সকালের খবর : বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য নীতিমালা রয়েছে। তার আলোকে কি অবস্থার উন্নতি হয়েছে? এ ব্যাপারে আপনার যদি কোনো সুনির্দিষ্ট পরামর্শ থাকে, তবে তা আমাদের বলুন।
ভেলরি টেইলর : দেখুন আমাদের সিআরপিতেও সুষ্ঠু নীতিমালা রয়েছে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণার্থে। কিন্তু কথা হচ্ছে কতটুকু তার বাস্তবায়ন ঘটছে। কল-কারখানায় নিয়োজিত শ্রমিকদের দুর্ঘটনারোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা কতটুকু গ্রহণ করা হয়ে থাকে, সেটা হিসাব করে দেখতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের বিবেচনা করতে হবে যে, দেশের কয়টি কারখানা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে চাকরি দেওয়ার মতো মানসিকতা লালন করে। বিশেষ করে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির কথা আমরা বলতে পারি। মার্ক স্পেন্সারের কথা আমার মনে পড়ছে। ইপিজেডে তিনি অল্পবয়সী প্রতিবন্ধী মেয়েদের সেলাই মেশিনে কাজ করার ব্যাপারে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেটা ছিল খুবই সফল উদ্যোগ। তৈরি পোশাক শিল্পে ওই মেয়েদের আমরা পুনর্বাসন করি। পরে সেসব কারখানার মালিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট ছিল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। তারা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন যে, প্রতিবন্ধী বস্ত্রকর্মীদের অনুপস্থিতির হার অপেক্ষাকৃত কম, তারা যথেষ্ট নিবেদিতপ্রাণ কর্মী, কর্মদক্ষতায় তারা কারও চাইতে কম নয়। সত্যি বলতে কি, শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলে তিনি মনপ্রাণ ঢেলে তার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সেক্ষেত্রে শারীরিকভাবে সুস্থ-সবল এবং প্রতিবন্ধী—উত্পাদন শক্তির হিসাবে দু’শ্রেণীর ভেতর কোনো ব্যবধানই থাকে না। আমাদের সিআরপিতে চিকিত্সা গ্রহণকারী বহু মেয়ে পরবর্তীকালে যুক্ত হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পে। তারা ভালো করছে। ধীরে ধীরে এভাবেই একটা ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে। যদিও দুঃখজনক অভিজ্ঞতাও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও চাকরি পাচ্ছে না-এটাও বাস্তবতা। ইন্টারভিউ বোর্ডে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই চাকরিদাতারা মনস্তাত্ত্বিকভাবে তাদের বাতিল করে দিচ্ছেন।
স. খ. : স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েও একই ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে প্রতিবন্ধী শিশু। তাই না?
ভে. টে. : অবশ্যই। এই বৈষম্য চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে।
স. খ. : বাংলাদেশে এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য পলিসি অ্যাডভোকেসির গুরুত্ব অস্বীকার করার নয়।
ভে. টে. : তা তো বটেই। পলিসি আছে, তার বাস্তবায়ন নেই। এমন পরিস্থিতি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভেতর আশাহীনতার জায়গা তৈরি করে। তাই প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরতে হবে। একইভাবে কর্মস্থলে প্রতিবন্ধীকর্মীদের সাফল্যের বিষয়টিও অন্যান্য শিল্প ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সামনে তুলে ধরতে হবে। স্কুলের শিক্ষকরা জানেন না একজন প্রতিবন্ধী শিশুকে কীভাবে হ্যান্ডেল করবেন। তাই সরকারের পক্ষ থেকে যদি প্রতিটি স্কুলের এক বা একাধিক শিক্ষককে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে তাদের ভেতর আর জড়তা কাজ করবে না। সেই সঙ্গে আমাদের প্রত্যাশা যে, স্কুলের দরজা খুলে দেওয়া হবে প্রতিবন্ধীদের জন্য।
স. খ. : সিআরপির অগ্রযাত্রায় প্রধান প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?
ভে. টে. : ৩১ বছর ধরে আমরা সেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত আছি। যাদের নিয়ে আমাদের কাজ তাদের ভেতর বেশিরভাগ মানুষই মুভমেন্ট ডিসঅর্ডার বা চলত্শক্তিতে সমস্যাক্রান্ত। সড়ক দুর্ঘটনা বা অন্যান্য দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে মেরুরজ্জুতে আঘাত পেয়ে তারা চলত্শক্তি খুইয়েছেন। তা ছাড়া অনেকে স্ট্রোক করার পর হাঁটাচলার সক্ষমতা হারান। উভয় ধরনের রোগীই পরে হুইল চেয়ারের মাধ্যমে চলাফেরায় ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। সিআরপি তৈরি হয়েছে গরিব প্রতিবন্ধীদের কথা চিন্তা করে। একে কমার্শিয়ালি চিন্তা করা হলে এটা কোনো প্রাইভেট ক্লিনিক বা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি হয়ে যাবে। যদি আমাদের এমন ইনটেনশন থাকত যে আমরা সিআরপির মাধ্যমে অনেক টাকা রোজগার করব, তবে ২৮ বছর আগেই একটি কমার্শিয়াল হাসপাতাল করতাম, যেখানে শুধু ধনী লোক ট্রিটমেন্ট পেত। কিন্তু আমরা সবার জন্য করতে চাই। এটা প্রফিট মেকিংয়ের জায়গা হতে পারে না। বিকজ উই আর কমিটেড পিপল-যারা গরিব সহায় সম্বলহীন।
সারা দেশ থেকেই রোগীরা ঢাকা বা সাভারে আসেন চিকিত্সার জন্য। তাই আমাদের সেবার বিকেন্দ্রীকরণ যে কতখানি জরুরি, সেটা আমরা গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারছিলাম। আমাদের সৌভাগ্য যে, এ কে খান ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সম্প্রতি আমাদের একটা চুক্তি হয়েছে। চিকিত্সাধীন এবং পরবর্তী সময়ে রোগীদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার নিরিখে যথাযথ চিকিত্সা ও পুনর্বাসন সেবা দেওয়াই সিআরপির মূল লক্ষ্য। রোগীদের জন্য বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও চিকিত্সাকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে সিআরপি। এ লক্ষ্যে সিআরপি চট্টগ্রামে একটি শাখা স্থাপনের উদ্যোগও নিয়েছে। নগরীর কালুরঘাট এলাকায় এ কে খান ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত আড়াই একর জমি ও ১৪ হাজার বর্গফুটের দালানে এই চিকিত্সাকেন্দ্র স্থাপিত হবে। কিছুকাল আগে চট্টগ্রাম মেয়রের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে। লক্ষণীয় হল, সড়ক দুর্ঘটনাসহ যে কোনো দুর্ঘটনায় স্ট্রোক কিংবা অন্য কোনো কারণে প্যারালাইসিস হলে তাদের চিকিত্সার জন্য সিআরপি চিকিত্সাকেন্দ্রই এখন পর্যন্ত মানুষের প্রধান ভরসাস্থল। এই চিকিত্সা দীর্ঘমেয়াদি বিধায় অনেকের পক্ষে এর ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হয় না। তা ছাড়া কেন্দ্রীয় ঢাকার চাপ কমানোও জরুরি হয়ে উঠেছে। তাই চট্টগ্রামে এর একটি শাখা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে এই চিকিত্সাকেন্দ্র স্থাপিত হলে বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্যারালাইজড রোগীরা কম খরচে উন্নতমানের চিকিত্সাসেবা পাবেন। তবে এই প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে তহবিল গঠনের কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য সিটি মেয়রের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
আরেকটি কথা, ১৯৯৯ সাল থেকে সিআরপিতে ফিজিওথেরাপি এবং অকুপেশনাল থেরাপির ওপর অনার্স ও ডিপ্লোমা কোর্স চালু হয়েছে। সিআরপি পরিচালিত তিন বছরমেয়াদি ফিজিওথেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপি কোর্সগুলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিত্সা অনুষদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করেছে। স. খ. : চট্টগ্রাম ছাড়াও আর কোথায় কোথায় সিআরপির শাখা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে?
