মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৭ সালে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ ছিল ক্যান্সার। প্রথম স্থান দখল করেছিল হƒদরোগ। ওই সময়ে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার শতকরা ২৩ ভাগ ছিল। অর্থাৎ প্রায় প্রতি চারটি মৃত্যুর একটি ঘটেছে ক্যান্সারের জন্য। ২০১০ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে, বাাংলাদেশে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ ক্যান্সার।
দেশে দেশে ক্যান্সারের রকম ফের দেখা যায়। আবার নারী-পুরুষ ভেদে ক্যান্সারের প্রকোপ বিভিন্ন হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব ক্যান্সারে সবচেয়ে বেশি লোক মারা যায়, তা হল পুরুষদের ক্ষেত্রে ফুসফুস, প্রোস্টেট এবং অন্ত্রের ক্যান্সার; আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ফুসফুস, স্তন এবং অন্ত্রের ক্যান্সার।
দেশে ক্যান্সারের প্রকোপ
বাংলাদেশে ক্যান্সারের কারণে তালিকায় পুরুষদের ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে ফুসফুস, খাদ্যনালী, ঠোঁট, গলা ও পাকস্থলির ক্যান্সার; আর মহিলাদের ক্ষেত্রে জরায়ুমুখ, স্তন, ফুসফুস এবং খাদ্যনালীর ক্যান্সার। খাদ্যাভাস, বিড়ি-সিগারেট, পান, তামাক, জর্দা, সাদাপাতা, গুল ইত্যাদি ব্যবহারের কারণে আমাদের দেশে ঠোঁট, গলা ও খাদ্যনালীর ক্যান্সার বেশি হওয়ার সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। পাকস্থলির ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এসব উপাদানের পাশাপাশি হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি নামে পরিচিত একরকম ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হচ্ছে।
ক্যান্সার প্রতিরোধে স্ক্রিনিং
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি বড় অংশ জুড়ে আছে ক্যান্সার স্ক্রিনিং। কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা হলে রোগীর মৃত্যু রোধ করা যায় এবং চিকিৎসার ব্যয় সাশ্রয় করতে সাহায্য করে। ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য যেসব স্ক্রিনিং পরীক্ষা করা হয় তাদের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে-
■ এ পরীক্ষার দ্বারা গুরুত্বপূর্ণ কোন ক্যান্সার সুপ্তাবস্থায় কিংবা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা হয়
■ পরীক্ষাটি উপযুক্ত এবং রোগীর কাছে গ্রহণযোগ্য
■ শনাক্ত করার পরে ক্যান্সারটির উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে
■ শনাক্তকরণ পরীক্ষাটির খরচ কম হতে হবে
উপরের সব শর্ত পূরণ করে সব ধরনের ক্যান্সারের জন্য শনাক্তকরণ পরীক্ষা সব দেশে চালানো সম্ভব হয় না।
স্তন ক্যান্সার
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে স্তন ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করার প্রক্রিয়া বেশ সক্রিয়। সাধারণত যে কোন মহিলার বয়স ৪০ বছর অতিক্রম করলে প্রতিবছর তাকে ম্যামোগ্রাম করা সুপারিশ করা হয়। ম্যামোগ্রাম স্তনের এক ধরনের এক্সরে, যার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়। যেসব মহিলার বয়স ২০ বছর অতিক্রম করেছে তাদের অন্তত প্রতি ৩ বছরে একবার স্তন ক্লিনিকাল পরীক্ষা করানো উচিত। আগে ২০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে হলে মহিলাদের স্তন নিজে হাত দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার সুপারিশ করা হতো। ম্যামোগ্রাম আসার পরে এটার ওপরে আর তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। কিন্তু প্রতি মাসে একবার স্তন নিজ হাতে পরখ করে দেখাটাই সবচেয়ে এবং সুলভ স্ক্রিনিং পরীক্ষা। এটা করলে অনেক স্তন ক্যান্সার একেবারে অঙ্কুরেই শনাক্ত করা যায়। বাংলাদেশে মহিলাদের স্তন ক্যান্সার মারাÍক পর্যায়ে গিয়ে শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়ানোর পরেও দেখা যায় তারা নির্বিকার থাকেন এবং যখন এটা শনাক্ত করা হয়, তখন আর তেমন কিছুই করার সুযোগ থাকে না। যেসব মহিলার স্তন ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস আছে তাদের শনাক্তকরণ পরীক্ষার ব্যাপারে আরও নিবিড় যতœশীল হতে হবে। বর্তমানে অনেকে ৫০ বছর বয়স হওয়ার পরে ম্যামোগ্রাম করার সুপারিশ করছেন। কারণ ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে তেমন বেশি স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে না। কিন্তু আমেরিকার বীমা কোম্পানিগুলো এখনও ৪০ বছর বয়সের সীমারেখাই মেনে চলছে।
