Home স্বাস্থ্য সংবাদ‘অ্যান্টিবায়োটিকের নির্বিচার ব্যবহার উদ্বেগজনক’

‘অ্যান্টিবায়োটিকের নির্বিচার ব্যবহার উদ্বেগজনক’

by স্বাস্থ্য ডটটিভি কনটেন্ট কাউন্সিলর

অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল ব্যবহার অথবা ফুল কোর্স ওষুধ না খাওয়ার কারণে ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত দেহকোষ ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে যাচ্ছে। সাশ্রয়ী মূল্য ও স্বল্পমাত্রার (প্রথম ধাপের) অ্যান্টিবায়োটিকগুলো এখন আর কাজ করছে না। উচ্চমূল্যের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে চিকিৎসা ব্যয় কয়েকগুণ বেশি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, এ অবস্থার জন্য চিকিৎসক ও রোগী দু’পক্ষই দায়ী। চিকিৎসকরা সঠিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই দ্রুত রোগ সারাতে দ্বিতীয়/তৃতীয় ধাপের অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিচ্ছেন। অন্যদিকে রোগীরা কয়েক ডোজ সেবনের পর কিছুটা সুস্থ বোধ করলেই ফুল কোর্স সেবন না করে ওষুধ ত্যাগ করছেন। এ অবস্থায় আজ সারাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য_ ‘অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা ও এর বিশ্বব্যাপী বিস্তার’।

ওষুধ প্রযুক্তিবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, পাইপলাইনে খুব বেশি অ্যান্টিবায়োটিক নেই। অপেক্ষাকৃত কম লাভের কারণে ওষুধ শিল্প মালিকরা এ খাতে গবেষণা বাড়াতে রাজি নন। তাই সচেতন হতে হবে চিকিৎসক এবং রোগীকেই। অন্যথায় উচ্চ অ্যান্টিবায়োটিকগুলো অকার্যকর হয়ে ভবিষ্যতে ব্যাপক মৃত্যু ডেকে আনবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবি্লউএইচও) বলেছে, ব্যবস্থাপত্রে প্রায় ৫০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক অপ্রয়োজনে লেখা ও ফার্মেসি থেকে বিক্রি হচ্ছে। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগীরা যথাযথ পদ্ধতি মেনে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান সমকালকে বলেন, এভাবেই তৈরি হচ্ছে ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এরা পরিবেশে ছড়ায়। তখন সমমানের অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না।

একাধিক ওষুধ প্রযুক্তিবিদ সমকালকে বলেন, হাতুড়ে ডাক্তাররা তো বটেই, এমনকি এমবিবিএস ডিগ্রিধারীরাও অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ও পরিমিত ব্যবহার সম্পর্কে জানেন না। দ্রুত রোগ সারিয়ে সুনাম অর্জনে উচ্চ অ্যান্টিবায়োটিক লিখছেন তারা। এক্ষেত্রে রোগীর ক্ষতির কথা বিবেচনায় থাকছে না।

বিএসএমএমইউর নবজাতক বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোঃ শহীদুল্লা বলেন, ওয়ার্ডের আইসিইউতে আগে নবজাতকের টাইফয়েড অ্যামোক্সিসিলিন দিয়ে চিকিৎসা করেছি। পরে সিপ্রোফ্লক্সাসিন, সেফরাক্সিন ব্যবহৃত হলেও এখন তা ব্যর্থ হচ্ছে। তিনি বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অবস্থা শুরু হয়ে গেছে।

গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দেশের ছয়টি জেলা হাসপাতালে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ইকোলাই, স্টেফ অরিয়াস ও সিউডোমোনাস ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর কার্যকারিতা কমে গেছে। জরিপকাজের সহ-গবেষক ও ঢাবির ফার্মাসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক সমকালকে বলেন, বর্তমানে দেশে ১১টি অ্যান্টিবায়োটিক গ্রুপ বেশি ব্যবহার হচ্ছে। তার মধ্যে অর্ধেকই সংবেদনশীলতা হারিয়েছে।

গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তারদের ওপর আইসিডিআরবি পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই ভুল ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। সাত শতাংশ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ও পরামর্শের কারণে ওষুধ প্রতিরোধী অবস্থা তৈরি হচ্ছে।

ডবি্লউএইচও বাংলাদেশ অফিসের মেডিকেল অফিসার (টিবি) ডা. এরউইন কোরম্যান বলেন, নিয়মমতো ফুলকোর্স ওষুধ সেবন না করায় সাধারণ যক্ষ্মা ওষুধ প্রতিরোধী (এমডিআর টিবি) হয়ে যাচ্ছে। এক্সডিআর টিবি হলে মৃত্যু ঠেকানো যায় না। অ্যান্টিভাইরালের ভুল ব্যবহারে প্রায় ১০ শতাংশ এইচআইভি রোগী ওষুধ প্রতিরোধী হচ্ছে।