ভে. টে. : এখানকার মতো বিরাট আকারে নয়, আগামী পাঁচ বছরে মৌলভীবাজার, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশালে শাখা স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। সেসব জায়গায় প্রধানত ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি দেওয়া হবে। আপনি আমার কাছে চ্যালেঞ্জ আর পরামর্শের কথা জানতে চেয়েছিলেন না? আমি মনে করি, প্রতি জুনে বা গ্রীষ্মকালে আম-কাঁঠালের মৌসুমে গাছ থেকে ফল পাড়তে গিয়ে বহু লোক আহত হন। হাত-পা ভাঙা থেকে শুরু করে কোমর ভেঙে যাওয়া, মেরুরজ্জুতে আঘাত পাওয়া-এসবই ঘটে থাকে। সত্যিকার চ্যালেঞ্জ হল দ্রুত তাদের সুচিকিত্সার আওতায় নিয়ে আসা। অ্যাকসিডেন্ট হলে রোগীকে ঢাকা আসতে হয়। গাড়িতে ওঠানো-নামানোর ফলে স্পাইনাল কর্ড বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ব্যাপারে আমার সুস্পষ্ট সাজেশন হল, দেশব্যাপী সরকারি হাসপাতালগুলোতে অন্তত তিনটি বেডের ব্যবস্থা করা হোক ওদের জন্য। যেটা ৫ বা ৭ বা ১০ বেডে উন্নীত করা যাবে ধীরেসুস্থে। সেখানে অর্থোপেডিক বোর্ড থাকতে হবে।
স. খ. : তিন দশক ধরে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সমাজের কোন দিকটি আপনার কাছে মনে হয় বড় প্রতিবন্ধকতা?
ভে. টে. : প্রথমেই আমি মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির কথাই বলব। সমাজে একটা নেতিবাচক মনোভাব কাজ করে প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে। তাদের ভিন্ন চোখে দেখা হয়। করুণা করা হয়। মনে করা হয়, তারা কোনো কাজেরই নয়। আমি বলব বিপুলসংখ্যক সুস্থ-সবল মানুষের এটাই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধিতা। এই মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। সেক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা বিশাল। পিটারের সঙ্গে তো আপনি কথা বললেন। মাত্র ২৪ বছর বয়সে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে পিটার। পিটারের কথা থেকে সিআরপির রোগীরা সত্যিকারের প্রেরণা পায়। ওরা আমার উপদেশ পুরোপুরি মেনে নিতে পারে না। ভাবে যে, আমি তো দুপায়ে হেঁটে চলি, আমি ওদের কষ্ট শতভাগ কী করে বুঝব? কিন্তু পিটার যখন কথা বলে, ওরা নির্দ্বিধায় শতভাগ মেনে নেয়। পিটার এক আশ্চর্য কাজ করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী মানুষের চিকিত্সা ও পুনর্বাসনে অর্থ সাহায্য করার লক্ষ্যে হুইল চেয়ারেই সড়ক পথে দুটি মহাদেশের ১৪টি দেশ পাড়ি দিয়ে নিজের মাতৃভূমি ইংল্যান্ডে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এর ফলে সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ে জনসচেতনতাও তৈরি হবে। ওর মতো উদ্যোগ গ্রহণেও আমাদের দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ‘অন্ধ’ লোকের চোখ খুলে যেতে পারে। প্রতিবন্ধী মানুষের ব্যাপারে আমাদের আচরণেরও পরিবর্তন প্রয়োজন। আরেকটি কথা। আমি আপনি শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষ। তাই একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভাবতেই পারেন, আমরা ওদের সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাগুলো কতখানি বুঝতে পারব, সেসব থেকে উত্তরণেও বা কতটুকু সহায়তা দিতে পারব। অথচ পিটারের মতো হুইল চেয়ারে আসীন একজন প্রাণবন্ত ব্যক্তি যখন ওদের সামনে যাচ্ছে, ওদের কথা শুনছে এবং নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে শেয়ার করছে, উত্তরণের আশা জাগাচ্ছে-সেটা অনেক বেশি বাস্তব ফলদায়ক হচ্ছে। তাই না কি?
