ভেষজ ওষুধের ইতিবৃত্ত

এম.এ রশিদ এবং এম.এ. মজিদ

পৃথিবীতে জীবন-যাপনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রোগ বালাইয়ের কবল থেকে রক্ষা পেতে মানুষ যুগে যুগে উদ্ভিজ, প্রাণীজ ও খনিজ পদার্থ ব্যবহার করে আসছে। বস্ত্তত প্রাচীনকালের সেসব Traditional পদ্ধতি ও প্রাকৃতিক উপাদানের উপর ভিত্তি করেই আধুনিককালের চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধ উৎপাদনের ভীত রচিত হয়েছে। পাশ্চাত্যের আধুনিক এ্যালোপ্যাথিক পদ্ধতির পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী প্রাচ্য পদ্ধতি অর্থাৎ আয়ুর্বেদ, ইউনানী, হোমিওপ্যাথি প্রভৃতি অদ্যাবধি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রাচীন এ সকল পদ্ধতিতে ব্যবহৃত ওষুধ সমূহকে Complementory and Alternative Medicine (CAM) বলা হয়ে থাকে। আধুনিক এ্যালোপ্যাথিক ওষুধের পাশাপাশি রোগ ব্যাধির নিরাময়ের জন্য এ সকল ওষুধ যথেষ্ট অবদান রেখে চলেছে।  

 

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি অন্য যে সমসত্ম পরিপূরক বা বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত আছে এখানে তার কয়েকটি নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন যেমন আকুপ্রেসার, আকুপাংচার, মেডিটেশন, নেচারোপ্যাথি, আয়র্বেদা, ইউনানী, হারবাল, হোমিওপ্যাথি উল্লেখযোগ্য। তবে এ নিবন্ধে এই উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিসত্মান, নেপাল, ইত্যাদি দেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পরিচর্যায় বহুল প্রচলিত ও ব্যবহৃত আয়ুর্বেদিক, ইউনানী এবং হারবাল ওষুধ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

 

আয়ুর্বেদিক ওষুধ:

 

আয়ুর্বেদা একটি সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ Sciecnce of Life। এটি প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি যা প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে ভারত উপমহাদেশে অত্যমত্ম জনপ্রিয় পদ্ধতি হিসাবে পরিচিত। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও আজ আয়ুর্বেদিক ওষুধাবলি এক ধরণের বিকল্প ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আয়ুর্বেদিক ওষুধের মূল উপাদান ভেষজ উদ্ভিদের পাতা, ফুল, ফল, পাতা, শেকড় বা লতা, গুল্ম, ইত্যাদি। তবে কিছু কিছু আয়ুর্বেদিক ওষুধে প্রাণীজ উপাদান যেমন দুধ, মধু, হাড় ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া এ ধরণের বেশ কিছু ওষুধে প্রাণীজ ও লবণ বা ধাতব পদার্থ ব্যবহার করা হয়ে থাকে বলে উল্লেখ আছে। অর্জন, বাসক, হলূদ, নীম, গোল মরিচ, আদা ইত্যাদি আয়ূবেদিক ওষুধ তৈরিতে বহুল ব্যবহৃত গাছপালার মধ্যে অন্যতম। বৈদিক যুগে লিখিত শুশ্রুত সমহিতা ও চরক সমহিতা। তৎকালীন সময়ে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। আয়ুর্বেদিক ওষুধাবলী ‘‘আয়ুর্বেদিক ফার্মাকোপিয়া’’ অনুসরন করে তৈরি করা হয়। বর্তমান যুগে এটি অত্যমত্ম জনপ্রিয়, বহুল প্রচলিত এবং কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। এ পর্যমত্ম অনেক আয়ুর্বেদিক ওষুধের কার্যকারিতা বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে প্রমানিত হয়েছে।

 

ইউনানী ওষুধ:

 

