনার মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন পর্যন্ত এইচআইভি ও এইডস আক্রান্তের হার তুলনামূলক কম থাকলেও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী যেভাবে বাড়ছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। তাই কেবল বিদেশি নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজস্ব আঙ্গিকে কার্যক্রম চালানোর ক্ষমতা তৈরি করা প্রয়োজন।
জাতীয় অধ্যাপক ও দেশে এইডস প্রতিরোধের জন্য গঠিত প্রথম জাতীয় কমিটির সভাপতি ডা. নুরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, এইচআইভি/এইডস বিপদ থেকে মুক্ত থাকার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ এখনো দেখা যাচ্ছে না। সরকারের নীতিনির্ধারকদের উচিত বিষয়টিকে আরো অধিক গুরুত্ব দেওয়া। নয়তো পরে এটা রোধ করা কঠিন হবে। তবে তিনি সরকারের পদক্ষেপের পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ারও আহ্বান জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন বলেন, প্রায় এক যুগ ধরে দেখে আসছি এ কার্যক্রম চলছে ঢিমে তালে। সরকারি-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে কার্যকর উদ্যোগ খুবই কম। যদিও সরকার এবার পাঠ্য বইয়ে এইচআইভি/এইডসের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছে। এখন সংসদে আলোচনা, জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয়তা, জাতীয় পরিকল্পনার মধ্যে একে আরো বেশি গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। কারণ এইচআইভি/এইডস ইস্যুটি এখন বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক গতকাল কালের কণ্ঠের কাছে এ উদ্বেগের কথা স্বীকার করলেও সরকারের তরফ থেকে বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দেওয়ার অভিযোগ মানতে নারাজ। তিনি উল্টো প্রশ্ন তোলেন, যদি সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব না দিয়ে থাকে তবে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে এইচআইভি ও এইডস আক্রান্তের সংখ্যা এত কম থাকল কী করে?
মন্ত্রীর প্রশ্ন অনুসারে কী করে এইচআইভি ও এইডস আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে, তা খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, এক দশক ধরে এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে বিভিন্ন বিদেশি সাহায্য সংস্থা কখনো সরকারকে সঙ্গে নিয়ে আবার কখনো নিজেরা এককভাবে সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী খুঁজে বের করা, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, নিরাপদ যৌন সম্পর্ক, নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন, আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুর্নবাসন সেবা দেওয়ার কার্যক্রম চলাচ্ছে। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কয়েকটি সংস্থা বাংলাদেশে এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে ব্যয়বহুল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেবল এসব কার্যক্রমের ক্ষেত্রবিশেষ সমন্বয়, পর্যবেক্ষণ বা পরিসংখ্যান ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে আসছে।
সরকারের জাতীয় এইচআইভি/এসটিডি ও সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন প্রোগ্রাম সূত্র থেকে জানা গেছে, এইচআইভি/এইডসের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের চলমান এইচএনপিএসপির (হেলথ, নিউট্রিশন পপুলেশন সেক্টর প্রোগ্রাম) আওতায় এইচএআইএস (এইচআইভি/এইডস ইন্টারভেশন সার্ভিস) প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ৩৫৮টি ডিআইসিতে শ্রেণীবিন্যাসের মাধ্যমে এনজেক্ট ড্রাগ ইউজার, নারী যৌনকর্মী, পুরুষ সমকামী, হিজড়া যৌনকর্মী নিয়ে কাজ চলছে। একই সঙ্গে ৩৯ উপজেলায় ২১৫টি এলইসি ক্লাব ও ১০২টি ভিসিটি রয়েছে। এ ছাড়া চালু আছে ইয়ুথ-ফ্রেন্ডলি হেলথ সার্ভিসের আওতায় ২২৪টি হেলথ সার্ভিস ডেলিভারি পয়েন্ট (এইচএসডিপি)। এই এইচএসডিপিতে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের যে কেউ চিকিৎসা সহায়তা নিতে পারে। এসবের বাইরে সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে মোট ১৪৬টি রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্র চালু আছে। আরো ৫৬টি তৈরির প্রক্রিয়া চলছে।