স. খ. : নিশ্চয়ই। পিটার ডোনেলির মতো স্বেচ্ছাসেবক পাওয়া সৌভাগের ব্যাপার। ভালো লেগেছে কাটিয়ার সঙ্গে কথা বলেও। স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপির বিষয়ে শিক্ষাদান ও ভাববিনিময়ের জন্য স্বেচ্ছাসেবী হিসেবেই তিনি সিআরপিতে এসেছেন। আপনি পরিচয় করিয়ে দিলেন মিনু আক্তারের সঙ্গেও। হুইল চেয়ারে বসে থাকা এক প্রাণবন্ত তরুণী। ১০ বছর আগে চিকিত্সার জন্য এসেছিল সিআরপিতে। সেই থেকে এটাই মিনুর ঠিকানা। এখন চাকরি করছে আপনার প্রতিষ্ঠানেই। আমাকে উপহার দিল একটি সিডি-যেখানে কয়েকটি ছোট প্রামাণ্যচিত্র আছে সিআরপিরই। ওর নিজের নির্মাণ। সম্পাদনাও করেছে সে। মিনু বলল, ভাইয়া বিদেশে দেখেছি হুইল চেয়ার নিয়ে সরাসরি বাসে ওঠা যায়। আমাদের এখানে কবে সে ব্যবস্থা হবে? কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুযোগ কীভাবে বাড়ানো যায়?
ভে. টে. : ওই যে মাইন্ড সেটের কথা বললাম। সেটার পরিবর্তন জরুরি সবার আগে। কাগজে চাকরির বিজ্ঞাপনে যদি বলে দেওয়া হয়-প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরও সমান সুযোগ রয়েছে, তবে সামনে এগুবার একটা দরজা খুলে যায়। ধরুন, আপনি একটি অফিসে গেলেন, আপনাকে অভ্যর্থনা জানাল হুইল চেয়ারে বসা কোনো ব্যক্তি। তবে আপনার মনের ওপর সহজেই একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যক্তির স্বাভাবিক আচরণও ওদের ওপর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। দেশে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সিআরপি বিগত ১৯৯৪ সাল থেকে শোভাযাত্রা, পথসভা ও সমাবেশের মাধ্যমে গণসচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সমাবেশে সিআরপির পক্ষ থেকে রাস্তায় চলাচলের নিয়মনীতি সংবলিত ‘নিরাপদ পথ চলা’ শীর্ষক লিফলেট বিতরণ করা হয়।
স. খ. : আপনার অভিজ্ঞতা থেকে কী মনে হয়েছে, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিবন্ধীদের প্রতি কতটা সহমর্মী বা সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করেন?
ভে. টে. : বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তবে দেখব এখানে পারিবারিক বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ়। পরিবারের একজন স্ট্রোক করলে তাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়ার লোকের অভাব পড়ে না। তবে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তোলার কাজটি করতে হবে। সচেতন না হলে সে সত্যিকারের সহযোগী হবে কীভাবে? একটি কথা আমি বিশেষভাবে বলতে চাই। সেটি হল সড়ক দুর্ঘটনারোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া। মানুষকে সচেতন করারও ব্যাপার আছে। তাহলে অনেক দুর্ঘটনারোধ করা সম্ভব। ইংল্যান্ডে আমি দেখেছি একটি পাঁচ বছরের শিশুকে রাস্তা পারাপারের ব্যাপারে কতটা বাস্তবসম্মত শিক্ষা দেওয়া হয়। এই শিক্ষার ফলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। এখানে আমি দেখেছি বহু মানুষ রাস্তার একদিক নিরাপদ কি না দেখেই রাস্তা পার হওয়ার জন্য পা বাড়ান। অন্য পাশ থেকে গাড়ি আসছে কি না সেটা লক্ষ্য করেন না। তা ছাড়া এখানে রং সাইড দিয়ে গাড়ি চলার প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা একটা ভূমিকা নিতে পারে। যে ট্রাক ড্রাইভার বেপরোয়া গতিতে ট্রাক চালাচ্ছে তার রাশ টেনে ধরতে পারে। যে লঞ্চটি অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করছে, তার চালককে গিয়ে বোঝাতে পারে এটা আইনসম্মত নয়। এসব সামাজিক উদ্যোগ অনেক সময়েই ভালো কাজ দেয়।
স. খ. : পরবর্তী প্রসঙ্গে আসা যাক। সেটা হল মানবাধিকার। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন যানবাহন অত্যন্ত সীমিত হলেও প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন রাখা হচ্ছে। যদিও এই মহানগরীর বেশিরভাগ বহুতল ভবনের ক্ষেত্রেই বিল্ডিং কোড মেনে প্রতিবন্ধীদের চলাচলের সুযোগ রাখা হয়নি। ফুটপাতেরও একই অবস্থা। তাহলে প্রতিবন্ধীর মানবাধিকার কীভাবে রক্ষিত হবে?
