হৃদপিণ্ডের ছন্দপতন

একজন ৭০ বছর বয়েসী মানুষ এবং ১৫ বছর আয়ুষ্কালের একটি মোরগ সারাজীবন গড়ে ২০০ কোটি বার হৃদস্পন্দন ঘটায়। কিন্তু মানুষের গড় হৃদস্পন্দন বা হার্টবিট মিনিটে ৭০ হলেও মোরগের ক্ষেত্রে তা ২৭৫। এই যে ২০০ কোটিবার হার্টবিট ঘটল তা কি অবিরাম নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে? না, তা চলে না। কখনো কখনো হার্টবিট তার তাল এবং লয় কেটে ফেলে। কখনো তা শরীরের প্রয়োজনে দ্রুত লয়ে আবার কখনো তা ধীরলয়ে বয়ে চলে।

রোগীরা প্রায়শই বলে থাকেন যে, তাদের ড্রপ বিট হচ্ছে। আমি বলি- সমস্তদিন যদি আকাশ মেঘমুক্ত নীল হয়ে থাকে তা যেমন ভালো নয় তেমনি ড্রপবিটমুক্ত নিরবচ্ছিন্ন হার্টবিটও ভালো নয়। তবে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হলে তার কারণ নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা জরুরি হয়ে পড়ে।

ড্রপবিট যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন রোগী হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারেন। হঠাৎ মূর্ছা গিয়ে মাথায় মারাত্মক আঘাত পেতে পারেন, রানের বড় হাড় ভেঙে যেতে পারে, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে।

গ্রামেগঞ্জে শোনা যেত, অমুককে ঘুমের মধ্যে ভূতে মেরে ফেলেছে, কিংবা সুস্থ সবল মানুষটি জ্বীনের আছর লেগে মরে গেল। এমনকি কোনো কোনো পরবিবারের একাধিক সদস্য অল্প বয়সে হঠাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।

এবার আসা যাক কোন্ কোন্ রোগের কারণে হৃদপিণ্ডের স্বাভাবিক ছন্দপতন ঘটে-
১। হৃদপিণ্ডের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থায় সমস্যা।
২। রক্তনালীর ব্লকের সমস্যা
৩। হৃদপিণ্ডের মাংসপেশির সমস্যা
৪। ভাল্ভের সমস্যা
৫। হৃদপিণ্ডের আচ্ছাদন বা পেরিকার্ডিয়ামের রোগ
৬। শরীরের অন্যান্য অঙ্গের রোগের কারণে হৃদপিণ্ডের ছন্দপতন সমস্যা।
এবার এক এক করে দেখা যাক –

১। একটি বাড়িতে যেমন পানির লাইন, বৈদ্যুতিক লাইন থাকে হার্টের ক্ষেত্রেও তেমনি রয়েছে। হার্টের পানির লাইন হলো রক্তনালী বা করোনারী ধমনীসমূহ। আর বৈদ্যুতিক লাইন হলো তার সুনির্দিষ্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ লাইনসমূহ।
হৃদপিণ্ডের ডান অলিন্দের ( atrium) উপরিভাগের ছাদে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ( SA node) রয়েছে। সেখান থেকে কতগুলো সুনির্দিষ্ট সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে হৃদপিণ্ডের চারটি চেম্বারে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ লাইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জালিকা সমগ্র হার্টের মাংসপেশিকে সংযুক্ত এবং উদ্দীপ্ত করে। এই উদ্দীপনার ফলেই হার্টের মাংসপেশিগুলো সংকোচন প্রসারণ ক্রিয়ার মাধ্যমে আজীবন গড়ে ২০০ কোটিবার বিট করে আমাদের প্রাণভোমরাকে বাঁচিয়ে রাখে।

এখন এই যে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণ ব্যবস্থা তার যেকোন পর্যায়ে গলদ দেখা দিতে পারে। যদি তা সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে যায় তখন তা মেরামত করবার প্রয়োজন দেখা দেয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান অত্যন্ত কার্যকরভাবে বিভিন্ন ডিভাইস ( যেমন পেসমেকার ) এর সাহায্যে এই সমস্যার সমাধান করে দিতে সক্ষম। প্রথম দিককার পেসমেকার বড় সাইজের ছিল এবং ভবিষ্যতে রোগীর এমআরআই করবার প্রয়োজন হলে তা করা যেত না। এখনকার পেসমেকার অত্যন্ত ছোট এবং এমআরআই সহনশীল। কলার বোন এর একটু নীচে লোকাল অবশ করে মাত্র এক ইঞ্চি পরিমাণ চামড়া কেটে এটি স্থাপন করে দিলে ১০ থেকে ১৫ বছর নিশ্চিন্তে রোগীকে নিরাপদে রাখা যায়।