জাতীয় এইচআইভি/এসটিডি ও সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন প্রোগ্রামের ভারপ্রাপ্ত লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. আবদুল ওয়াহিদ বলেন, ‘আমাদের কার্যক্রম থেমে নেই, তবে এটাতে আরো গুরুত্ব দেওয়া দরকার।’ একই প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ডা. হাসান মাহমুদ বলেন, শুধু পলিসিতে অন্তর্ভুক্ত করলেই হবে না, বাজেটে এ খাতে বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
ইউএনএইডস, বাংলাদেশের সামাজিক আন্দোলন বিভাগের উপদেষ্টা ড. মনির আহম্মেদ বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সেবা ও মানবাধিকারের সমন্বিত কার্যক্রম। বিষয়টিকে মূল ধারায় নিয়ে আসার জন্য সংসদেও আলোচনা হওয়া দরকার। কিন্তু এখানে অনেকটা এসব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়।
সেঙ্ ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের সভাপতি জয়া শিকদার বলেন, মোট ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর (যৌনকর্মী, সমকামী, হিজড়া, শিরায় মাদকসেবী) প্রকৃত কোনো হিসাব না থাকলেও আলোচনা আছে, এ সংখ্যা সারা দেশে ছয় লাখের মতো। অথচ এ জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় সরকারের নিজস্ব তেমন কোনো কাজ নেই।
ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের জাতীয় কর্মসূচি কর্মকর্তা ড. এজাজুল হক বলেন, যেভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী বাড়ছে সেই তুলনায় এইচআইভি/এইডসবিরোধী কার্যক্রম পর্যাপ্ত নয়, এটাকে সরকারের পরিকল্পনার মূল ধারায় নিয়ে এলে এ কার্যক্রমের আরো গতি বাড়বে।
আইসিডিডিআর-বাংলাদেশের গবেষক ড. তাসনিম আজিম বলেন, সারা দেশে মাঠপর্যায়ে এক জরিপ চালিয়ে এখন পর্যন্ত দেশে মোট এক লাখ ৪৩ হাজার পুরুষ সমকামী ও ৯ হাজার হিজড়ার খোঁজ পাওয়া গেছে। এর বাইরে এ শ্রেণীর আরো জনগোষ্ঠী থাকা স্বাভাবিক।
নারী যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্জয় নারী সংঘের সভানেত্রী শাহানাজ বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, নারী যৌনকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় থাকে পথযৌনকর্মীরা। তারা যেমন সামাজিকভাবেও বেশি অনিরাপদ, তেমনি চিকিৎসার দিক থেকেও অনিরাপদ। কারণ তারা পথেঘাটে থাকে বলে পর্যাপ্ত নিরাপদ যৌনকর্মের সুযোগ পায় না। অন্য যৌনকর্মীরাও বিভিন্ন ভয়ে সরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যেতে চায় না। রক্ত পরীক্ষার জন্য গেলে নানা অজুহাতে তাদের হয়রানি করা হয়।
জাতীয় এইচআইভি/এসটিডি কর্মসূচি সূত্র জানায়, দেশে এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যে ৪৫২ জন চিকিৎসা, কাউন্সেলিং, পুনর্বাসনসহ বিশেষ সেবার আওতায় রয়েছে, তাদের মধ্যে ২৮৪ জন পুরুষ, ১৪৭ জন নারী ও ২১টি শিশু রয়েছে। এর মধ্যে গ্লোবাল ফান্ডের আওতায় মোট ৩৭১ জনকে এবং বাকি ৮১ জনকে সুইস রেড ক্রসের মাধ্যমে এসব সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
এইডস দিবসের কর্মসূচি : এবারের বিশ্ব এইডস দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘সবার জন্য সুযোগ ও মানবাধিকার’। এ উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন শোভাযাত্রা, সেমিনারসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে। আজ সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ের পূর্ব পাশ থেকে এইডসবিরোধী শোভাযাত্রা শুরু হবে। সাড়ে ১০টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক সেমিনারে বাংলাদেশে বর্তমান এইডস পরিস্থিতির ওপর একটি বিশেষ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে।
রাষ্ট্রপতির বাণী : রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে বলেছেন, মরণব্যাধি এইডস আজ বিশ্ব মানবতার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয়াবহ এই রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। আমি মনে করি, সামাজিক কুসংস্কার দূর করে, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে এবং পারিবারিক বন্ধনকে আরো সুসংহত করতে পারলে এ রোগ থেকে আমরা দূরে থাকতে পারব।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী : বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বাণীতে বলেছেন, বাংলাদেশে এইডসের সংক্রমণের হার অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। এর প্রকোপ আরো হ্রাস করতে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে নানা রকম কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দাতাগোষ্ঠী, বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।