ভে. টে. : এটা আমারও প্রশ্ন। আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের অবতারণা করলেন। এ বিষয়ে আমরা কথা বলে থাকি সভা-সেমিনারে। কোনো ভবনে, সেটা আবাসিক হোক বা বাণিজ্যিকই হোক, মার্কেটও হতে পারে-যদি ভবনের নীতিমালা না মানা হয়; যদি প্রতিবন্ধীদের চলাচলের জন্য কোনো ব্যবস্থা না রাখা হয় তাহলে তো বলব তার কোনো প্রবেশাধিকারই থাকছে না। এটা তার মনে কতটা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে সে বিষয়ে আমাদের কোনো স্পষ্ট ধারণাই নেই। ফুটপাতের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। আমরা সচেতন না হলে, সভ্য নীতিমালা অনুসরণ না করলে প্রতিবন্ধীদের পৃথিবীকে আমরা সীমাবদ্ধ করেই রাখব, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে আমি অনেক উপজেলায় দেখেছি সেখানে প্রতিবন্ধীদের চলাচলের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
স. খ. : এক সময় সিআরপিতে চিকিত্সা হত বিনামূল্যে। এখন রোগীর কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করা হয়।
ভে. টে. : এখনও বহু মানুষ বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন এখানে। আমরা রবিনহুড মেথড অবলম্বন করছি বাধ্য হয়েই। যারা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল, তাদের কাছ থেকে ফি নেওয়া হচ্ছে। শুধু দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর একটা প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। আমাদের ডোনাররা একপর্যায়ে বলেই ফেলেন, ভেলরি চিরকাল তো এটা চলতে পারে না। আর দিন দিন খরচ তো বাড়ছেই। তাই একপর্যায়ে রোগীদের কাছ থেকে ফি নিতেই হয়েছে। থাইল্যান্ড বা অন্য কোথাও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিত্সার কথা ভাবাই যায় না। রাজধানীর প্রাইভেট ক্লিনিকের দিকে তাকান। তারা কী করছে!
স. খ. : সিআরপির সেবার দুটো দিক আছে। একটি চিকিত্সা, অপরটি পুনর্বাসন। পুনর্বাসনের চিত্র তুলে ধরুন।
ভে. টে. : প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রথমে তাকে চিকিত্সা দিয়ে সুস্থ রাখাই বেশি প্রয়োজন। তারপর ধীরে ধীরে তাকে কর্মক্ষম করে তোলা। সে জন্য মার্ক স্পেন্সারের মতো প্রকল্প চালিয়ে যাওয়া দরকার। এক্ষেত্রে সরকারেরও করণীয় রয়েছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে সিআরপি ও যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর ফলে দেশের ৫৪টি জেলায় যুব উন্নয়ন অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে পশুপালন, মত্স্য চাষ, মুরগি পালন, গাভী পালন ও মোটাতাজাকরণ, নার্সারি ও বাগান ব্যবস্থাপনা, মাশরুম উত্পাদন ও বিপণন এবং আরও কিছু বিষয়ের ওপর ১ মাস থেকে ৬ মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষ। সরকার ভকেশনাল ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থা করছে। যদিও এর খাত কয়েকটি। আমরা কুড়িটি খাতের প্রস্তাবনা দিতে পারি। তবে শুধু সরকার নয়, বেসরকারি পর্যায়েও এ ধরনের প্রকল্প গৃহীত হতে পারে। তবেই ব্যাপক সংখ্যক প্রতিবন্ধী সমাজে পুনর্বাসিত হতে পারবেন। আমরা আশাবাদী।
স. খ. : আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালের স্মৃতি মনে আছে?