ওষুধ বিশেষজ্ঞরা জানান, অযৌক্তিক ব্যবহারের ফলে পেনিসিলিন গ্রুপের এমোক্সিসিলিন, ক্লক্সাসিলিন, ফ্লুক্লক্সাসিলিনি, এমপিসিলিন ওষুধগুলো ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই কাজ করছে না। সেফিক্সিন, সেফরাডিন, লিভোফ্লক্সাসিন, জেন্টামাইসিন, সেফরিঅ্যাক্সন গ্রুপের ওষুধও অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। স্বল্পদিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকায় ফার্মেসি চালান আবুল কালাম আজাদ। তিনি নিজেই জ্বর-সর্দি-কাশি সারাতে ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা মূল্যের অ্যাজিথ্রোমাইসিন সেবন করেন বলে এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন। রোগীদেরও তাই দেন; কিন্তু বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতিরোধী না হলে সর্বোচ্চ ১০ টাকা মূল্যের অ্যান্টিবায়োটিকে জ্বর-সর্দি সেরে যাবে। সে হিসাবে ব্যয় চারগুণ বেশি হচ্ছে। রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় প্রাইভেট প্র্যাকটিসরত এক চিকিৎসক দাবি করেন, বাধ্য হয়ে উচ্চ অ্যান্টিবায়োটিক লিখি। রোগ সারতে দেরি হলে রোগীরা ক্ষেপে যায়; কিন্তু এ দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন ফার্মাকোলজি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, রোগী স্বভাবতই দ্রুত সেরে উঠতে চাইবে। বাছ-বিচারের দায়িত্বটি সর্বাগ্রে চিকিৎসকের।

অ্যান্টিবায়োটিক গাইডলাইন নেই :দেশে ডাক্তারদের জন্য জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক গাইডলাইন নেই। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রোগ অনুযায়ী সবচেয়ে উপযুক্ত ও নিরাপদ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হয়। এ জন্য বিভিন্ন দেশে নীতিমালা আছে; কিন্তু এদেশে জাতীয়ভাবে কখনোই তা হয়নি। ফার্মেসিতে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে ওষুধের সেবনবিধি বুঝিয়ে বলতে ফার্মাসিস্টরা কাজ করলেও এদেশে তা নেই। ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, এ চিত্রটি অত্যন্ত ভয়াবহ। অযৌক্তিক ব্যবহারে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতার মাশুল গুনবে আমাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিরা।

ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজিতে ২০০৮ সালে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে বলা হয়েছে, প্রতিরোধী অবস্থা যাতে তৈরি না হয় সে জন্য সব ডাক্তারকে অবশ্যই অ্যান্টিবায়োটিকের মৌলিক বিষয়াদি, উপযোগিতা ও সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে হবে। একাধিক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার ফল ডাক্তারের জন্য সহজলভ্য করা উচিত।

নামমাত্র গাইডলাইন :বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২০০৬ সালে তৈরি করা অ্যান্টিবায়োটিক গাইডলাইনটি কেবল নামেই আছে। সিনিয়র চিকিৎসকরা এটি জানলেও অপেক্ষাকৃত নবীনদের অনেকেই গাইডলাইনটি কোনোদিন দেখেননি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রত্যেক চিকিৎসকের কাছে তা পেঁৗছাতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

সরেজমিন ওষুধের বাজার : গত ক’দিনে রাজধানীর গ্রিনরোড ও শাহবাগ এলাকার ওষুধ মার্কেট এবং কমলাপুরের কয়েকটি দোকান ঘুরে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির বেহাল চিত্র দেখা গেছে। গ্রিনরোডের একটি বড় ওষুধের দোকানে রোববার দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, এ সময় ৩৪ ক্রেতার মধ্যে ২৭ জন অ্যান্টিবায়োটিক কিনেছেন। তার মধ্যে ১৯ জনের কাছে ব্যবস্থাপত্র ছিল। অবশিষ্টরা মৌখিকভাবে চেয়েই অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে গেছেন। জানতে চাইলে কর্তব্যরত সেলসম্যান বলেন, অনেকে আগের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ কিনতে আসে। তাই দিয়ে দিই। এভাবে দেওয়া উচিত কি-না জানতে চাইলে বলেন, এ বিষয়ক কোনো নির্দেশনা আমাদের কাছে নেই।

শাহবাগে ‘স’ অদ্যাক্ষরযুক্ত এক ফার্মেসিতে মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৪১ জন ক্রেতা আসেন। তার মধ্যে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে আসেন ৩১ জন আর অ্যান্টিবায়োটিক কেনেন ৩৫ জন। ব্যবস্থাপত্র ছাড়া চারজনকে কেন দিয়েছেন_ জানতে চাইলে সেলসম্যান বলেন, ক্রেতারা এসেছেন, ফিরিয়ে দেব কেন?

কমলাপুরে হোটেল নিশির উল্টোদিকের ওষুধ বিক্রেতা আবদুর রশিদ সমকালকে বলেন, অনেক ক্রেতা অসুখের কথা বলে সহায়তা চান। আগে কোন ওষুধ খেয়েছেন প্রশ্ন করে তুলনামূলক শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক দিলে রোগ সেরে যায়। তবে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি সম্পর্কে আমি জানি না।

বিবেক জাগ্রত করুন :অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অবস্থা থেকে মানুষকে বাঁচাতে চিকিৎসকদের বিবেককে জাগ্রত করার আহ্বান জানিয়েছেন ওষুধ প্রযুক্তিবিদ, ফার্মাকোলজিস্ট এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। ড. আ ব ম ফারুক বলেন, এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা/গাইডলাইন খুবই জরুরি। চিকিৎসকদের ওরিয়েন্টেশন করাতে হবে। বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণগোপাল দত্ত বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক ইস্যুতে চিকিৎসকদের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে। ফার্মেসিগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সমান জরুরি। তার চেয়েও বেশি জরুরি সবার সচেতনতা।

You may also like