মেডিক্যাল টেস্টসিটি স্ক্যান বা কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি

ডা. সাবরিনা শারমিন

 

ইংল্যান্ডের স্যার গডফ্রে হাউন্সফিল্ড প্রথম ১৯৬৭ সালে সিটি স্ক্যানর উদ্ভাবন করেন। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে ১৯৭০ সাল থেকে বিভিন্ন ধরনের রোগ নির্ণয়ের জন্য বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সিটি স্ক্যান। বাংলাদেশে মাত্র সাত থেকে ১০ বছর ধরে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। এর কারণ সম্ভবত খরচ, প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব, পরীক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে মানুষের অজানা ভীতি এবং দেশের সর্বত্র এই পরীক্ষাটির সুব্যবস্থা না থাকা। ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্ভুল রিপোর্ট দেওয়া এই পরীক্ষাটি যে মোটেই কষ্টদায়ক ও ভীতিকর নয়, তা অনেকেই জানেন না।

সিটি স্ক্যান কী
সিটি স্ক্যান হলো, কম্পিউটেড টোমোগ্রাফির সাহায্যে স্ক্যান। গ্রিক টোমোস মানে, টুকরা বা ংষরপব ও মৎধঢ়যরপ অর্থ হলো লেন্স বা দেখা। এই পদ্ধতিতে শরীরের বিভিন্ন প্রস্থচ্ছেদে বহুসংখ্যক ছবি নেওয়া হয়, ফলে শরীরের অন্তভাগের যেকোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একটি ত্রিমাত্রিক ধারণা পাওয়া যায়। এ ছবিগুলো অত্যন্ত উন্নতমানের কম্পিউটারে সনি্নবেশিত করে একটি সমন্বিত ও সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, যা প্রায় নির্ভুলভাবে শরীরের যেকোনো স্থানের ক্যান্সার, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের যেকোনো রোগ বা দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো কারণে হাড়, রক্তনালি ও মাংসপেশির সমস্যা নির্ণয় করতে পারে। কোনো কোনো সময় আরো নিখুঁতভাবে ছবি পাওয়ার জন্য কনট্রাস্ট সিটি স্ক্যান করা যায়, সেখানে ডাই বা রং ব্যবহার করা হয়।

সিটি স্ক্যান কেন করতে হয়
সিটি স্ক্যানও একপ্রকার এঙ্-রে। তবে এটি করার সুবিধা অনেক বেশি। প্রচলিত এঙ্-রেতে সামান্য রেডিয়েশন শরীরের যেকোনো এক দিক থেকে প্রবেশ করিয়ে একটি ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর ছবি নেওয়া হয়। এতে যেকোনো এক পাশ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু সিটি স্ক্যানে অসংখ্য এঙ্-রে রশ্মি শরীরে প্রবেশ করানো হয় এবং ইলেকট্রনিক ডিটেক্টর দিয়ে রেডিয়েশনের পরিমাপ করা হয়। এই পদ্ধতিতে খুব অল্পসময় লাগে। যেমন আধুনিক সিটি স্ক্যান পদ্ধতিতে ১ মিনিটের মধ্যেও সব ছবি নেওয়া সম্ভব।

কী অসুখে সিটি স্ক্যান করতে হয়
> ক্যান্সার নির্ণয়ে সিটি স্ক্যান বহুল প্রচলিত। লিভার, ফুসফুস, অগ্ন্যাশয়, খাদ্যনালি বা অন্ত্রের যেকোনো ধরনের টিউমারের প্রকৃত অবস্থান, তার আকার, আকৃতি ও বিস্তার নির্ভুলভাবে জানা যায় এর মাধ্যমে।
> স্ট্রোক, মস্তিষ্কে রক্তরক্ষণ ইত্যাদির জন্য মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান অপরিহার্য।
> শরীরের কোনো স্থানের হাড় যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা যেকোনো হাড়ে যদি জন্মগত বা অসুস্থতাজনিত ত্রুটি থাকে, তবে সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে তা বের করা যায়। অর্থাৎ হাড়ের সমস্যা নির্ণয়ে সিটি স্ক্যান, এমআরআইর তুলনায় অনেকাংশে উপকারী।
> সিটি স্ক্যানের গাইডে (ঈঞ মঁরফবফ) শরীরের যেকোনো স্থান থেকে বায়োপসি নেওয়া যায়, অ্যাবসেস বা শরীরের কোনো স্থানে পুঁজ জমে ইনফেকশন হলে বের করে ফেলা যায়।
> সিটি স্ক্যান দ্বারা অনেক সময় কাটাছেঁড়া ছাড়াই টিউমারের চিকিৎসা করা হয়।
> সিটি অ্যানজিওগ্রামের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির ব্লক ও অবস্থা জানা যায়।
> দ্রুত রোগ নির্ণয় সম্ভব বলে কিছু বিশেষ ইমার্জেন্সি অবস্থায় যেখানে রোগীর রোগ নির্ণয়ের ওপর ও প্রয়োজনীয় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার ওপর তার জীবন-মরণ নির্ভর করছে_এরূপ সময়ে সিটি স্ক্যানের বিকল্প নেই। যেমন চঁষসড়হধৎু বসনড়ষরংস বা ফুসফুসের রক্তনালি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া বা রাপচার অ্যাওর্টিক অ্যানিওরিজম বা মানবদেহের প্রধান রক্তসংবহনকারী ধমনি হঠাৎ ছিঁড়ে যাওয়া। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত রোগ নির্ণয় করে ইমার্জেন্সি সার্জারির মাধ্যমে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব।
> শিশুদের কিছু বিশেষ অসুখে সিটি স্ক্যান জরুরি। যেমন_লিম্ফোমা, নিউরোলাস্টোমা, রক্তনালি বা কিডনির জন্মগত ত্রুটি ইত্যাদি।
* যাদের শরীরে ইমপ্ল্যান্ট বসানো আছে বা হার্ট ভাল্ব লাগানো আছে, তারা এমআরআই করতে পারবেন না_তাই অবশ্যই সিটি স্ক্যান করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে।