অন্ত্রে ক্যান্সার
অন্ত্রের ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য প্রাথমিকভাবে মলে রক্ত আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। মলে রক্ত পরীক্ষা পজিটিভ হলে কলোনোস্কপি করানোর প্রয়োজন হয়। এছাড়া ডাবল কন্ট্রাস্ট বেরিয়াম ইনিমা এবং বিশেষ ধরনের সিটি স্ক্যান করা যায়।
আজকাল অন্ত্রের ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য মলে ক্যান্সারের ডিএনএ টেস্ট করাকে বেশি উপযুক্ত মনে করা হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের পরীক্ষা বেশ ব্যয়বহুল এবং এখনও সর্বত্র পাওয়া যায় না। অন্ত্রের ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সব সময় সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে অন্ত্রের ক্যান্সার সম্পর্কে চিকিৎসকের সন্দেহ এবং পরীক্ষা করানোর রোগীর আগ্রহ উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে চিকিৎসক এবং রোগীর সম্মিলিত সিদ্ধান্ত প্রধান ভূমিকা পালন করবে।
জরায়ুমুখে ক্যান্সার
জরায়ুমুখের ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য প্যাপটেস্ট এবং হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস দায়ী। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি যে কোন মহিলার যৌনমিলন শুরুর তিন বছরের মাথায় প্যাপটেস্ট এবং ডিএনএ টেস্ট করানোর সুপারিশ করে থাকে। অন্য সংস্থা বয়স ২১ হওয়ার পরে থেকে প্রতিবছর কিংবা প্রতি তিন বছরে ১ বার শনাক্তকারী পরীক্ষা করানোর সুপারিশ করে থাকে। জরায়ু গ্রিবায় অ্যাসেটিক এসিড কিংবা লুগলস আয়োডিন লাগিয়ে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা আরেকটি সহজ শনাক্তকারী পরীক্ষা। এটা ‘ভায়া টেস্ট’ নামে পরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর তেমন প্রচলন নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এটি বহুল ব্যবহƒত এবং সুলভ পরীক্ষা।
জরায়ু গ্রিবা কিংবা যোনিরসে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের ডিএনএ পরীক্ষা করানো খুবই সহজ প্রক্রিয়া কিন্তু ব্যয়বহুল। এর নমুনা সংগ্রহের জন্য কোন চিকিৎসকেরও প্রয়োজন হয় না। রোগী নিজেও এটা করাতে পারেন। আজকাল হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকাও পাওয়া যায়। এ টিকা ব্যবহারের ফলে জরায়ু গ্রিবার ক্যান্সারের প্রকোপ অনেক কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অবশ্য এ টিকা সর্বত্র পাওয়া যায় না এবং যথেষ্ট ব্যয়বহুল।
প্রোস্টেট ক্যান্সার
অন্যান্য ক্যান্সারের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রোস্টেট ক্যান্সারের জন্য স্ক্রিনিং করা হয়। পুরুষের মূত্রথলির গ্রিবায় প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড অবস্থিত। সাধারণত পুরুষের বয়স ৫০ বছর অতিক্রান্ত করলে প্রাথমিক শনাক্তকরণ পরীক্ষা করার সুপারিশ করা হয়। তবে প্রোস্টেটের ক্যান্সার পরীক্ষার সুপারিশ নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে।
ফুসফুসে ক্যান্সার
বাংলাদেশে পুরুষদের ক্যান্সারে মৃত্যুর কারণে শীর্ষে রয়েছে ফুসফুসের ক্যান্সার। ফুসফুসের ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য বুকের এক্সরে, সিটি স্ক্যান এবং থুথু পরীক্ষা করা যায়। কিন্তু ব্যাপকভাবে জনসাধারণের মধ্যে স্ক্রিনিং করার জন্য পরীক্ষাগুলো উপযুক্ত নয়। এজন্য অধিকাংশ ফুসফুসের ক্যান্সার খুব বিলম্বে শনাক্ত হয়। তবে এক্ষেত্রে প্রতিরোধ ব্যবস্থার মূলে হাতিয়ার হচ্ছে ধূমপান পরিহার করা। ফুসফুসের সবচেয়ে বড় শত্র“ তামাক। একমাত্র ধূমপানবিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করে বাংলাদেশে ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রকোপ কমানো সম্ভব।
মুখ গহ্বরে ক্যান্সার
বাংলাদেশে খাদ্যনালি, মুখ গহ্বর এবং পাকস্থলির ক্যান্সারের প্রকোপও খুব বেশি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এসব ক্যান্সারের জন্যও কোন সহজ এবং সুলভ প্রাথমিক শনাক্তকারী পরীক্ষা নেই। ঠোঁট এবং মুখ গহ্বরের ক্যান্সারের সঙ্গে তামাকের সম্পর্ক রয়েছে। অতএব এখানেও আমাদের তামাক সেবন প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক : ডা. এআরএম সাইফুদ্দীন একরাম
বিভাগীয় প্রধান, মেডিসিন বিভাগ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী।