কোন ওষুধ কিভাবে খাবেন

কখনো চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী আবার কখনো মানুষের পরামর্শে, কখনো নিজেরাই ওষুধ খাই। কিন্তু অনেকেই জানি না কখন কোন সময় কোন ওষুধ সেবন করতে হয়। আমাদের অজ্ঞতার কারণে কোনো কোনো ওষুধ অসময়ে খেয়ে কার্যকারিতা পাওয়া যায় না। আবার কখনো হয় মারাত্দক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। যেসব ওষুধ আমরা প্রায়ই খেয়ে থাকি, সেগুলো খাওয়ার সঠিক নিয়ম বা সেবনবিধি সম্পর্কে লিখেছেন ডা. সাবরিনা শারমিন হোসাইনঅসুখ হলে ওষুধ খেতে হয়। আবার কিছু অসুখ, যেমন হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস ইত্যাদিতে প্রতিদিন নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়। কিন্তু এগুলো ছাড়াও কখনো প্রয়োজনে যেমন জ্বর, মাথাব্যথা, অ্যালার্জি, বমিভাব, গলাব্যথা, বুকজ্বলা ইত্যাদিতে আবার কখনো অপ্রয়োজনে আমরা বিভিন্ন ওষুধ খেয়ে থাকি। আসুন নিয়ম জেনে খাই।

অ্যান্টিবায়োটিক
কেন খাই : শরীরের যেকোনো স্থানে অথবা রক্তে জীবাণুর আক্রমণ ঘটলে তা মেরে ফেলা বা তাকে প্রতিহত করার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে।
কখন খাওয়া উচিত : অ্যান্টিবায়োটিক অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর খেতে হয়। দিনে দুবার, তিনবার, চারবার- এভাবে নয়। অবশ্যই ১২ ঘণ্টা পর পর, ৮ ঘণ্টা পর পর ও ৬ ঘণ্টা পর পর খেতে হয় অর্থাৎ দিনের যেকোনো সময় খেয়ে নিলেই হবে না। অবশ্যই নির্দিষ্ট সময়ে সেবন করতে হবে।
হ অনেকেই ভাবেন অ্যান্টিবায়োটিক ভরাপেটে খেতে হয়। এটি ঠিক নয়। বরং খালিপেটে বা খাওয়ার আগে খেলেই ভালো, কারণ এতে ওষুধের অ্যাবজর্বশন (শরীরে শোষণ) ভালো হয় ও খাবারের সঙ্গে কোনো বিক্রিয়া করে না।
কখন খাবেন না : কোনো কোনো অ্যান্টিবায়োটিকে বমিভাব হয়। তাই ভরাপেটে না খাওয়াই ভালো। অনেক অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে যেগুলো খেলে অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হয়। সবার এ ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। যাদের হয় তাদের সেই বিশেষ অ্যান্টিবায়োটিক বা ওষুধটি এড়িয়ে চলতে হবে। সব অ্যান্টিবায়োটিক কিডনি রোগে (যেমন এমাইনোগ্লাইকোসাইড) ও প্রেগন্যান্সিতে খাওয়া যায় না। তাই এ ধরণের সমস্যা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাবেন।

প্যারাসিটামল
ফার্মাসিউটিক্যালস এসোসিয়েশনের মতে বাংলাদেশে মোট বিক্রীত ওষুধের ৮০ শতাংশই প্যরাসিটামল-জাতীয় ওষুধ।
কেন খাই : জ্বর ও ব্যথানাশক হিসেবে। মাথাব্যথার জন্যও খুব প্রচলিত।
কখন খাওয়া উচিত : পেটে কোনো সমস্যা না থাকলে যেকোনো সময়ই খাওয়া যায়। কারণ প্যারাসিটামল খুবই নগণ্য পরিমাণে গ্যাস্ট্রিক ইরিটেশন (এসিডিটির সমস্যা) করে। এ ওষুধের সঙ্গে গ্যাসের ওষুধ খাওয়া বা ওষুধটি ভরাপেটে খাওয়ার প্রয়োজন নেই।
কখন খাবেন না : প্যারাসিটামল স্বাভাবিক ডোজে (দিনে সর্বোচ্চ চারটা ৫০০ মি.গ্রা. ট্যাবলেট) কোনো সমস্যা করে না, কিন্তু ওভারডোজ হলে লিভার ও কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যাঁদের জন্ডিস রয়েছে অথবা লিভারের কার্যকারিতা ভালো নয় অথবা যাঁদের কিডনি ফাংশন যথাযথ নয় তাঁরা কখনোই চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত খাবেন না।