ভারত উপ-মহাদেশে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলির মধ্যে ইউনানী অন্যতম। একে হাকিমি চিকিৎসাও বলা হয়। এ পদ্ধতির উৎপত্তি গ্রিস থেকে। গ্রিক ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতির ধারায় মুসলিম ও অন্যান্য আরবীয়দের অবদান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে এ পদ্ধতিকে গ্রিকো-এ্যারাবিক ওষুধও বলা হয়ে থাকে। এই চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৩ শতাব্দী ধরে মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে। যদিও মেডিসিনের জনক হিসাবে পরিচিত Hippocrates এবং পরবর্তীতে Aristotle, Dioscorides, Galen প্রমুখ ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবনে অবদান রাখেন। কিন্তু এর বিসত্মার লাভে মূসলিম চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্ট ইবনে সিনা, আল রাজী, আল জাওহারী, ইবনে নাফিস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ইবনে সিনা তার ‘‘কানুন অব মেডিসিন’’ গ্রন্থে ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতির মূলনীতি ও জ্ঞান বিসত্মারিত বর্ণনা করেন। ভারত উপমহাদেশে বার শতকের দিকে মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে। দিল্লি সুলতানাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইউনানী চিকিৎসার সূচনা ঘটে এবং পরবর্তীতে মূঘল আমলে এর ব্যপক বিসত্মার হয়। আয়ুবেদিক মেডিসিনের ন্যায় ইউনানী মেডিসিনও প্রধানত: গাছপালা থেকে তৈরি হয়। তবে এখানেও কিছু ওষুধে প্রাণীজ এবং ধাতব পদার্থ ব্যবহৃত হয় । ইউনানী ওষুধাবলি ‘‘ইউনানী ফার্মাকোপিয়া’’ অনুসরণ করে তৈরি করা হয়। এই উপমহাদেশে ইউনানী ওষুধ আজ অত্যমত্ম জনপ্রিয়, বহুল প্রচলিত এবং কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে ইতিমধ্যে অনেক ইউনানী ওষুধের কার্যকারীতা ও নিরাপত্তা প্রমাণিত হয়েছে।

 

ইউনানী ও আয়ূর্বেদিক চিকিৎসার মূলনীতি:

 

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার মূল লক্ষ শরীর, মন ও শক্তির সমন্বয় সাধন এবং এর ফলে রোগ প্রতিরোধ বা আরোগ্য লাভ করা। আয়ুর্বেদিক তত্ত্ব মতে বিশ্ব ব্রম্মা–র মত মানব শরীর পাঁচটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত যথা মাটি, পানি, আগুন, বায়ু ও ইথার। এ উপাদানগুলোর সমন্বয়ে তিনটি ‘দশা’ (Life force) তৈরি যেমনঃ ভাতা দশা, পিত্ত দশা ও কাপহা দশা। মানব শরীরে যদি এ দশার তারতম্য ঘটে তাহলে মানুষ রোগ বালাই এ ভূগে, কারণ দশার তারতম্য ঘটলে প্রাণশক্তির ক্ষয় হয়। এর ফলে মানুষের হজম শক্তি কমে যায় এবং শরীরে নানান ধরণের দুষিত বস্ত্ত জমা হয়। যে কারণে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় রোগীর দশার সমন্বয়ের দিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। রোগীর দশা বিবেচনায় এনে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকগণ বিভিন্ন চিকিৎসা দেন যেমন- শরীরে দুষিত বস্ত্ত নির্গমনের জন্য বমন, মালিশ, নস্যি ইত্যাদি করার উপদেশ দেয়া; উপসর্গ দূর করার জন্য শারিরিক কসরত, যোগব্যায়াম, ইত্যাদি; শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ওষুধ প্রদান ইত্যাদি।

 

অন্যদিকে ইউনানী চিকিৎসা মতে মানব শরীর চারটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত যথা- মাটি, পানি, বায়ু ও আগুন, এবং শারিরিক রস চারটি উপাদানে তৈরি, তা হল, রক্ত (Blood),  শেস্নষ্মা (Phlegm), হলুদ পিত্ত (Yellow bile), এবং কালো পিত্ত (Black bile)। এই সকল শারিরিক রস এর তারতম্য ঘটলে মানুষ রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। এজন্য ইউনানী চিকিৎসকের মূল লক্ষ্য থাকে শরীরের প্রাকৃতিক শক্তিকে সমন্বয় সাধন করা। এ পদ্ধতিতে ধারণা করা হয় যে, মানয শরীরের একটি নিজস্ব শক্তি আছে যার মাধ্যমে উক্ত শারিরিক রসের সমন্বয় আপনা আপনি ঘটতে পারে। তাই এটাকে বলা হয় Medicatrix Natura । ইউনানী ওষুধ শারিরিক শক্তির সমন্বয় সাধনের জন্য প্রয়োগ করা হয়। ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতি অনুযায়ী হাকিমগণ মূলত চার ধরণের চিকিৎসা প্রদান করেন।

 

১। রেজিমেন্টাল থেরাপি যথা- ব্যায়াম, মালিশ, বায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি

 

২। ডায়েট থেরাপি যথা- খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন

 

৩। ফার্মাকোথেরাপি যথা- ভেষজ, প্রাণীজ ও খনিজ ওষুধ প্রয়োগ এবং সর্বশেষ উপায় হিসাবে

 

৪। সার্জারী প্রয়োগ করা হয়।

 

ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক ওষুধের মধ্যে পার্থক্য

 

