Site icon স্বাস্থ্য ডটটিভি

গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত গরম লাগা – কারণ, ঝুঁকি এবং প্রতিকার

গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত গরম লাগা

সাধারণত গর্ভাবস্থাতে আপনার শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক সময়ের মতোই থাকে। তবে অনেক মা-ই গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত গরম লাগার কথা বলে থাকেন। এ ছাড়া আমাদের দেশের আবহাওয়ায় গরমের মধ্যে গর্ভধারণ করা কিছুটা অস্বস্তিকর হতে পারে।

অতিরিক্ত গরমে পানিশূন্যতা থেকে হিট এক্সোশন, হিট স্ট্রোক এর মতো জটিলতাও হবার সম্ভাবনা থাকে। গর্ভাবস্থায় গরম লাগলে কীভাবে সহজে স্বস্তিতে থাকবেন এবং নিজেকে সুরক্ষিত রাখবেন—তা এই আর্টিকেলটিতে তুলে ধরা হয়েছে।

অতিরিক্ত গরম লাগার কারণ

সাধারণত আমাদের যখন গরম লাগে, তখন আমাদের শরীর ঘামের মাধ্যমে ঠান্ডা হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো কারণে শরীরে পানির ঘাটতি থাকলে ঘাম কম তৈরি হয় ফলে ঘামের মাধ্যমে অতিরিক্ত তাপ বের করে দেওয়া সম্ভব হয় না। গর্ভাবস্থায় পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। এর ফলে ঘামের মাধ্যমে শরীর ঠান্ডা হতে পারে না এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরম লাগে।

আবার গর্ভাবস্থায় আপনি নিজের পাশাপাশি গর্ভের শিশুকেও বহন করেন। এতে করে আপনার শরীরের সব অঙ্গকেই স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। যার ফলে আপনার শরীরে মেটাবোলিজম বা খাদ্য হজমের হারও বাড়ে। উচ্চ মেটাবলিক হারের ফলে শরীরে বাড়তি তাপ উৎপন্ন হয়। এ কারণেও অতিরিক্ত গরম লাগতে পারে।

 

পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় আপনার শরীরে বিভিন্ন হরমোন এর মাত্রায় তারতম্য ঘটে। অতিরিক্ত হরমোনও গরম লাগার পেছনে দায়ী হতে পারে। এ ছাড়াও আপনার শিশুর শরীরে পুষ্টি উপাদান সরবরাহের জন্য আপনার শরীরের রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত রক্ত প্রবাহ থেকেও অতিরিক্ত গরম লাগতে পারে।

 

যাদের সমস্যা হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকে

গর্ভাবস্থায় যেকোনো মায়েরই অতিরিক্ত গরম লাগতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে আপনার সমস্যা বেশি হতে পারে। যেমন—

অতিরিক্ত গরম থেকে জটিলতা

গর্ভাবস্থায় আপনার শরীরের তাপমাত্রা যদি ৩৯° সেন্টিগ্রেড বা ১০২.২° ফারেনহাইটের ওপরে হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে আপনার নিচের সমস্যাগুলো দেখা যেতে পারে—

হিট ক্র্যাম্প

আপনি যদি গরমের মধ্যে শরীরচর্চা বা ব্যায়াম করে থাকেন সেক্ষেত্রে আপনার শরীরে এক ধরনের খিঁচুনি হতে পারে। সাধারণত ব্যায়ামের ফলে যেই অতিরিক্ত ঘাম হয় তার সাথে শরীরের লবণ ও পানি বেশি পরিমাণে বের হয়ে গেলে এমনটা হয়ে থাকে। এর ফলে আপনার হাত, পা ও পেট ব্যথা হতে পারে।

হিট ক্র্যাম্প হলে করণীয়

যখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন

ডিহাইড্রেশন

শরীর গরম হয়ে গেলে ঘাম বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে দেহ থেকে যে পরিমাণ পানি বের হয়ে যায়, সে তুলনায় আপনার পানি গ্রহণের পরিমাণ কম হলে আপনার শরীরে পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন দেখা যেতে পারে।