প্রস্তুতি
এটি রুটিন পরীক্ষা নয়, অর্থাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই করানো যাবে না।
> আপনার কোনো পূর্ব অসুস্থতা থাকলে চিকিৎসককে জানান। যেমন_অ্যালার্জি (সিটি স্ক্যানে ব্যবহৃত রং বা ডাইয়ের জন্য অসুবিধা করতে পারে), অ্যাজমা বা অতিরিক্ত কাশি (ছবি নেওয়ার সময় আপনি অতিরিক্ত নড়াচড়া করলে এটি নষ্ট হয়ে যায়) ইত্যাদি থাকলে চিকিৎসক আগে সমস্যাগুলোর চিকিৎসা করে নিতে পারেন।
> গর্ভাবস্থায় সিটি স্ক্যান করানো যায় না, তাই আপনি গর্ভবতী হলে চিকিৎসককে জানান। যদি নিশ্চিত না হোন; কিন্তু গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে, সে ক্ষেত্রে আগে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হোন আপনি গর্ভবতী কি না।
> পরীক্ষা করতে যাওয়ার সময় আরামদায়ক ঢিলেঢালা কাপড় পরে যান।
> গয়না, চুলের কাঁটা, চাবি, চশমা ও হেয়ারিং এইড খুলে পরীক্ষা করতে ঢুকবেন। এগুলো সিটি স্ক্যানের ছবিকে বাধাগ্রস্ত করে।
> কোনো কোনো সময় সুস্পষ্ট ছবি পাওয়ার জন্য ঈড়হঃৎংঃ সধঃবৎরধষ খাওয়ানো হয় বা শিরাতে ডাই দেওয়া হয়, তাই এই পরীক্ষার আগে তিন-চার ঘণ্টা খালি পেটে থাকাই ভালো। না হলে বমি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

পদ্ধতি
এটি সম্পূর্ণ ব্যথামুক্ত পদ্ধতি। ঈঞ ঝপধহ-এর টেবিলে আপনাকে শোয়ানো হবে, প্রয়োজনে মাথার নিচে বালিশ দেওয়া হবে। ঈড়হঃৎরংঃ ঈঞ করতে হলে আপনাকে ডাই খাওয়ানো হবে বা শিরায় দেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে একটি ছোট্ট আলপিনের খোঁচার ব্যথা পেতে পারেন। সিটি স্ক্যান চলাকালীন নড়াচড়া করা নিষেধ। নড়লে প্লেট বাতিল হয়ে যাবে এবং আবার ছবি নিতে হবে। তাই যাদের খুব বেশি নড়াচড়া করার সম্ভাবনা আছে তাদের ক্ষেত্রে এবং বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ঘুমের ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর পরই আপনি বাসায় যেতে পারবেন ও স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারবেন।

কখন সিটি স্ক্যান করবেন না
> সিটি স্ক্যানে প্রচুর কিলোভোল্টের রেডিয়েশন শরীরে প্রবেশ করানো হয় বলে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটি ভালো নয়।
> গর্ভাবস্থায় কখনো নয়, এতে বাচ্চাদের ক্ষতি হবে।
সিটি স্ক্যানের ক্ষতিকারক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। তবে সিটি স্ক্যান করতে অপেক্ষাকৃত বেশি টাকা খরচ হয়।
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব মেডিক্যাল কলেজে বাইরের চেয়ে প্রায় অর্ধেক খরচে সিটি স্ক্যান করা হয়। সরকারি পর্যায়ের বাইরেও বহু ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষাটি করার ব্যবস্থা আছে।
রেসিডেন্ট
কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ, বিএসএমএমইউ, ঢাকা

Exit mobile version