॥ অধ্যাপক ডা: একেএম ফজলুল হক ॥ মলদ্বারের ব্যথায় অনেক লোক ভুগে থাকেন। যে রোগে মলদ্বারে ব্যথা বা জ্বালাপোড়া হয় তার নাম এনাল ফিসার। সাধারণত শক্ত মল হলে বা ঘন ঘন মলত্যাগের কারণে মলদ্বার ফেটে ঘা হয়ে যায়। সমস্যা হল এই যে, এই ঘা শুকাতে চায় না সহজে।
আবার কিছু কছুি রোগীর এই ঘা শুকিয়ে গেলেও কিছু দিন পর আবার মল শক্ত হলে একই সমস্যা আবার দেখা দেয়। এই রোগ একজন রোগীর বছরের পর বছর এমনকি ৩০-৪০ বছর থাকতে দেখেছি। এ রোগের উপসর্গেরও বেশ তারতম্য হয়। কোন কোন রোগীর মলত্যাগের পর সামান্য জ্বালা পোড়া হয় এবং তা ৫ থেকে ১৫ মি: পর্যন্ত চলে।
আবার কখনও কখনও ব্যথা তীব্র আকার ধারণ করে এবং কয়েক ঘন্টা এমনকি সারাদিন চলতে থাকে। কারো কারো মাথা ধরে যায়। আবার দীর্ঘস্থায়ী এনাল ফিসারে মাঝে মাঝে মোটেই ব্যথা থাকে না। আমার ব্যক্তিগত মতে মলদ্বারের রোগের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বেশি হয়। আমি দেড় মাসের বাচ্চাকে এ রোগ হতে দেখেছি। তবে তরুণ ও যুবাদের বেশী হয়। পুরুষ অথবা নারী উভয়ের এ রোগটি সমান ভাবে হয়ে থাকে।
রোগের কারণ এবং কি করে ঘটে: এটি হওয়ার জন্য সাধারণত:দায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা মলত্যাগের সময় কোত দেয়া। শক্ত মল বের হওয়ার সময় মলদ্বার ফেটে যায় বলে মনে করা হয়। যারা আঁশযুক্ত খাবার খান তাদের এ রোগ কম হয়। আঁশযুক্ত খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক-সবজি, কাঁচা ফলমূল, আলুর ছোলা, ইসুপগুলের ভূষি ইত্যাদি। চা কফি বা মদ খাওয়ার সাথে এগুলোর কোন সম্পর্ক নেই। ঘন ঘন মলত্যাগ বা ডায়রিয়া হলে ফিসার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যদিও আঙ্গুল দিয়ে পরীক্ষা করলে মলদ্বার অতিরিক্ত সংকুচিত বলে মনে হয়। মলদ্বারের ভিতর সাপোজিটরী জাতীয় ওষুধ দেয়ার সময় অনেকের মলদ্বারে যে ঘা হয় তা থেকেও অনেক রোগীর বিশেষ কর মহিলাদের এ জাতীয় রোগ হতে পারে।
উপসর্গ ও লক্ষণসমূহ: মলদ্বারে ফিসারের প্রধান লক্ষণ হলো ব্যথা, জ্বালাপোড়া ও রক্তক্ষরণ। এ ধরণের ব্যথা সাধারণত মলত্যাগের অব্যবহিত পরে হয় এবং কয়েক মিনিট থেকে বহু ঘন্টা এমনকি সারাদিনও চলতে পারে। ‘প্রকটালজিয়া ফিউগাক্স’ নামক এক ধরনের রোগেও মলদ্বারে ব্যথা হয় কিন্তু তা মলত্যাগের অব্যবহিত পরেই হয় না, দিনের যে কোন সময় হতে পারে। পাইলসের জটিলতা যেমন রক্ত জমাট বাধা, আলসার বা গ্যাংগ্রীন হলেও মলদ্বারে প্রচুর ব্যথা হয় কিন্তু তখন রোগী মলদ্বারে বড় একটি মাংসপিন্ড আছে বলে অভিযোগ করেন। মলদ্বারে সংক্রমণ হয়ে ফোড়া হলে, ফিষ্টুলা বা ভগন্দর এবং দুরারোগ্য ক্যান্সারেও ব্যথা হয়। এসব ক্ষেত্রে রোগের ইতিহাস ও রোগীকে ফিজিক্যাল পরীক্ষা করে রোগ সনাক্ত করতে হয়।