পানিশূন্যতা হলে আপনার শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হতে পারে। এমনকি আপনার প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল দিয়ে রক্ত প্রবাহ কমে যেতে পারে। ডিহাইড্রেশনের ফলে আপনার ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন নামের প্রসবের প্রস্তুতিমূলক সংকোচন শুরু হয়ে যেতে পারে। পানিশূন্যতার কারণে আপনি দাঁড়াতে গেলে মাথা ঘুরিয়ে পড়েও যেতে পারেন।

আপনার ডিহাইড্রেশন হয়েছে কীভাবে বুঝবেন

হাত পা ফুলে যাওয়া

গরমের মধ্যে আপনার শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিলে আপনার শরীর নিজ থেকে পানি ধরে রাখার চেষ্টা করে। এই অতিরিক্ত পানি শরীরের নিচের দিকের অংশগুলোতে জমা হয়। বিশেষ করে যখন আপনি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। এর ফলে আপনার হাত-পা, গোড়ালি, পায়ের পাতা ফুলে যেতে পারে—একে ডাক্তারি ভাষায় ইডেমা বা সোয়েলিং বলে।

গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই হাত-পায়ে পানি জমার প্রবণতা থাকে, অতিরিক্ত গরমের কারণে তা আরও বেড়ে যায়।

হাত-পা ফুলে যাওয়া রোধে করণীয়

এসবের পাশাপাশি নিচের ব্যায়ামটিও করতে পারেন—

হিট র‍্যাশ বা ফুসকুড়ি বা ঘামাচি

গর্ভাবস্থায় গরম থেকে আপনার ছোটো ছোটো ফুসকুড়ি বা র‍্যাশ হতে পারে। এসব ফুসকুড়ি গুচ্ছাকারে থাকে এবং অনেকটা ব্রণ বা ছোটো ফোস্কার মতো দেখায়। কাঁধ, বুক, বগল, কুঁচকিতে সাধারণত এসব ফুসকুড়ি বা ঘামাচি বেশি হয়ে থাকে।

হিট র‍্যাশ হলে করণীয়

মেলাসমা

এটি গর্ভাবস্থায় গরম থেকে হওয়া ত্বকের পরিচিত একটি সমস্যা। এর ফলে ত্বকের কিছু কিছু জায়গায় বাদামী অথবা ধূসর রঙের ছোপ ছোপ দাগ পড়ে। বিশেষত মুখে এ ধরনের সমস্যা হয়। প্রতি দুই জনের মধ্যে একজন গর্ভবতীর এ ধরনের সমস্যা হতে পারে।

মেলাসমা প্রতিরোধে করণীয়

গর্ভাবস্থায় মেলাসমা নিয়ে চিন্তিত হবেন না। গর্ভাবস্থার কারণে আপনার এ সমস্যা হলে প্রসবের কয়েক মাসের মধ্যেই সাধারণত এটি সেরে যাবে।

হিট এক্সোশন

অতিরিক্ত গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় থাকলে আপনার হিট এক্সোশন হতে পারে। এটি এক ধরনের হাইপারথার্মিয়া বা উচ্চ তাপমাত্রা জনিত সমস্যা। দ্রুত চিকিৎসা করা না হলে এটি হিট স্ট্রোকে পরিণত হতে পারে।

হিট এক্সোশন এর ক্ষেত্রে যদি আধা ঘন্টা বা এক ঘন্টার মধ্যে আপনি সুস্থ বোধ করেন সেক্ষেত্রে আপনার বিশেষ কোনো চিকিৎসার দরকার হবে না। তবে এক ঘন্টার মধ্যে অবস্থার উন্নতি না হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

 

হিট এক্সোশনে আপনার নিচের লক্ষণগুলি দেখা দিতে পারে

 

হিট এক্সোশন হলে করণীয়

হিট স্ট্রোক

হিট স্ট্রোক উচ্চ তাপমাত্রাজনিত একটি মারাত্মক জটিলতা। এতে শরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারায় ফলে দ্রুত শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে।  এমনকি ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে তাপমাত্রা ১০৬° কিংবা আরও বেশি বাড়তে পারে৷ জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা না হলে এতে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