ক্লোফেনাক-জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ
বাংলাদেশে ওষুধ সেবনজনিত সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীর বেশির ভাগই ক্লোফেনাক-জাতীয় ওষুধের শিকার।
কেন খাই : ব্যথানাশক হিসেবে বহুল ব্যবহৃত।
কখন খাওয়া উচিত : এটি গ্যাস্ট্রিক ইরিটেশন করে এবং ২০ শতাংশ ক্ষেত্রেই বুকে ব্যথা বা জ্বলা, গ্যাস হওয়া ইত্যাদি সমস্যা করে থাকে। যাদের গ্যাস্ট্রিক বা ডিওডেনাল আলসার আছে তাদের ক্ষেত্রে খাদ্যনালি ফুটো হয়ে যাওয়া অর্থাৎ পারফোরেশন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কখনো আলসার থেকে রক্তক্ষরণও হয়ে থাকে। অতএব অবশ্যই ভরাপেটে (খাবার গ্রহণের পর) ও সঙ্গে গ্যাসের ওষুধ যেমন রেনিটিডিন ও ওমিপ্রাজল ইত্যাদি (এই ওষুধগুলো খেতে হবে খাবার গ্রহণ করার ২৫/৩০ মিনিট আগে) খাবেন।
কারা খাবেন না
হ যাদের পেপটিক আলসার রয়েছে ও আলসারজনিত রক্তক্ষরণের ইতিহাস আছে।
হ যাদের ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ, যেমন ক্রনস ডিজিজ, আলসারেটিভ কোলাইটিস ইত্যাদি অসুখ রয়েছে।
হ যারা রক্ত জমাটবদ্ধতা প্রতিহত করার জন্য ওয়ারফেরিন-জাতীয় ওষুধ খান। কারণ এ ক্ষেত্রে উভয়ে মিলিত ক্রিয়ায় (ড্রাগ রিঅ্যাকশন) শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
* যাঁদের ব্লাডপ্রেসার খুব বেশি তাঁরা খাবেন না। কারণ এই ওষুধগুলো শরীরে লবণ ও পানি ধরে রেখে রক্তচাপ আরো বাড়িয়ে দেয়।
* কিডনি ফেইলিওর থাকলে বা কিডনির অসুখ থাকলে।

রেনিটিডিন বা ওমিপ্রাজল-জাতীয় ওষুধ
প্যারাসিটামলের মতোই আরেকটি বেশি ব্যবহৃত ওষুধ হলো রেনিটিডিন ও ওমিপ্রাজল গ্রুপের ওষুধ।
কেন খাই : এসিডিটি, গ্যাসের সমস্যা, বুকজ্বলা, পেটে অস্বস্তি ইত্যাদির জন্য।
কখন খাওয়া উচিত : রেনিটিডিন বা এইচটু ব্লকার ও ওমিপ্রাজল বা প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর-এ দুই ধরনের ওষুধের কাজ হলো পাকস্থলীর এসিডের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করা। আলসার থাকলে এই এসিড আমাদের অন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সাধারণত খাবার খাওয়ার পর এই এসিডের নিঃসরণ বেড়ে যায়। তাই এ-জাতীয় ওষুধ খাওয়ার ২৫ থেকে ৩০ মিনিট আগে সেবন করলে ওষুধ কাজ করা শুরু করে। এর ফলে খাদ্য খাওয়ার পর এসিড নিঃসরণজনিত ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।
কখন খাবেন না : বলা হয়, দীর্ঘদিন অ্যান্টিআলসারেন্ট ওষুধ সেবন করলে একধরনের গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার হতে পারে। আবার কখনো এসিড নিঃসরণ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ঘটতে পারে। তবে এগুলোর কোনোটিই বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ দিয়ে নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণিত নয়। তাই ডাক্তাররা বলেন, যাদের এসিডিটির সমস্যা আছেন তারা এ জাতীয় ওষুধ খেতে পারেন।
অ্যান্টিহিস্টামিন বা হিস্টাসিন-জাতীয় ওষুধ
কেন খাই : যেকোনো অ্যালার্জি যেমন_চুলকানি, হাঁচি, কাশি, নাক দিয়ে পানি পড়া ইত্যাদি কারণে।
কখন খাওয়া উচিত : এ-জাতীয় ওষুধে প্রায়ই সিডেটিভ বা ঘুমঘুমভাব তৈরি করে। তাই রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে খাওয়াই ভালো।
কখন খাবেন না
* ড্রাইভিং করার আগে
* পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময়
* সাঁতার কাটার আগে।
বর্তমানে সিডেটিভ প্রভাবমুক্ত অ্যান্টিহিস্টামিন পাওয়া যায়। সেগুলো খেতে পারেন। এগুলোর মধ্যে আবার কয়েকটি খেতে হয় সকালের দিকে। কারণ এই ওষুধগুলো ঘুমভাব তৈরি না করে বরং ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়। তাই এগুলো রাতে খেতে নেই।

ফ্রুসেমাইড-জাতীয় ওষুধ
কেন খাই : পা ফোলা, কিডনি ও হার্টের সমস্যাজনিত গা ফোলা, হার্ট ফেইলিওর, উচ্চরক্তচাপ কমানোর জন্য এই ওষুধগুলো খাওয়া হয়।
কখন খাওয়া উচিত : এ ওষুধগুলো খেলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়ে থাকে, তাই অবশ্যই সকালে ও দুপুরে খাবেন। রাতে খেলে বারবার ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যেতে হতে পারে বা ঘুমের মধ্যে প্রস্রাব হয়ে যাওয়ার মতো বিব্রতকর ঘটনা ঘটতে পারে।
কখন খাবেন না : ওষুধগুলো শরীরের পটাশিয়ামের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। তাই পটাশিয়াম কম থাকলে এটি খাবেন না। এই ওষুধের সঙ্গে ডাবের পানি, কলা ইত্যাদি পটাশিয়ামযুক্ত খাবার খান। তবে এ নিয়ম কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

স্ট্যাটিন-জাতীয় ওষুধ
কেন খাই : চর্বি বা কোলেস্টেরল কমানোর জন্য খাই। যেমন অ্যাটোভা।
কখন খাওয়া উচিত : বলা হয়ে থাকে, আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন লিভার অধিকাংশ কোলেস্টেরল তৈরি করে। তাই ঘুমাতে যাওয়ার আগে এ ওষুধগুলো সেবন করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।

অ্যান্টিটিউবারকুলার ড্রাগ বা যক্ষ্মার ওষুধ
কেন খাই : যক্ষ্মা হলো সাধারণত ছয় মাস বা নয় মাসব্যাপী কয়েকটি রেজিমেন্টে ওষুধগুলো খেতে হয়।
কখন খাওয়া উচিত : নাশতা খাওয়ার ৪৫ মিনিট আগে খেলে এর অ্যাবজর্বশন বা শোষণ সবচেয়ে ভালো হয়।
কখন খাবেন না : ভরাপেটে খেলে বমি হতে পারে। বমির সঙ্গে ওষুধ বেরিয়ে গেলে পুনরায় ওষুধ সেবন না করলে যক্ষ্মার ওষুধ কাজ করবে না। অনেক ক্ষেত্রে নতুন করে সেবন শুরু করতে হবে।

অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ বা উচ্চরক্তচাপের ওষুধ
কেন খাই : প্রেসার কমানোর জন্য নিয়মিত কয়েকটি গ্রুপের ওষুধ খেতে হয়।
কখন খাওয়া উচিত : চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রাতে বা দিনে। কোনো কোনো ওষুধ অবস্থান পরিবর্তনজনিত হাইপোটেনশন (বা রক্তচাপ কমিয়ে দেওয়া) করে, তাই ওষুধ খাওয়ার পরে হঠাৎ দাঁড়ানো উচিত নয়।

ডায়াবেটিসের ওষুধ
কেন খাই : ব্লাড সুগার কম রাখার জন্য ডায়াবেটিক রোগীদের এ ওষুধ খেতে হয়।
কখন খাওয়া উচিত : খাওয়ার ১৫ মিনিট আগে বা পরে। না হলে এই ওষুধের কারণে হঠাৎ ব্লাড সুগার খুব কমে গেলে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কারণে আকস্মিক মাথা ঘোরা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিপদ ঘটতে পারে।

Exit mobile version