এই রোগে রক্তক্ষরণের পরিমাণ সাধারণত: কম। তবে আমি অনেক রোগী দেখেছি যারা বলেন মুরগী জবাই করলে যেরূপ রক্ত পড়ে তেমন রক্ত যায়। কিছুদিন পূর্বে অল্প বয়সী এক অফিসারকে চিকিত্সা করেছি যার তীব্র রক্ত শূন্যতা হয়েছিল। দীর্ঘস্থায়ী (ক্রনিক) মলদ্বারের ফিসারের রোগী একটু ভিন্ন ধরনের উপসর্গের কথা বলেন। তাদের অভিযোগের মধ্যে থাকে মলদ্বারে অতিরিক্ত মাংসপিন্ড, পুঁজ পড়া, চুলকানি ইত্যাদি। এসব উপসর্গ একত্রে অথবা আলাদা আলাদাভাবে হতে পারে। এক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। ব্যথা সাধারণত: তীব্র হয় না, আবার অনেক সময় ব্যথা একেবারেই থাকে না।
ফিসারের রোগীরা অনেক সময় প্রস্রাবের সমস্যায় ভোগেন। অনেকে বহুদিন ধরে প্রস্রাব করতে কষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। এ রোগে মহিলারা কখনো কখনো যৌন মিলনে ব্যথা অনুভব করেন। যদিও রোগীরা বুঝতে পারেন যে কোষ্টকাঠিণ্যের কারণে এ সমস্যাটির উদ্ভব হয়েছে তবু ব্যথার ভয়ে রোগীরা টয়লেটে যেতে চান না। এভাবে কোন কোন রোগী ৫-১০ দিন পর একবার টয়লেটে যান।
তীব্র ব্যথা সম্পন্ন ঘা বা একিউট এনাল ফিসার: এ অবস্থায় রোগীরা ভীষণ ব্যথায় ভোগেন। কয়েক ঘন্টা থেকে বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে থাকেন। এসময় মলদ্বার পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, সেটি খুবই সংকুচিত অবস্থায় আছে। তীব্র ব্যথার কারণে ভিতরের ঘা দেখা দু:সাধ্য। কোন যন্ত্রও প্রবেশ করানো যায় না। অনেক রোগী তীব্র ব্যথার জন্য মলদ্বার স্পর্শ করতে দিতে চান না।
দীর্ঘস্থায়ী মলদ্বারের ঘা বা ক্রনিক এনাল ফিসার: ক্রনিক ফিসার বলা হয় যখন একটি সঠিক ভাবে চিহ্নিত সীমানার মধ্যে ঘা দেখা যায়। এক্ষেত্রে একটি বাড়ন্ত মাংশপিন্ড বা গেজ দেখা যায়। এটিকে বলা হয় ‘সেন্টিনেল পাইলস’।
প্রতিরোধ: কোষ্ঠকাঠিন্য যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করা উচিত এবং বেশী শক্তি প্রয়োগে মলত্যাগ করা উচিত নয়। বারে বারে মলত্যাগের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে এবং ডায়রিয়া হলে দ্রুত চিকিত্সা করতে হবে।
রক্ষণশীল চিকিত্সা:রোগটি শুরুর অল্প দিনের ভিতরে চিকিত্সা শুরু করা হলে বিনা অপারেশনে ভাল হবার সম্ভাবনা বেশী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রথম প্রথম সামান্য জ্বালাপোড়া এবং একটু রক্ত ক্ষরণ ছাড়া তেমন সমস্যা থাকেনা তাই কেউ ডাক্তারের কাছে যান না। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি রোগটি যখন বারে বারে হচ্ছে এবং ব্যথা কিছুটা তীব্র হচ্ছে তখনই ডাক্তারের কাছে আসেন। ততক্ষণে রোগটি ক্রনিক হয়ে গেছে। এরপরেও আমি ওষুধ দিয়ে ১ মাস সেবন করতে বলি। যদি ভাল হয়ে যায় তাহলে বিশেষ ধরণের খাবারের উপদেশ দিয়ে বলি, যদি কোন দিন অসুবিধা হয় তাহলে আসবেন। কিন্তু ১ মাস বা দু’ মাসের ওষুধেও যদি ভাল না হয় তখন অপারেশন করতে উপদেশ দেই। ওষুধের মধ্যে রয়েছে মল নরম করার এবং মলের পরিমাণ বৃদ্ধি করার ওষুধ। এজন্য আঁশ জাতীয় খাবার যেমন-শবজি, টাটকা ফলমূল, ইসুপগুলের ভূষি খাওয়া যেতে পারে। ব্যথা নাশক ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। সিজ বাথ নিলে উপকার পাওয়া যায়। এটির নিয়ম হচ্ছে আধ গামলা লবণ মিশ্রিত গরম পানিতে নিতম্ব ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। মলদ্বারে ব্যথানাশক মলম ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে যদি পুরোপুরি উপকার না পাওয়া যায় এবং রোগটি যদি বেশি দিন চলতে থাকে তাহলে অপারেশন করিয়ে নেয়া ছাড়া ভাল হবার সম্ভাবনা কমতে থাকে।
সার্জিক্যাল চিকিত্সা: এ রোগের জন্য অপারেশন করতে হতে পারে এ কথা শুনলেই রোগীদের আত্মা শুকিয়ে যায়। এমনকি বায়ু বের করতেও কষ্ট হয়। ওষুধে না সারলে অপারেশনই এই ঘা শুকাবার একমাত্র পথ, এবং তারপরই সমস্ত সমস্যার সমাধান হবে। অপারেশনের অব্যবহিত পরই রোগী আরামে মলত্যাগ করতে পারবেন কিন্তু অপারেশনের ঘা শুকাতে ২-৪ সপ্তাহ লাগতে পারে। তবে রোগীরা ৫-১০ দিনের মধ্যে কাজে যোগদান করতে পারেন। অপারেশনের জন্য হাসপাতালে মাত্র ২-৩ দিন থাকতে হয়।
সবচেয়ে দু:খজনক যে প্রশ্নটি সর্বদা শুনতে হয় তা হল এই যে, রোগীরা বলেন যে, স্যার, শুনেছি এই রোগ অপারেশন করলেও বারে বারে হয়, তাই আর অপারেশন করিয়েই বা লাভ কি? আমি জানিনা কোথা থেকে বেশীর ভাগ রোগী এমনকি বিদেশে ডিগ্রী নিয়ে এসেছেন এমন রোগীও একই ধারণা পোষণ করেন। একথা বলার সময় অনেক রোগী কোন কোন ডাক্তারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে উনি বলেছেন, ‘আপনাকে সারা জীবন এ সমস্যা নিয়েই চলতে হবে’। যা ওষুধ দিয়েছি এগুলো এবং বেলের শরবত খাবেন। মল নরম রাখবেন। এভাবে যতদিন চলতে পারেন। অপারেশন করিয় লাভ নেই আবার এটি হতে পারে।’
এর উত্তরে আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে, এ রোগের অপারেশনের সাফল্য আন্তর্জাতিক ভাবে ৯৫-৯৯% এবং আবার হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বিগত ৯ বছরে আমি এ ধরণের শত শত অপারেশন করেছি এবং ৯৭% রোগী ভাল হয়েছেন সম্পূর্ণভাবে।
লেখক : অধ্যাপক ডা: একেএম ফজলুল হক
বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ সার্জারী বিশেষজ্ঞ
চেম্বার: জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ হসপিটাল, জিগাতলা, ঢাকা