ইউনানী এবং আয়ুবের্দিক ওষুধের মধ্যে সত্যিকার অর্থে পার্থক্যের চেয়ে মিল বেশি। এই দুধরণের ওষুধই মূলত গাছপালা থেকে তৈরি। বেশিরভাগ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ একটি গাছ থেকে তৈরি না হয়ে অনেকগুলো গাছের সংমিশ্রনের মাধ্যমে তৈরি হয়ে থাকে। তবে আমরা আগেই বলেছি যে, আয়ুবেদিক ওষুধের নাম এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে অন্যদিকে ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতিতে ওষুধের নমকরণ করা হয়েছে আরবী ও পারসী ভাষায়। ইউনানী শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞদের বলা হয় হাকিম আর আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ডিগ্রীধারীদের বল হয় কবিরাজ। যাহোক বর্তমানে বিশ্বে ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক পদ্ধতি একটি সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসাবে বিকাশ লাভ করতে যাচ্ছে।

 

হারবাল মেডিসিন:

 

উন্নত বিশ্বে হারবাল মেডিসিন আজ একটি অত্যমত্ম গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় পরিপূরক বা বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি। হারবাল ওষুধের কাঁচামাল সরাসরি গাছ পালা অর্থাৎ ভেষজ উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত। ভেষজ উদ্ভিদ ছাড়া প্রাণীজ বা খনিজ দ্রব্য এখন ব্যবহৃত হয় না। এক্ষেত্রে সাধারণত একাধিক গাছের মিশ্রন ব্যবহৃত না হয়ে কোন নির্দিষ্ট ভেষজ উদ্ভিদ থেকে একটি উদ্ভিদ তৈরি করা হয়ে থাকে। মূলত কোন গাছের Standarized extract অথবা Partially purified extract দ্বার হারবাল ওষুধ তৈরি হয়। হারবাল ওষুধ কোন না কোন দেশের ‘‘হারবাল ফার্মাকোপিয়া’’ অনুসরণ করে তৈরি হয়। যেমন British Harbal Pharmacopia, Chinease Harbal Pharmacopoeia ইত্যাদি। তাছাড়া এ ধরণের ওষুধের কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে প্রমানিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত।

 

বাংলাদেশে আয়র্বেদিক, ইউনানী ও ভেষজ ওষুধের উৎপাদন:

 

২০০৫ সালে ওষুধনীতি প্রণয়নের সময় হারবাল মেডিসিনকে আইনগত স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে এটি বাংলাদেশে একটি নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এদেশে প্রায় ২৫০টির অধিক ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ কোম্পানিসহ ৮/১০ টি হারবাল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। এখনও আলাদা কোন হারবাল ফার্মাকোপিয়া আমাদের নেই। উন্নত বিশ্বের Reference ব্যবহার করে বাংলাদেশে হারবাল ওষুধ তৈরি করা হচ্ছে এবং ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে জনসাধারণের কাছে এটি গৃহীত হয়েছে।  

 

বিভিন্ন সনাতন পদ্ধতির ওষুধের মূল উপাদান অর্থাৎ গাছ-পালাসমূহের অমত্মর্নিহিত কার্যকরী উপাদানকে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে নিস্কাশিত, পরিশোধিত ও পরিমার্জিত এবং তাদের রাসায়নিক কাঠামোর ভিত্তিতে নতুন নতুন রাসায়নিক দ্রব্য সংশ্লেষণ করে যে ওষুধ তৈরি করা হচ্ছে তাই আধুনিক পদ্ধতির এ্যালোপ্যাথিক ওষুধ। তবে যেটা অত্যমত্ম জরুরি তা হল সনাতন পদ্ধতিতে ব্যবহৃত এ সকল ওষুধকে আরো জনপ্রিয় করা এবং সুযোগ সুবিধা মানুষের দোর গোড়ায় পোঁছে দেয়ার জন্য প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমুন্নত উদ্যোগ গ্রহণ।

 

এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যেটি দরকার তা হল এদেশে যেসকল গাছপালা, লতা, গুল্ম, ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হয় সেটির একটি ডাটাবেজ তৈরি করা। সেইসাথে এ সকল উদ্ভিদ, গুল্ম কিভাবে সংরক্ষণ, চাষাবাদ ও সংগ্রহ করা যায় সে লক্ষ্যে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরি করা। পাশাপাশি বাংলাদেশে এ সকল গাছ পালা, লতা গুল্মের বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে Ethno pharmacological database তৈরি করা। এক্ষেত্রে সরকার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগ, ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহের সমন্বয়ের মাধ্যমে ও WHO এর সার্বিক সহযোগিতায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে।

 লেখকদ্বয়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক

Exit mobile version