Home স্বাস্থ্য সংবাদবেহাল স্বাস্থ্য খাত : বেসরকারী হাসপাতালে উচ্চ ব্যয়, নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের

বেহাল স্বাস্থ্য খাত : বেসরকারী হাসপাতালে উচ্চ ব্যয়, নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের

আইন করতে আপত্তি দলীয় চিকিৎসক নেতাদের ॥ সরকারী হাসপাতালে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার মেশিন
■ ইহেলথ২৪ ডটকম ডটবিডি ডেস্ক
জনবল বাড়লেও সেবার মান বাড়েনি সরকারী চিকিৎসাসেবায়। সরকারী হাসপাতালে জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের বিনা মূল্যে চিকিৎসা প্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারী নিয়ন্ত্রণে নেই বেসরকারি চিকিৎসাসেবা। দেশের অধিকাংশ মানুষ বেসরকারী হাসপাতালের উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারে না। অসুস্থতার চিকিৎসা করাতে গিয়ে দেশে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ দরিদ্র হচ্ছে। সরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ মানুষের নূ্যনতম চিকিৎসাপ্রাপ্তির সুযোগ সঙ্কুচিত করে তুলছে সংশিস্নষ্ট প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা ও দুনর্ীতি। আর এমন অবস্থায় দরিদ্র-মধ্যবিত্ত-ধনী সব শ্রেণীর মানুষের জন্য নূ্যনতম মানসম্পন্ন সেবা প্রদান জরম্নরী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক কোন নীতিই চূড়ানত্ম করতে পারেনি সরকার।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, বর্তমান সরকার ৰমতায় আসার পর দেশের স্বাস্থ্য সেক্টরে অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে বর্তমানে ১০ হাজার ৭২৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করা হয়েছে এবং এর মধ্যে ৯ হাজার ৭২২টি চালু করেছে বর্তমান সরকার। ১টি মেডিক্যাল কলেজ, ১৩টি নার্সিং ইনস্টিটিউট, ৩টি হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউসহ বেশ কিছু সংখ্যক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়েছে। নিয়োগ দেয়া হয়েছে নার্স, স্বাস্থ্য সহকারী, এ্যাডহক চিকিৎসকসহ চুক্তিভিত্তিক অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী । সর্বশেষ সাড়ে তের হাজার কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার নিয়োগ কার্যক্রম চূড়ানত্ম পর্যায়ে রয়েছে। আর ডিজিটাল চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা চালু করার দাবি করে আসছে বর্তমান সরকার। কেন্দ্রীয়ভাবে ওষুধ ক্রয় এবং তা জাতীয় পতাকার আদলে লাল সবুজের বিশেষ মোড়ক লাগিয়ে ওষুধ পাচার বন্ধ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের অবকাঠামো একটি উন্নত দেশের খুব বেশি পেছনে নেই। তবে দেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের অবস্থা নাজুক কেন ?
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক নীতি ও আইন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক কোন নীতি ও আইনের চূড়ানত্ম রূপ দিতে পারে বর্তমান সরকার। সোয়া দু’বছর ধরে খসড়া অবস্থায় পড়ে আছে স্বাস্থ্যনীতি। জাতীয় ওষুধ নীতির বিষয়টি রয়েছে আলোচনার বাইরে। বেসরকারী চিকিৎসা আইন হালনাগাদ করার কাজে সরকার হাত দিয়েছে মাত্র। নিজেদের মতো করে চলছে বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো । এ সব প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। বৈধ ও অবৈধ প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত তালিকা পর্যনত্ম নেই সরকারের কাছে। কয়েক যুগ ধরে বেসরকারী চিকিৎসাসেবা আইন হিমাগারে । সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় বেসরকারী ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারছে না। চিকিৎসক বা ওই সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের অবহেলায় রোগীর মৃতু্য ঘটলেও মামলা করতে পারছেন না তার স্বজনরা। বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বেচ্ছাচারিতার কাছে জিম্মি সাধারণ মানুষ। নিজেদের তৈরি নিয়ম-নীতির ভিত্তিতে তারা চিকিৎসা ফি থেকে শুরম্ন করে সব ধরনের সিদ্ধানত্ম নিয়ে থাকে। প্রতিটি সরকারের আমলেই সরকারদলীয় চিকিৎসক নেতাদের আপত্তির কারণে বেসরকারী চিকিৎসাসেবা আইন চূড়ানত্ম রূপ পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। চিকিৎসাসেবার মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য এ আইনটি করা উচিত বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