ভে. টে. : নিশ্চয়ই। তারও আগের সাইক্লোনের কথাও আমার মনে পড়ে। আমি তখন চন্দ্রঘোনায়। সাইক্লোনের সময় পিঠে নৌকার আঘাতে এক লোকের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। কত মানুষ সে সময় মারা গেছেন। কিন্তু চেনা মানুষের কথা আমরা ভুলতে পারি না। একাত্তরে এক অল্পবয়সী বস্তিবাসীর চিকিত্সা আমি করেছিলাম। পাকিস্তানি আর্মি যখন ওদের বস্তি আক্রমণ করে তখন সবাই পালিয়ে গেলেও চলত্শক্তিহীন ওই ছেলেটি সরে যেতে পারেনি। সে মারা যায়। মনে পড়লে খুব কষ্ট লাগে। ১৯৭২ সালে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হসপিটালে ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে ড. আর জে গাস্টের সঙ্গে কাজ শুরু করেছি। তখন অধিকাংশ রোগীই ছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা।
স. খ. : প্রতিবন্ধী মেয়েদের সঙ্কট ও সংগ্রাম সম্পর্কে বলুন।
ভে. টে. : আপনাকে ধন্যবাদ প্রসঙ্গটি উত্থাপনের জন্য। প্রতিবন্ধী মেয়েদের সমস্যা ও সঙ্কট অনেক বেশি। প্রথমত, মেয়ে হিসেবেই তাদের প্রতিবন্ধিতা আছে সমাজে। দ্বিতীয়ত, পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলে সেই প্রতিবন্ধিত্ব দ্বিগুণ বেড়ে যায়। সংসারজীবনে কোনো অল্পবয়সী নারী দুর্ঘটনা থেকে প্রতিবন্ধী হলে তার স্বামী তাকে ত্যাগ করে। এ রকম বহু নারী আমি দেখেছি। তারা আরও একা হয়ে পড়ে, কারণ সন্তানও তার কাছে থাকে না। বাবা নিয়ে যায়। অথচ যদি একজন প্রতিবন্ধী নারী পুনর্বাসিত হয়, সে কাজ পায় তাহলে তার স্বামী বুঝতে পারবে যে প্রতিবন্ধী হওয়া মানেই জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়। আমি দেখেছি অনেক প্রতিবন্ধী নারী অত্যন্ত দৃঢ়চেতা, পরিবারের প্রতি তারা ভীষণভাবে দায়বদ্ধ। তারা নিজেদের কর্মক্ষম করে তোলার জন্য একনিষ্ঠ থাকেন। নানা ধরনের প্রশিক্ষণ তারা নিয়ে থাকেন এবং নিজেকে স্বাবলম্বী হিসেবে দাঁড় করান। এরা প্রেরণা জোগান অন্যদের। তাদের স্বামীরাও তখন স্ত্রীদের পরিবারের জন্য সম্পদ মনে করেন।
স. খ. : বাস্তবতা হতে পারে যে অনেকেরই দাম্পত্যজীবন, মানে বলতে চাইছি যৌনজীবনে টানাপড়েন চলে আসে। স্বামী প্রতিবন্ধী হলে স্ত্রী কিন্তু তাকে ছেড়ে যায় না।
ভে. টে. : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু আমি দেখেছি পক্ষাঘাতগ্রস্ত নারীকে সন্তানের জন্ম দিতে। তার অর্থ হল দাম্পত্যজীবনে তিনি অক্ষম নন। এটা অনেক পুরুষই অনুধাবন করতে চান না। সহমর্মিতারও অভাব থাকে। একজন ব্রিটিশ গাইনি একবার এক পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রসূতির বেলায় সিজারিয়ানের অনুমতি দেননি, বলেছিলেন স্বাভাবিক উপায়েই মহিলাটি প্রসব করবেন। বাস্তবিকই তাই হয়েছিল।
স. খ. : একটু পেছনে ফিরতে চাইছি, সম্ভবত সিআরপিতে আপনার সবচাইতে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা ছিল সেটা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সিআরপি থেকে আপনাকে সরিয়ে দেওয়ার তত্পরতা হয়েছিল। ওই কালপর্ব থেকে কী অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল যা মূল্যবান মনে করেন?
ভে. টে. : ধন্যবাদ আপনাকে প্রশ্নটি করার জন্য। আসলে এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কিছু চাপা থাকে না। একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান যখন যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে তখন তার বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন সাধন সহজ নয়। উন্নত দেশ থেকে থেরাপিস্টরা এখানে আসছেন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নয়। এই যোগসূত্র আমরা স্থাপন করতে পেরেছি। আমরা ওই ঘটনা থেকে শিক্ষা পেয়েছি আমাদের কীভাবে একেকটা চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। আর সেসব অতিক্রম করার জন্য সহনশীল হতে হবে।