২। রক্তনালীর ব্লকের সমস্যা :
আগেই বলেছি হৃদপিণ্ডের পানির লাইন হলো করোনারী ধমনী বা রক্তনালীর জাল। পানির লাইন যেমন জং ধরে সরু হয়ে যেতে পারে তেমনি বিভিন্ন রোগে( যেমন ডায়াবেটিস, হাই কোলেস্টেরল, হাই প্রেসার, ধূমপান ইত্যাদি) রক্তনালীর পথ সরু হয়ে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হতে পারে। রক্তের মাধ্যমে যেহেতু অক্সিজেন এবং খাদ্য প্রতিটি কোষে পৌঁছায় তাই সেটি সরু বা ব্লক হয়ে গেলে মাংসপেশির কাজ দুর্বল বা অকেজো হয়ে পড়তে পারে। তার উপসর্গ হিসেবে হৃদপিণ্ডের তাল কেটে ( arrhythmias) যেতে পারে। রোগী হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে বা মাথা ঘুরে পড়বার উপক্রম হতে পারে।

কারণ জানা গেলে চিকিৎসা সহজ হয়ে যায়। এনজিওগ্রাম এর মাধ্যমে ব্লক নির্ণয় করে যথাযথ ওষুধ প্রয়োগ , প্রয়োজনে রিং (Stenting) পরিয়ে বা ওপেন হার্ট সার্জারী করে নিলে সমস্যার একটা টেকসই সমাধান মিলবে।

৩। হৃদপিণ্ডের মাংসপেশির সমস্যা (cardiomyopathy) :
হঠাৎ মৃত্যুর একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো মাংসপেশির রোগ। হৃদপিণ্ড যে চারটি কক্ষ বা চেম্বার দিয়ে তৈরী তার মধ্যে বাম নিলয় (ventricle) এবং ডান নিলয়ের দেয়ালগুলো অস্বাভাবিক হারে মোটা হয়ে যেতে পারে। তাতে এই চেম্বারগুলো ঠিকমত সংকোচন প্রসারণ কাজ করতে পারে না। শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে এটি বংশগতভাবে ছড়ায়। দেখা যায় যে, একই পরিবারের একাধিক সদস্য অল্প বয়সে হঠাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

কার্ডিওমায়োপ্যাথীর চিকিৎসায় যথাযথ ওষুধ প্রয়োগ, বাড়তি মাংসপেশি বেলুন এলকোহল এনজিওপ্লাস্টি বা অপারেশন করে চেঁছে ফেলা সহ ছন্দপতনরোধী মেশিন ( AICD – পেসমেকার এর মত একধরণের স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক শক দেবার ব্যাটারী) কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

এই রোগে একজন আক্রান্ত হলে পরিবারের অন্য সদস্যদেরকে পরীক্ষা করা উচিত যাতে সমস্যা গুরুতর হবার আগেই তা প্রতিরোধ করা যায়।

৪। হৃদপিণ্ডের ভাল্ভের সমস্যা :
হৃদপিণ্ডের যে চারটি ভাল্ভ রয়েছে তার মধ্যে বাম নিলয়ের প্রবেশমুখ ( mitral valve) এবং বহির্মুখ( aortic valve) এর সমস্যাই মূলত প্রধান। এর মধ্যে অল্প বয়সে বাতজ্বর থেকে মাইট্রাল ভাল্ভ এবং বেশি বয়সে ক্যালসিফিক এয়োর্টিক ভাল্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এবং এক পর্যায়ে ছন্দপতন ( atrial fibrillation) ঘটিয়ে রোগীকে স্ট্রোক সহ নানান জটিলতায় ফেলতে পারে।
কারণের চিকিৎসার পাশাপাশি অলিন্দে যাতে রক্ত জমাট বাঁধতে না পারে সেজন্য যথাযথ ওষুধ ( warfarin) প্রয়োগ করে মৃত্যুঝুঁকি কমিয়ে আনতে হবে।

৫। হৃদপিণ্ডের আচ্ছাদন বা পেরিকার্ডিয়ামের সমস্যা :
মায়ের কোল যেমন শিশুকে আগলে রাখে পেরিকার্ডিয়াম তেমনি হৃদপিণ্ডকে চারিদিক থেকে নিরাপত্তার জালে ঘিরে রাখে। কিন্তু বিভিন্ন রোগ যেমন যক্ষ্মা, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ক্যানসার ইত্যাদি দিয়ে পেরিকার্ডিয়াম নিজেই আক্রান্ত হতে পারে। এর ফলে হার্ট স্বাভাবিকভাবে সংকোচন প্রসারণ কাজ করতে পারে না। অসুস্থ শক্ত পেরিকার্ডিয়াম তখন সাঁড়াশির মত হৃদপিণ্ডকে চেপে ধরে। হার্ট ফেইল্যুর সহ বিভিন্ন ছন্দহীনতা ( arrhythmias) সৃষ্টি করে।
কারণের চিকিৎসা করলেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

৬। হৃদপিণ্ডের বাইরের কারণে ছন্দপতন :
হৃদপিণ্ড একটি বিশেষায়িত অঙ্গ হলেও এটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বরং শরীরের নানান রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়ার দ্বারা প্রভাবিত। যেমন ফুসফুসের কোন রোগ( Covid lungs) , থাইরয়েড হরমোনের রোগ, এমনকি মস্তিস্কের কিছু কিছু রোগও হৃদপিণ্ডের ছন্দপতন ঘটাতে পারে। তাই এর চিকিৎসা করাতে গেলে চিকিৎসকদের সবদিকে সতর্ক নজর দিতে হয়।
———————
লেখক: ডা. মাহবুবর রহমান, সিনিয়র কনসালটেন্ট ও সিসিইউ ইন-চার্জ
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল

Exit mobile version