রোগীর শয্যা সুবিধা রোগীর শয্যা সংখ্যা খুব বেশি বাড়াতে পারেনি সরকার। সরকারী হাসপাতালগুলোর প্রসত্মাবিত নতুন রোগী শয্যার মাত্র ৫ ভাগের ১ ভাগ অনুমোদন করেছে সরকার। দেশের সরকারী হাসপাতালগুলোর প্রসত্মাবিত ২৭ হাজার ৭১৫টি নতুন বেডের (রোগী শয্যা) বিপরীতে মাত্র ৪ হাজার ৬৫৫টি অনুমোদিত হয়েছে। ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে ২৩ হাজার ৬০টি বেড। ২০১০ সালের স্বাস্থ্য বুলেটিন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। প্রত্যাশিত হারে বৃদ্ধি না পাওয়ায় সরকারী হাসপাতালগুলোতে রোগীশয্যার তীব্র সঙ্কট রয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা ও নতুন রোগী ভর্তির হার যেভাবে বাড়ছে, নতুন শয্যার সরবরাহ সেই তুলনায় বাড়ছে না। অপ্রতুল রোগী শয্যার কারণে সরকারী হাসপাতালগুলোতে প্রত্যাশিত চিকিৎসাসেবা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশিস্নষ্টরা। সরকারী হাসপাতালগুলো বিদ্যমান রোগীশয্যা দিয়ে প্রয়োজনের শতকরা ৬০ ভাগও পূরণ হয় না।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর পরিদফতর থেকে অধিদফতরে রূপ নেয়ার এক বছর পরও গতিশীল হতে পারেনি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানটির সাইনবোর্ড ছাড়া কোন কিছুতে পরিবর্তন আসেনি। জনবল, যন্ত্রপাতি ও অভিযান সহায়ক যানবাহনের অবস্থাও আগের মতোই রয়ে গেছে। কর্মসূচী ঘোষণা দিয়েও তারা ভেজাল ওষুধবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে না। অধিদফতরের এমন দুর্বলতার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভেজাল ওষুধ। দেশে প্রায় দু’শটি ওষুধ কোম্পানি নিম্নমানের ওষুধ বাজারজাত করছে। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের আবেদন করেই ওষুধ প্রস্তুত করে চলেছে। এর মধ্যে রয়েছে ওষুধ আদালতের সীমাবদ্ধতা। সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত না থাকায় ওই সব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরম্নদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারছে না ওষুধ আদালতও। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর সরকারী মনিটরিং টিম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার ক’দিন কাজ করেই দায়িত্ব পালন শেষ করেন।
নষ্ট ও অব্যবহৃত মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির স্তুপ বিভাগীয় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপেস্নঙ্গুলোতে নষ্ট ও অব্যবহৃত মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির স্তুপ বেড়েই চলেছে। অনেক যন্ত্রপাতি রয়েছে, যেগুলো সামান্য মেরামতেই চালু করা সম্ভব। নষ্ট হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে সেগুলো মেরামতের কোন উদ্যোগ নেয়া হয় না। নষ্ট যন্ত্রপাতি মেরামত না করে লভ্যাংশের লোভে আরেকটি নতুন যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ঘটনাও ঘটছে। রাজধানীর ক্যান্সার হাসপাতালের এমআরআই মেশিন কেনা হয় ৪ কোটির বেশি টাকায়। রহস্যজনকভাবে ওই যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে পড়ে। মেশিনটি অকেজো করার দায়ভার নেননি কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী। নষ্ট হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে মেরামতের জন্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। ওই টাকায় মেরামত করাতে অস্বীকৃতি জানায় হাসপাতাল কর্তৃপৰ। এভাবে অনেক মাস চলে যায়। সম্প্রতি মেরামতের চেষ্টা করা হলে দাবি করা হয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। বিশাল অংকের টাকার কথা শুনে মেরামতের বিষয়টি পুরোপুরিভাবে বাদ দেয়া হয়। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে কোটি টাকার ‘বেকি থেরাপি মেশিন’ ও রেডিও থেরাপির ‘কোবাল্ট মেশিন’। ইচ্ছে করে এ সব মেশিন নষ্ট করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নষ্ট মেশিন মেরামতের বিষয়টি বাদ দিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপৰ এবার ২০ কোটি টাকা মূল্যেও ‘লিমিয়ার এঙ্েিলটর মেশিন’ ক্রয়ের তদবির চালাচ্ছে। এই নতুন মেশিন ক্রয় করলে অনেক লভ্যাংশ যাবে হাসপাতালের সংশিস্নষ্টদের পকেটে । এ জন্যই তারা পুরনো মেশিন মেরামতে হাত না দিয়ে নতুন মেশিন ক্রয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। শেরে বাংলা নগরে কিডনি হাসপাতালের পাথর কাটার মেশিন দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। এ সমস্যা নিয়ে আগত রোগীদের অন্য হাসপাতালে যেতে পরামর্শ দেন কিডনি হাসপাতালের চিকিৎসকরা। জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের নষ্ট হয়ে যাওয়া এনজিওগ্রাম মেশিন এখনও মেরামত করা হয়নি। বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালের এনজিওগ্রাম মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নষ্ট এনজিওগ্রাম মেশিনের মেরামত কাজ খুব শীঘ্রই শেষ হবে বলে হাসপাতাল কর্তৃপৰ জানায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের কোটি টাকায় কেনা ইআরসিপিসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি দৰ ও প্রশিৰিত চিকিৎসকের অভাবে যখাযথভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
সুত্র : জনকণ্ঠ

You may also like