ড. জাকিয়া বেগম
চর্বি মানুষের শরীরের এমন একটি উপাদান যা শরীরকে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি যোগায়, øায়ুগুলোকে আবৃত করে রেখে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে, বিভিন্ন ধরনের হরমোনের মধ্যে সমতা বজায় রাখে, আমিষ ও শর্করাজাতীয় খাদ্য বিপাকে সহায়তা করে এবং ত্বক শিরাগুলোকে নমনীয় রাখতে এবং গিটগুলোতে তৈলাক্ততা সরবরাহের মাধ্যমে সচল রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ চর্বির উপস্থিতি শরীরের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। চর্বির মধ্যস্থ ফ্যাটি এসিডের ধরনের ওপরই নির্ভর করে শরীরের জন্য এর প্রয়োজনীয় পরিমাণ, ক্ষতিকর প্রভাব বা উপকারিতা।
চর্বি প্রধানত দু’ধরনের হয়ে থাকে। সম্পৃক্ত এবং অসম্পৃক্ত চর্বি।
সম্পৃক্ত চর্বি : প্রয়োজনের অতিরিক্ত এ ধরনের চর্বি খাদ্য তালিকায় থাকলে তা রক্তে বেশি পরিমাণে কোলেস্টেরল তৈরি করে এবং ধমনীর গায়ে জমে সরু করে তোলে। ফলে রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়ে হƒদরোগের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। মাংস, মাখন দুগ্ধজাতীয় খাদ্যে এর পরিমাণ বেশি থাকে। তাই এ জাতীয় চর্বির পরিমাণ কম রেখে খাদ্য তালিকায় ভালো জাতীয় চর্বির পরিমাণ বেশি রাখতে সচেতন হতে হবে।
অসম্পৃক্ত চর্বি : অসম্পৃক্ত চর্বি দু’ধরনের মনো এবং পলি। শরীর অসম্পৃক্ত চর্বি উৎপাদন করতে পারে না তবে পলি ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বিকে মনো ধরনের চর্বিতে রূপান্তরিত করে নিতে পারে। অসম্পৃক্ত চর্বির মধ্যে ট্রান্স-ফ্যাট প্রয়োজনীয় তো নয়ই বরং এগুলো শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। অপর দিকে যেসব অসম্পৃক্ত চর্বির মধ্যে ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড বিদ্যমান সেগুলো স্বাস্থ্যবান্ধব হিসেবে কাজ করে।
ট্রান্স ফ্যাট : এগুলো ভালো চর্বিকে ক্ষতিকর চর্বিতে রূপান্তরিত করে তোলে এবং রক্তে এইচডিএল নামক ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে এলডিএল নামক ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্য বিশেষ করে ‘ফাস্ট ফুড’-এর দোকানে ব্যবহƒত মাংসের বিভিন্ন পদ, ‘ফ্রেঞ্চ ফ্রাই’, কেকজাতীয় বেকারিসামগ্রী এবং মাখন-মারজারীন, ক্রেকারস্ ইত্যাদিতে এ চর্বির পরিমাণ বেশি থাকে। তাই দৈনন্দিন খাদ্য-তালিকায় এগুলোর পরিমাণ বেশি থাকলে তা ক্ষতিকর পর্যায়ে চলে যেতে পারে। সম্পৃক্ত চর্বির চেয়েও এ জাতীয় চর্বি অধিক ক্ষতিকর। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে খাদ্য তালিকায় সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা যেখানে ১৭ ভাগ বৃদ্ধি পায় সেক্ষেত্রে ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ মাত্র ২ ভাগ বৃদ্ধি করলেই এ সম্ভাবনা ৯৩ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই ‘চিপস’, ‘ফ্রেঞ্চ ফ্রাই’ এবং ক্ষতিকর অন্যান্য ‘ফাস্ট ফুড’ যতদূর সম্ভব পরিহার করা অত্যন্ত জরুরি।
ওমেগা-৩ : ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডসমৃদ্ধ খাদ্য শরীরের জন্য বেশ উপকারী। মস্তিষ্ককে সতেজ ও কার্যক্ষম রাখতে এবং রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ কমিয়ে হার্ট অ্যাটাক রোধে এ উপাদানটির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। অনিয়মিত হƒদস্পন্দনকে নিয়ন্ত্রিত করতেও এটি সাহায্য করে। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে দৈনিক ৩ গ্রাম বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণে মাছের তেল গ্রহণ করা হলে উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত রোগীদের রক্তের চাপ কমে আসে; মস্তিষ্কের দিকে ধাবিত শিরাগুলোতে রক্ত বা প্লাক জমে যাওয়ার কারণে সৃষ্ট মস্তিষ্কের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনাও প্রায় ৫০ ভাগ কমে আসে। কোন কোন সমীক্ষায় দেখা গেছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হাড়ে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বাড়াতে, অস্থিসন্ধির ব্যথা এবং অনমনীয়তা কমিয়ে আনতে এবং হাড়কে শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করে এবং অস্থিসন্ধির প্রদাহজনিত (রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস) রোগের প্রকোপও কমিয়ে আনে। এছাড়া বিষন্নতা কমিয়ে মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে, বয়স্কদের স্মৃতিভ্রমজনিত রোগের প্রকোপ কমাতে এবং আলঝিমার্স রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে আনতেও এ উপাদানটি যথেষ্ট কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
ক্যান্সার প্রতিরোধেও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। যেসব মহিলা দীর্ঘদিন ধরে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কোলন ও প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধেও এটি কার্যকর বলে ধারণা করা হয়।
ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড : শরীরের জন্য বেশ উপকারী এ উপাদানটিও শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়াতে ওমেগা-৩ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ। অসম্পৃক্ত এ চর্বিটি বিপাকীয় পদ্ধতি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণে, প্রজননতন্ত্র ও হাড়ের সুরক্ষায় এবং ত্বক ও চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ধরে রাখতে সাহায্য করে।
যেহেতু শরীর এ উপকারী উপাদানগুলো উৎপাদন করতে পারে না তাই বাইরে থেকে খাদ্যের মাধ্যমে এগুলো গ্রহণ করতে হয় বা প্রধানত বিভিন্ন ধরনের মাছ, চিনাবাদামসহ বিভিন্ন ধরনের বাদাম, অলিভ বা জলপাই, বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিজ্জ তেল, আলজি, তিসি, সয়াবিন, ব্র“কলি এবং গাঢ় সবুজ শাকসবজি, মাতৃদুগ্ধ, সম্পূর্ণ শস্য অর্থাৎ যা থেকে আঁশ বা অন্যান্য পদার্থ ছেঁটে ফেলা হয় না যেমন : লাল আটা, ঢেঁকি ছাঁটা চাল ইত্যাদি। ‘টুনা’, ‘সালমন’ ইত্যাদি সামুদ্রিক মাছ এবং সি-ফুড ওমেগা-৩-এর বড় উৎস বলে বিবেচিত।
বেশিরভাগ খাদ্যে একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের চর্বি বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান থাকে। শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণে কিছু চর্বির প্রয়োজনীয়তা থাকায় খাদ্য তালিকা থেকে চর্বি সম্পূর্ণরূপে বাদ না দিয়ে ভালো জাতের চর্বিসমৃদ্ধ খাদ্যের পরিমাণ বাড়িয়ে খারাপ চর্বিসমৃদ্ধ খাদ্য পরিহার করতে চেষ্টা করতে হবে। খাদ্যে সম্পৃক্ত চর্বি ও পরিশোধিত চিনির তুলনায় যদি বেশি পরিমাণে মনো ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বি বিদ্যমান থাকে তবে তা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো ফল বয়ে আনে। বিশেষজ্ঞদের মতে খাদ্যকে স্বাস্থ্যসম্মত করে তুলতে হলে দৈনিক ক্যালরি তালিকায় সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ কোন অবস্থাতেই ১০ ভাগের বেশি হওয়া উচিত নয়। আর ৩০ ভাগ হওয়া উচিত অসম্পৃক্ত চর্বি। আবার ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৩ এর অনুপাত হওয়া উচিত ২.১-৪.১ এর মধ্যে।
উপকারী এ ফ্যাটি এসিডগুলোর প্রয়োজনীয়তা মেটাতে সপ্তাহে অন্তত দু-তিন বেলা মাছ খাওয়া বাঞ্ছনীয়। উন্নত দেশে বিভিন্ন মাছে বিদ্যমান ওমেগা ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ বিশ্লেষণ করে এর প্রয়োজনীয় মাত্রা নির্ণয় করা হয়েছে। আমাদের দেশেও দেশীয় মাছগুলো বিশ্লেষণ করে এগুলোর মধ্যে কোনটিতে কোন উপাদান কতটুকু আছে তা নির্ণয় করে জনগণকে এ বিষয়ে পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। তবে খাদ্য থেকে গ্রহণ না করে যদি পরিবর্তিত কোন মাধ্যমের সাহায্যে উপাদানটি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন মনে হয় তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া জরুরি।
ড. জাকিয়া বেগম
পরমাণু বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ইউআইটিএস