রক্তের তিন ধরনের কণিকা থাকে যেমন- রেড ব্লাড সেল (আরবিসি) বা লোহিত রক্ত কণিকা, হোয়াইট ব্লাড সেল (ডব্লিউবিসি) বা শ্বেত রক্ত কণিকা এবং প্লেটলেট (অনুচক্রিকা)। অস্থিমজ্জার ভেতরে এ রক্ত কণিকাগুলো তৈরি হয়ে শিরা-উপশিরার মাধ্যমে সব শরীরে প্রবাহিত হয়। ব্লাড ক্যান্সার হলো রক্ত বা অস্থিমজ্জার ভেতর শ্বেত রক্ত কণিকার (হোয়াইট ব্লাড সেল/ডব্লিউবিসি) অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।
ব্লাড ক্যান্সারের কারণ কী
এর প্রকৃত কারণ জানা নেই। তবে রেডিয়েশন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল, কীটনাশক বা পেস্টিসাইড, ভেজাল খাবার, হেয়ার ডাই, লুব্রিকেন্টস, বার্নিশ, কেমোথেরাপি ড্রাগস ও কিছু জেনেটিক অসুখ দায়ী থাকতে পারে।
উপরোক্ত যে কোনো কারণে অস্থিমজ্জার ভেতরের স্টিমসেল (মাদার সেল)-এর মিউটেশন বা অন্য কোনো পরিবর্তন হলে ক্যান্সার সেল (ব্লাস্ট) বা অপরিপক্ব কোষ তৈরি হয়, যা অস্থিমজ্জার ভেতরে অতিদ্রুত বৃদ্ধি হয়।
যে কোনো বয়সে, যে কোনো জেন্ডারেরই লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা হতে পারে।
ব্লাড ক্যান্সারের উপসর্গ ও লক্ষণ কী
* রক্তস্বল্পতার জন্য দুর্বলতা, খাবারের অরুচি, বুক ধড়ফড়, পায়ে পানি জমে যাওয়া, ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
* দীর্ঘদিনের জ্বর বা ঘনঘন জ্বর।
* অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ (শরীরে র্যাশ, দাঁতের গোড়া-প্রস্রাব-পায়খানা-কাশির সঙ্গে রক্ত পড়া, মাসিক বেশি হওয়া ইত্যাদি)।
* গ্লান্ড ফুলে যাওয়া, লিভার-প্লীহা বড় হওয়া।
* হাড়ে ব্যথা।
উপসর্গ ও লক্ষণগুলো কেন হয়
লোহিত রক্ত কণিকার ঘাটতিতে রক্তস্বল্পতা, অস্বাভাবিক শ্বেতরক্ত কণিকার কারণে ইনফেকশন বা জ্বর এবং প্লেটলেট (অনুচক্রিকার) ঘাটতিতে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। অস্বাভাবিক রক্ত কণিকা (ক্যান্সার সেল) গ্লান্ড-লিভার-প্লীহায় জমতে বা ভাঙতে থাকলে গ্লান্ড-লিভার-প্লীহা বড় হয়।
অস্থিমজ্জার ভেতর ক্যান্সার সেল (ব্লাস্ট) এত বেশি বেড়ে যায় যে, লোহিত রক্তকণিকা ও অনুচক্রিকা বৃদ্ধি হওয়ার মতো জায়গা পায় না ফলে ঘাটতি দেখা দেয়। ক্যান্সার সেল অস্থিমজ্জার ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ফলে হাড্ডির ভেতর প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়।
ব্লাড ক্যান্সার কি ছোঁয়াচে রোগ?
না, ব্লাড ক্যান্সার কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়।
কীভাবে ব্লাড ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়
ব্লাড ক্যান্সারের উপসর্গ ও লক্ষণগুলোর সঙ্গে সঙ্গে রক্তের সিবিসি পরীক্ষায় অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। যেমন- হিমোগ্লোবিন ও প্লেটলেট কমে যাওয়া, ডব্লিউবিসি বেড়ে যাওয়া অথবা হিমোগ্লোবিন, প্লেটলেট ও ডব্লিউবিসি কমে যাওয়া। বোনম্যারো টেস্ট, ফ্লোসাইটোমেট্রি, সাইটোজেনেটিক স্টাডি করে ব্লাড ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়ে থাকে। কিছু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে গ্লান্ড বা টিস্যু বায়োপসি এবং পরবর্তী সময়ে ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি করা লাগে।
ব্লাড ক্যান্সারের প্রকারভেদ
লিউকেমিয়া মূলত দুই ধরনের। একিউট লিউকেমিয়া ও ক্রনিক লিউকেমিয়া। লিম্ফোমা, মাল্টিপল মায়েলোমাও এক ধরনের ব্লাড ক্যান্সার।
একিউট লিউকেমিয়া আবার দুই ধরনের যথা ১. একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা এএলএল এবং ২. একিউট মায়েলোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা এএমএল।
ক্রনিক লিউকেমিয়াও দুই ধরনের যেমন- ১. ক্রনিক মায়েলোয়েড লিউকেমিয়া বা সিএমএল ও ২. ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া বা সিএলএল।
লিম্ফোমা নামক ক্যান্সার দুই ধরনের যেমন- হজকিনস লিম্ফোমা ও নন হজকিনস লিম্ফোমা।
মাল্টিপল মায়েলোমাও ব্লাডের শ্বেতরক্ত কণিকার বি-লিম্ফোসাইট থেকে তৈরি প্লাজমা সেল ক্যান্সার।
ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা কী
সাধারণত কেমোথেরাপি দিয়ে ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হয়। কী ধরনের ওষুধ বা কেমোথেরাপি দিতে হবে এবং ফলাফল কী হবে তা জানার জন্য লিউকেমিয়া, লিম্ফোমাকে পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন উপভাগে ভাগ করা হয়।
ব্লাড ক্যান্সার মানেই মরণব্যাধি নয়। সঠিক সময়ে নির্ভুল রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা নিলে অনেক ব্লাড ক্যান্সার ভালো হয় ও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
একিউট লিউকেমিয়া খুবই মারাত্মক। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হয়।
যে প্রকারেরই একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া (এএলএল) হোক না কেন, চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদি। শুধু কেমোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করলে দুই থেকে আড়াই বছর চিকিৎসা নিতে হয়।
একিউট মায়েলোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া (এএমএল) মূলত আট প্রকারের যেমন- এম- ০, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬ ও ৭।
এএমএল এম-২, ৪ কে শুধু কেমোথেরাপি দিয়ে টানা ৪ মাস চিকিৎসা করলে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা অনেক; কিন্তু ব্যয় বহুল যা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না।
এম-৩ বা এপিএল নামক ব্লাড ক্যান্সারকে পর্যায় বুঝে শুধু ওষুধ বা কেমোথেরাপি দিয়ে টানা ছয় মাস থেকে দুই বছর চিকিৎসা করলে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৮০ শতাংশের বেশি।
এএমএল-এম২, ৩ ও ৪ ছাড়া বাকি এএমএল এবং কিছু এএলএল নামক ব্লাড ক্যান্সারের জন্য বিএমটি বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ছাড়া কার্যকর কোনো চিকিৎসা নেই।
ক্রনিক লিউকেমিয়ারও প্রকারভেদ আছে। চিকিৎসার ধরনও ভিন্ন ভিন্ন। ক্রনিক লিউকেমিয়ার রোগী সঠিক চিকিৎসা নিয়ে অনেকদিন ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারে।
মলিকিউলার টার্গেটেড থেরাপি আবিষ্কার হওয়ায় অনেক ক্যান্সার কিউর হয়। ক্রনিক মায়েলোয়েড লিউকেমিয়া (সিএমএল) তার মধ্যে অন্যতম।
যে কোনো লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা বা মায়েলোমার ক্ষেত্রে প্রথম ধাপের কেমোথেরাপি কাজ না করলে বা রোগ ফিরে এলে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন (বিএমটি) করতে হয়, যা অত্যন্ত ব্যয় বহুল এবং জটিলতা বেশি।
বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসার প্রতিবন্ধকতা
* ক্যান্সার চিকিৎসার পূর্ব শর্ত হলো সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়। কারণ ব্লাড ক্যান্সারের অনেক উপভাগ আছে এবং এই উপভাগের চিকিৎসা ও ফলাফল ভিন্ন ভিন্ন। আমাদের গুণগত মানের উন্নত ল্যাব ও দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে।
* ক্যান্সার চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। অনেকের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ের পরে চিকিৎসা নেওয়ার মতো সামর্থ্য থাকে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্যান্সার রোগীর আর্থিক সহায়তা বাড়ানো দরকার।
* টিম ওয়ার্ক: দক্ষ টেকনোলজিস্ট, নার্স ও চিকিৎসক ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য অত্যাবশ্যক। তাই দক্ষ জনবলের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ভালো টিম ওয়ার্ক বাড়াতে হবে। চিকিৎসার জন্য শুধু চিকিৎসক একমাত্র উপাদান নয়।
* ওয়ান স্টপ সার্ভিস: বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসার ওয়ানস্টপ সার্ভিস নেই। সব পরীক্ষা ও চিকিৎসা একই হাসপাতালে করা যায় না। পরীক্ষা করাতে হয় দুই-তিন জায়গায় (দেশে-বিদেশে), কেমোথেরাপি এক জায়গায় তো রেডিওথেরাপি অন্য জায়গায়।
জাতীয় হেমাটোলজি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে ওয়ানস্টপ সার্ভিস দেওয়া সম্ভব।
লেখক : ডা. মো. কামরুজ্জামান, রক্তরোগ, ব্লাড ক্যান্সার ও বিএমটি বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা