সময় জলবসন্তের : গুটি দেখলেই পরীক্ষা করুন

ডা. দিবাকর সরকার
এখন প্রায় প্রতি ঘরে জলবসন্ত বা চিকেন পঙ্ দেখা দিচ্ছে এবং রোগটি এতটাই ছোঁয়াচে যে খুব সহজেই তা আশপাশের মানুষকে আক্রান্ত করছে।
শীত চলে গেছে বেশ কিছুদিন আগেই। ঋতুর এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু রোগ এখন আবার নতুন করে দেখা দিচ্ছে। তার মধ্যে যে রোগটি এখন বেশি ভোগাচ্ছে, তা জলবসন্ত বা চিকেন পঙ্।

জলবসন্ত বা চিকেন পক্স কী?
জলবসন্ত বা চিকেন পঙ্ একটি জীবাণুবাহিত রোগ। ভ্যারিসোলা জোসটার নামের ভাইরাসে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। তবে একবার এ রোগে আক্রান্ত হলে পরবর্তী সময়ে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়। কারণ প্রথমবার আক্রমণের সময় দেহ এ জীবাণুর বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত রোগ প্রতিরোধক্ষমতা সৃষ্টি করে, যা পরবর্তী সময়ে এ রোগ সৃষ্টিতে বাধা দেয়।
বছরের যেকোনো সময়ই এ রোগ হতে পারে, তবে গরমকালে বা শীত-গরমের তারতম্যের সময় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয় এবং যেকোনো বয়সের মানুষই এ জীবাণুতে আক্রান্ত হতে পারে।

কিভাবে ছড়ায়
এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ। সাধারণত দেখা যায়, পরিবারের একজন সদস্য এ জীবাণুতে আক্রান্ত হলে তা ধীরে ধীরে পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়, এমনকি আশপাশের মানুষও তাতে আক্রান্ত হতে পারে। তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে এবং রোগ সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ করলে আমরা খুব সহজেই এ রোগের সংক্রমণ কিছুটা হলেও প্রতিহত করতে পারি। সাধারণত রোগের লক্ষণ (দেহের চামড়ায় ফোসকা) প্রকাশের পাঁচ দিন আগে থেকে চামড়ায় ফোসকা বিলুপ্ত হওয়ার পরবর্তী পাঁচ দিন পর্যন্ত এ জীবাণু আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সুস্থ মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে। নিম্নলিখিতভাবে এ জীবাণু সংক্রমিত হয়ে থাকে_

– বাতাসের মাধ্যমে।
– আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির পরিচর্যা করার সময় মুখে মাস্ক বা গ্লাভস ব্যবহার করা উচিত।
– আক্রান্ত ব্যক্তির চামড়ার ফোসকা বা ঘায়ের রস থেকে
– আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড় থেকে।

লক্ষণ
দেহে জীবাণু প্রবেশের ১৪ থেকে ১৬ দিনের মাথায় এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। তবে এ জীবাণু দেহের মধ্যে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। দেহে এ জীবাণু যেসব লক্ষণ প্রকাশ করে রোগ সৃষ্টি করে তা নিম্নরূপ :
– প্রথম পর্যায়ে জ্বর হয়, যা ১০২-১০৩ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে।
– জ্বর হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেহের চামড়ায় ফোসকা পড়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে ফোসকাগুলো লাল লাল গুটি আকারে বের হয় এবং পরে তা ফোসকার আকার ধারণ করে। এই ফোসকা প্রথম দিকে মাথায় বের হয় এবং পরে তা বুক, পিঠ, হাত, পা, মুখ বা মুখগহ্বরসহ দেহের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ফোসকাগুলো এ অবস্থায় এক-দুই দিন থাকার পর ধীরে ধীরে কালো বর্ণ ধারণ করে এবং সাত দিনের মাথায় শুকিয়ে যায়। অনেক সময় ফোসকাগুলো ফেটে গিয়ে আক্রান্ত স্থানে ঘা হয়।
– মাথা বা শরীরে ব্যথা হতে পারে।
– খাবারে অরুচি হয়।
– শারীরিক দুর্বলতা বোধ হয়।
– ফোসকার স্থানে চুলকানির অনুভূতি হয়।
– মুখের ভেতর ফোসকা হলে খাবার গ্রহণের সময় তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।
বাড়িতে পরিচর্যা
বেশির ভাগ সময়ই এ রোগ বাড়িতে সাধারণ চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো হয়ে যায়। তাই হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে কোনো কারণে জলবসন্ত যদি বেশি মাত্রায় ছড়ায় বা ইনফেকশন তৈরি করে তবে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন পড়তে পারে। বাড়িতে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে_
– যেহেতু ফোসকার স্থানে চুলকানির অনুভূতি হয়, তাই এ অবস্থায় আক্রান্ত স্থানে ঠাণ্ডা পরশ (আইস ব্যাগ বা ঠাণ্ডা অ্যান্টিসেপটিক মলম) বিশেষ উপকারে আসে।
– প্রতিদিন গোসল করতে হবে। এতে চুলকানি কমবে বা ফোসকার স্থানে ময়লা জমা প্রতিহত হবে।
– মাথা বা শরীরে ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করতে হবে।
– মুখের ভেতর ফোসকা হলে নরম বা তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।
– প্রচুর পানি বা পানিজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।
– অতিরিক্ত ঝালজাতীয় খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
– আক্রান্ত ব্যক্তিকে পরিবারের অন্যান্য সদস্য থেকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হবে। প্রয়োজনে তার জন্য আলাদা ঘর, আলাদা কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
– শেষ ফোসকা বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির বাইরে যাওয়া বা আক্রান্ত বাচ্চার স্কুলে যাওয়া বা আক্রান্ত ব্যক্তির অফিসে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
– যেকোনো মূল্যে ফোসকা ফাটানো থেকে বিরত থাকতে হবে এবং আক্রান্ত স্থানে চুলকানো যাবে না।
– প্রতিদিন আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড় ও বিছানার চাদর অ্যান্টিসেপটিকযুক্ত গরম পানিতে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।

জটিলতা
উপযুক্ত সময়ে সঠিক পরিচর্যা বা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে এ রোগ কোনো ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে না। তবে এর ব্যতিক্রম ঘটলে কোনো কোনো সময় এ রোগ নিম্নরূপ জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে_

– চামড়ায় জটিল ঘা বা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত
– ফুসফুস সংক্রমণ বা নিউমোনিয়া
– মস্তিষ্কে সংক্রমণ বা ভাইরাল এনকেফালাইটিস
– পুরুষাঙ্গে সংক্রমণ বা অরকাইটিস ইত্যাদি।

প্রতিরোধ
বর্তমানে আমাদের দেশে এ রোগের প্রতিষেধক টিকা বা ভ্যাকসিন অতি সহজেই পাওয়া যায়। তাই সবারই উচিত ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করে আনাকাঙ্ক্ষিত এ রোগের হাত থেকে নিজেকে দূরে রাখা।

পরামর্শ দিয়েছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজহার, গ্রন্থনা করেছেন মিটফোর্ড হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. দিবাকর সরকার

Exit mobile version