মানুষ নিজেরা কিনে খাচ্ছে এন্টিবায়োটিক থেকে শুরু করে পেইনকিলার। এমনকি ক্যান্সারের ওষুধও। অথচ এমনটি হওয়ার কথা নয়। কেবল ওটিসি বা ওভার দ্য কাউন্টার ওষুধ ছাড়া ওষুধ কিনতে প্রেসক্রিপশন লাগার কথা। লিখেছেন ডা. সাবরিনা মিষ্টি
না জানি কী অসুখের কথা বলেন ডাক্তার- হয়তো অনেক টেস্ট লিখে দেবেন_এই আশঙ্কায় মানুষ ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। তাছাড়া আর্থিক বা লম্বা সিরিয়ালের সমস্যা তো আছেই। তাই অনেক সময় বড় ধরনের সমস্যা নিয়েও রোগী
ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় না। সেখানে ছোটখাট সমস্যা যেমন মাথাব্যথা, জ্বর, কাশি, এলার্জি ইত্যাদির জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। প্রতিবেশী বা আত্দীয়স্বজনের উপদেশ, ওষুধের দোকানদারের পরামর্শ অথবা ওষুধ সম্বন্ধে নিজেদের পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেরাই এভাবে ওষুধ কিনে খাওয়া শুরু করে। ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা আপাতদৃষ্টিতে সুবিধাজনক মনে হলেও অনেক সময়ই ঘটতে পারে মারাত্দক সমস্যা।
ওটিসি কী?
ওটিসি হলো সেই সব ওষুধ, যেগুলো ক্রেতা সরাসরি দোকান থেকে কিনতে পারেন কোনো রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই।
এগুলো সেবনের পূর্বে ও সেবনকালে চিকিৎসাধীন (হাসপাতালে বা ক্লিনিকে) থাকার প্রয়োজন নেই। এগুলো অবশ্যই এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন) কর্তৃক অনুমোদিত ও দেশের সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী কমিটি দিয়ে নির্ধারিত হতে হবে।
ওটিসি কিভাবে এল?
আগে প্রেসক্রিপশন ছাড়া সেবনের পরিমাণ ছিল বেশি। প্রায় সময়ই ঘটত মারাত্দক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অথবা অনির্দিষ্ট মাত্রাজনিত সমস্যা। এ কারণে ১৯৩৮ সালে তৈরি হয় ফুড, ড্রাগ ও কসমেটিক আইন (এফডি অ্যান্ড সি) এবং খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) একটি ধারণা প্রকাশ করে ওটিসি সম্বন্ধে। কিন্তু সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করা হয় ১৯৫১ সালে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোন ওষুধ খাওয়া যাবে না ও কোনগুলো যাবে এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী নীতি নির্ধারণ করা হয়।
ওটিসির ওষুধগুলো যেমন হবে
* অবশ্যই এফডিএ ও দেশের আইন কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে।
* ওষুধের মোড়কে ও স্ট্রিপে কোম্পানির বাজারজাত বা ব্রান্ড নামের সঙ্গে সঙ্গে জেনেরিক নাম (যা থেকে বোঝা যাবে এটি কি ধরনের ওষুধ) থাকতে হবে।
* ওষুধটির মূল ইনগ্রেডিয়েন্ট বা উপাদান কী তা উল্লেখ করতে হবে।
* ওষুধটির মূল ইনগ্রেডিয়েন্ট একটি থাকাই ভালো। দুইয়ের বেশি মূল উপাদান থাকলে তা ওটিসি হবে না।
* ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি হতে পারে তা প্যাকেটের ভেতর লিফলেটে স্পষ্ট করে লেখা থাকতে হবে।
* ওষুধের সেবনবিধি বা ডোজ উল্লেখ থাকতে হবে। অতিরিক্ত ডোজ হলে কি হতে পারে তাও উল্লেখ থাকতে হবে।
১৯৬২ সালে এফডিএ কর্তৃক এ সব ওষুধের যে অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা হলো_ ওটিসি অবশ্যই কার্যকরী এবং নিরাপদ হবে। এতটা নিরাপদ হতে হবে যে, কেউ ভুলক্রমে বেশি মাত্রায় বা বেশিদিন ধরে অথবা একসঙ্গে কয়েকটা সেবন করলেও তেমন কোনো গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটবে না।
ওটিসি কেন দরকার
* এসব ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া পাওয়া যায় বলে হঠাৎ ছোটখাট সমস্যা হলে যেমন মাথাব্যথা, হাঁচি, জ্বর ইত্যাদিতে অতি দ্রুত ওষুধ কিনে খাওয়া সম্ভব।
* এতে চিকিৎসার খরচ বেঁচে যায় বলে ওই টাকায় পথ্য কিনে খাওয়া সম্ভব।
* দেশের যেসব স্থানে সরকারি হাসপাতাল ছাড়া তেমন কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র নেই ও হাসপাতালে প্রচুর ভিড় সেখানে ছোটখাট সমস্যায় নিজেরাই চিকিৎসা করা যায়।
* এই ওষুধগুলো দোকান ছাড়াও জেনারেল স্টোরে বা সুপারমার্কেটেও পাওয়া যায়।
* এগুলো সাধারণত সস্তা হয়।
এসব ওষুধের সমস্যা
* অনেক সময় রোগী তার অসুখ ভালোমতো না বুঝেই ওষুধ খাওয়া শুরু করে। অনেক সময় দেখা যায় রোগী বুকে জ্বালাপোড়ার (হার্টবার্ন) জন্য ক্রমাগত এন্টাসিড জাতীয় ওষুধ খেয়ে যাচ্ছে অথচ তার বুক ব্যথার কারণ হার্টের কোনো সমস্যা। পরে সে যখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় তখন হয়তো রোগটি জটিল আকার ধারণ করেছে।
* এই ওষুধগুলো অনেক সময় প্রকৃত রোগ সম্পর্কে ধারণা লাভ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। যেমন মাথাব্যথা হলে আমরা প্যারাসিটামল সেবন করি ও সাময়িক আরোগ্য লাভ করি। কিন্তু এ মাথাব্যথা অন্য কোনো জটিল রোগের কারণও হতে পারে।
* পৃথিবীর প্রথম ওটিসি ওষুধ হলো এসপিরিন। এটি তেমন কোনো সমস্যা না করলেও যদি কোনো রোগীর রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা থাকে বা সে যদি অন্য কোনো ওষুধ সেবন বা ওয়ারফেরিন খায় সেক্ষেত্রে শরীরের যেকোনো স্থান থেকে রক্তক্ষরণও হতে পারে।
* ব্যথার ওষুধ (ক্লোফেনাক জাতীয়) পাওয়া যায় যত্রতত্র। কিন্তু ব্যথার ওষুধ খেয়ে পারফোরেশন অফ ডিওডেনাল আলসার অর্থাৎ আলসারে আক্রান্ত স্থানের নাড়ি ফুটো হয়ে গিয়ে মারাত্দক সমস্যা হতে পারে।
* ডেঙ্গু জ্বরে ক্লোফেনাক ওষুধ খেলে শরীরে বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ ঘটতে পারে।
* কফ সিরাপ অনেক সময়ই নেশার দ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
* হিস্টাসিন জাতীয় ওষুধ যদি গর্ভাবস্থায় প্রথম ৩ মাসের মধ্যে সেবন করা হয় সেক্ষেত্রে ঘটতে পারে শিশুর জন্মগত ত্রুটি।
* বেশি পরিমাণে প্যারাসিটামল সেবন লিভারকে মারাত্দক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
ওটিসি ওষুধ বিষয়ে কী করবেন
* মোড়কের লেখা পড়ুন। নিজে পড়তে না পারলে ওষুধ বিক্রেতাকে প্রশ্ন করে নিশ্চিত হোন।
* অসুখ সম্পর্কে নিশ্চিত হোন।
* ওষুধ খাওয়ার পর যদি আপনার আরোগ্য লাভ না হয় তবে সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ বন্ধ করে দিন।
* ওষুধ খাওয়ার পর যদি অস্বস্তি বোধ করেন বা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দেয় তবে নিকটস্থ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
* ওষুধগুলো অবশ্যই শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন।
যা করবেন না
* দুই বা ততোধিক ওষুধ একসঙ্গে খাবেন না।
* যদি আপনি কোনো ডাক্তারের চিকিৎসাধীন থাকেন ও কোনো ওষুধ নিয়মিত প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সেবন করছেন এমন হয় তখন অন্য কোনো ওষুধ নিজে কিনে খাবেন না, আপনার ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া।
* গর্ভাবস্থায় কোনো ওষুধই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া খাবেন না।
* চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া আপনার শিশুকে কোনো ওষুধ খাওয়াবেন না। (খাওয়ার স্যালাইন খাওয়ানো যেতে পারে)।
* আপনার বয়স যদি খুব বেশি- যেমন ৬৫ বছরের ওপরে হয় তাহলে ওষুধের স্বাভাবিক মাত্রা আপনার জন্য প্রযোজ্য নয়, তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খবেন না।
* যদি এসব ওষুধে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় (যেমন অনেক সময় সিরাপ খেলে বুক ধড়ফড় করে) তবে তা সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া বন্ধ করে দিন।
* দীর্ঘদিন একই কারণে একই ওষুধ খওয়া চালিয়ে যাবেন না।
বাংলাদেশে যা হচ্ছে
বাংলাদেশের সরকার প্রেসক্রিপশন ছাড়া ব্যবহৃত ওষুধের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নীতিমালা নির্ধারণ করা সত্ত্বেও এগুলোর কোনো প্রয়োগ নেই। নেশা হয় এরূপ ওষুধ (যেমন_পেথিড্রিন) বাদে প্রায় সব ওষুধই প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি জরিপ অনুযায়ী প্রতিবছর বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া এন্টিবায়োটিকের শতকরা ৫৫ ভাগই প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হয়। কতিপয় ওষুধ কোম্পানির দৌরাত্দ্যে, বিক্রেতাদের লাভের আশায় আর সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার কারণে যথেচ্ছ বিক্রি হওয়া ওষুধ খেয়ে ঘটছে নানাবিধ স্বাস্থ্য বিপর্যয়। কিছুকাল আগে দিনাজপুরে শুধু সিপ্রোফ্লক্সাসিন ওষুধটি সেবন করার কারণে মারা গেছে এক কিশোর।
অতএব, আসুন আমরা ইচ্ছেমতো ওষুধ কিনে না খাই। শুধুমাত্র নিজে কিনে খাওয়া যায় এমন ওষুধ যা ওটিসি নামে পরিচিত সেগুলো প্রয়োজনে খেতে পারেন। এক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে।
mishtihusain@yahoo.com