হিট স্ট্রোকের বিপদচিহ্ন

নিচের লক্ষণগুলি দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন—

গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত গরম লাগার পাশাপাশি এসব লক্ষণের যেকোনোটা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। হিট স্ট্রোকের ফলে আপনার হার্ট, ব্রেইন, কিডনি, মাংসপেশির সমস্যা হতে পারে। তাই এসব লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা করা যাবে না।

হিট স্ট্রোক হলে প্রাথমিক করণীয়

অতিরিক্ত গরম থেকে প্রতিরোধ

নিচের কিছু সহজ পরামর্শ মেনে চলার মাধ্যমে গর্ভাবস্থায় ওভারহিটিং হওয়া থেকে স্বস্তি পেতে পারেন—

১. পর্যাপ্ত পানি পান করুন: একজন সুস্থ-স্বাভাবিক গর্ভবতী নারীর প্রতিদিন গড়ে ২–৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। কাপ কিংবা গ্লাসের হিসাবে আপনাকে সারাদিনে মোট ৮–১২ গ্লাস পানি পান করতে হবে। তবে এই বিষয়ে কখনো যদি আপনার ডাক্তার কোনো বিশেষ পরামর্শ দিয়ে থাকেন তাহলে সেটিই অনুসরণ করবেন। প্রয়োজনে ঘরের বাইরে গেলে পানির বোতল সাথে নিন।

২. নিয়মিত গোসল করুন: গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত গরম লাগলে নিয়মিত গোসল করুন। প্রয়োজনে ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছুন। গোসলের পানির তাপমাত্রা যেন ৩২° সেন্টিগ্রেড এর বেশি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

৩. আরামদায়ক পোশাক পরুন: গরমের সময় যেন বাতাস চলাচল করতে পারে এমন ঢিলেঢালা পোশাক পরুন। সুতি ও লিনেন এর কাপড় এসময় আরামদায়ক। হালকা রঙের পোশাক সূর্যের আলো কম শোষণ করে। গর্ভাবস্থায় হালকা রঙের পোশাক পরুন এবং কালো বা গাঢ় রঙের পোশাক এড়িয়ে চলুন।

৪. খাবার গ্রহণে সতর্ক হোন: গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত গরম লাগলে হালকা খাবার খান। ফল, সালাদ জাতীয় খাবার এবং সহজে পরিপাক হয় এমন খাবার খান। যেসব খাবারে পানির পরিমাণ বেশি (যেমন: তরমুজ) এমন ফলমূল খেতে পারেন।

৫. কাজ গুছিয়ে নিন: গর্ভাবস্থায় যতটুকু সম্ভব বাইরের কাজ এড়িয়ে চলুন। রোদের মধ্যে কাজ করতে হলে কিছুক্ষণ পর পর ছায়ায় বিশ্রাম নিন এবং পানি পান করুন। গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত গরমে ব্যায়াম বা ভারী কাজকর্ম এড়িয়ে চলুন।

৬. কড়া রোদ এড়িয়ে চলুন: সকাল ১০টা–১১টা থেকে বিকেল ২টা–৩টা পর্যন্ত কড়া রোদ থাকে। প্রয়োজন ব্যতীত এসময় ঘরের বাইরে বের হওয়া এড়িয়ে চলুন। ঘরে থাকা অবস্থায় বাইরে খুব বেশি কড়া রোদ থাকলে পর্দা টেনে দিন।

৭. রোদ প্রতিরোধী দ্রব্য ব্যবহার করুন: কড়া রোদে বাইরে বের হতে হলে ছাতা ব্যবহার করুন এবং ছায়াযুক্ত স্থানে থাকুন। ছাতা না থাকলে হ্যাট বা টুপি ব্যবহার করুন এবং চোখে সানগ্লাস পরুন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গর্ভাবস্থায় নিরাপদ এমন সানস্ক্রিন (SPF 30+) ব্যবহার করুন।

৮. প্রস্রাবের দিকে নজর দিন: আমাদের শরীরে পানিশূন্যতা দেখা গেলে কিডনি ঘন গাঢ় রঙের কম পরিমাণে প্রস্রাব তৈরি করে। অর্থাৎ কম পরিমাণে ও গাঢ় রঙের প্রস্রাব আপনার শরীরে পানিশূন্যতা নির্দেশ করে। তাই এসময় প্রস্রাবের দিকেও খেয়াল রাখুন।

Exit mobile version