ব্লাড ক‍্যান্সারের প্রকার, কারন, লক্ষণ, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা

দেশ থেকে ফেরার পর অনেকে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে যোগাযোগ করেন। এসব রোগীদের মধ‍্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ক‍্যান্সারে আক্রান্ত। ক‍্যান্সারের কথা শুনলেই আমরা আতঙ্কে উঠি এবং মনে হয় রোগী জীবন-মৃত‍্যুর সন্ধিক্ষনে। ক্যান্সার কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়, এর চিকিৎসা আছে, ভয়ে আতঙ্কিত হবে না। পাঠকদের জন‍্য এই লেখা ব্লাড বা রক্তের ক্যান্সার নিয়ে।

ব্লাড ক্যান্সারকে হেমাটোলজিক ক্যান্সারও বলা হয়। ব্লাড ক‍্যান্সার অস্থি মজ্জা (Bone marrow) থেকে শুরু হয়, যেখানে রক্তের কনিকা তৈরি হয়। ব্লাড ক্যান্সার হয় যখন রক্ত কণিকা অস্বাভাবিক ভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেড়ে যায় শরীরে এবং রক্ত কণিকার স্বাভাবিক কার্যে হস্তক্ষেপ হয়, যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং নতুন রক্ত কণিকা তৈরি করে। ব্লাড ক্যানসার অনেক ধরনের হতে পারে যেমন – লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা, মাল্টিপল মায়েলোমা, মায়েলোডিসপ্লাটিক সিনড্রোম ও মায়েলোপলিফারেটিভ নিওপ্লাজম ইত্যাদি।

ব্লাড ক্যান্সারের কারন
অন্যান্য ক‍্যান্সারের মত ব্লাড ক‍্যান্সার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই হতে পারে। রক্ত কনিকার মধ‍্যে ডিএনএ-তে পরিবর্তনের (Mutation of DNA) কারনে ব্লাড ক‍্যান্সার হয়। মানুষের ব্লাড ক‍্যান্সার হওয়ার ঝুঁকির কারনগুলোর মধ‍্যে রয়েছে – রেডিয়েশন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল, কীটনাশক, ভেজাল খাবার, বয়স (advance age), ধূমপান, শরীরের অতিরিক্ত ওজন, পুরুষ, কেমোথেরাপি ড্রাগস ও কিছু জেনেটিক অসুখ।

ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষণ
ব্লাড ক‍্যান্সারের লক্ষণগুলোর মধ‍্যে রয়েছে – জ্বর, ঠান্ডা লাগা, ক্লান্তি ও দুর্বলতা, খাবারে অরুচি ও বমি বমি ভাব, বুক ধড়ফড়, ওজন কমে যাওয়া, পায়ে পানি জমে যাওয়া, ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, পেট ব‍্যথা, মাথা ব‍্যথা, হাড়/জয়েন্টে ব্যথা অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ (দাঁতের গোড়া, প্রস্রাব–পায়খানা ও কাশির সঙ্গে রক্ত পড়া, মাসিক বেশি হওয়া ইত্যাদি)। লিম্ফনোড/গ্ল্যান্ড ফুলে যাওয়া, লিভার-প্লীহা বড় হওয়া।

কীভাবে ব্লাড ক‍্যান্সার নির্ণয় করা হয়
রোগ নির্ণয় সাধারনত রোগীর সাথে কথা বলে ও শারীরিক পরীক্ষা দিয়ে শুরু হয়। তারপর রোগীর উপসর্গ ও লক্ষণগুলো দেখে সন্দেহ হলে সঙ্গে সঙ্গে রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। রক্ত পরীক্ষায় কোন অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে যেমন – হিমোগ্লোবিন, ডব্লিউবিসি ও প্লাটিলেট কমে বা বেড়ে গেলে। তারপর, আল্ট্রাসাউন্ড, এক্স-রে, সিটি, এমআরআই, বায়োপসি ও হিস্টোপ‍্যাথলজী, বোনম্যারো টেস্ট, ফ্লোসাইটোমেট্রি, মলিকুলার সাইটোজেনেটিক টেস্ট ও এনজিএস টেস্ট করে ব্লাড ক‍্যান্সার নির্ণয় করা হয়ে।

ব্লাড ক‍্যান্সারের চিকিৎসা
ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ভর করে ক্যান্সারের ধরন, রোগীর বয়স, ক্যান্সার কত দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, ক্যান্সার কোথায় ছড়িয়েছে এবং অন্যান্য কারণের উপর। সাধারণত কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, মলিকুলার টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউনো থেরাপি ও অস্থিমজ্জা/স্টেম সেল প্রতিস্থাপন (Bone marrow/Stem cell Transplant) করে ব্লাড ক‍্যান্সারের চিকিৎসা করা হয়।

ব্লাড ক‍্যান্সার কি ভালো হয়
ক‍্যান্সার রোগের কথা শুনলেই আতঙ্ক উঠতে হবে এবং ক্যান্সার মরণব্যাধি এটা চিন্তা করে আগানো ঠিক না। অন‍্য রোগের মত ক‍্যান্সারের চিকিৎসা আছে। তাড়াতাড়ি সঠিক সময়ে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় (Early diagnosis) করে চিকিৎসা দিতে পারলে অনেক ব্লাড ক্যানসার ভালো হয় ও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে একিউট ব্লাড ক‍্যান্সার (Acute blood cancer) খুবই মারাত্মক, যার দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হয়। ক্রনিক ব্লাড ক‍্যান্সারের (Chronic blood cancer) রোগী সঠিক চিকিৎসা নিয়ে অনেক দিন ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পর্যায় বুঝে কেমোথেরাপি বা শুধু ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করলে ব্লাড ক‍্যান্সার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ব্লাড ক‍্যান্সার যে ধরনেরই হোক না কেন, চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি। অস্থিমজ্জা/স্টেম সেল প্রতিস্থাপন (Bone marrow/Stem cell Transplant), মলিকুলার টার্গেটেড থেরাপি এবং ইমিউনো থেরাপি আবিষ্কৃত হওয়ায় ব্লাড ক‍্যান্সার চিকিৎসায় উন্নতি ঘটেছে। তাই, আতঙ্কিত হবেন না, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিন এবং ক‍্যান্সারকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

লেখক : ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম
সিনিয়র সাইন্টিষ্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি

Exit mobile version