শীতে বাড়ে বাতের ব্যথা

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে এখন মূলত গরম ও শীত_এই দুই ঋতুর প্রাধান্যই বেশি। গরমকালে বাতের ব্যথা থাকলেও শীতেই ব্যথা-বেদনা বেশি হয়। ডা. মো. সফিউল্যাহ্ প্রধান

 

শীত পড়তে শুরু করেছে এবং এর তীব্রতাও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে। আর শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতের ব্যথার কষ্টও বাড়তে থাকবে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শারীরিক ও মানসিক শক্তি, দেহকোষের কর্মক্ষমতা বা সামর্থ্য ধীরে ধীরে কমতে থাকে। টিস্যুর এই সামর্থ্য ক্রমাবনতির হার বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনুপাতে হয়। একজন ৮০ বছরের বৃদ্ধ যেমন কর্মক্ষম থাকতে পারেন, তেমনি আবার ৫০ বা ৬০ বছর বয়সের ব্যক্তিরা ভুগতে পারেন বিভিন্ন ধরনের বার্ধক্যজনিত সমস্যা ও জয়েন্ট বা মাংসপেশির ব্যথায়; যাকে আমরা সহজ ভাষায় বাত বলে জানি। সাধারণত মহিলাদের ৪০ বছর পর, পুরুষরা ৫০ বছর পর বয়সজনিত জয়েন্টের সমস্যায় ভুগে থাকেন। আমাদের দেশের পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ ব্যথাজনিত সমস্যায় ভোগেন। বিশেষ করে যেসব জয়েন্ট শরীরের ওজন বহন করে এবং অতিরিক্ত ব্যবহৃত হয় যেমন_ঘাড়, কোমর, স্কন্ধ বা সোল্ডার জয়েন্ট এবং হাঁটু ব্যথার রোগী সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। বাতের ব্যথার অনেক কারণ রয়েছে, তার মধ্যে ৯০ শতাংশ হচ্ছে ‘মেকানিক্যাল সমস্যা’।
মেকানিক্যাল সমস্যা বলতে মেরুদণ্ডের মাংসপেশি, লিগামেন্ট মচকানো বা আংশিক ছিঁড়ে যাওয়া, দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী ডিঙ্ সমস্যা, কশেরুকার অবস্থানের পরিবর্তনকে বোঝায়। অন্যান্য কারণের মধ্যে বয়সজনিত হাড় ও জোড়ার ক্ষয় বা বৃদ্ধি, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা গেঁটে বাত, অস্টিওআর্থ্রাইটিস, অস্টিওপোরেসিস, এনকাইলজিং স্পন্ডাইলোসিস, বার্সাইটিস, টেন্ডিনাইটিস, স্নায়বিক রোগ, টিউমার, ক্যান্সার, মাংসপেশির রোগ, শরীরে ইউরিক এসিড বেড়ে গেলে, অপুষ্টিজনিত সমস্যা, শরীরের অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদি। শীতে এসব সমস্যায় ব্যথা আরো বেড়ে যায় এবং রোগী অসুস্থ ও কর্মহীন হয়ে পড়ে।
তাই শীতে বাতের ব্যথা নিয়ে কষ্ট না পেয়ে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা নিতে হবে এবং প্রতিরোধ-ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাঁরা বাতের ব্যথায় ভুগছেন, তাঁরা একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের চিকিৎসা ও পরামর্শে ভালো থাকতে পারেন। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন অত্যন্ত আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি। চিকিৎসক আপনার রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা ও পরামর্শ দিলে আপনি অবশ্যই বাতের কষ্ট থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন, পাশাপাশি থাকবেন কর্মক্ষম। ফিজিওথেরাপিতে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রোমেডিক্যাল যন্ত্রপাতি যেমন_শর্টওয়েভ ডায়ার্থামমি, আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপি, ইন্টারফেরেনশিয়াল থেরাপি, ইনফারেড রেডিয়েশন, ট্রান্স কিউটেনিয়াস ইলেকট্রিক নার্ভ ইস্টিমুলেটর, ইলেকট্রিক নার্ভ ও মাসেল ইস্টিমুলেটর, ওয়াঙ্বাথ থেরাপি, অটো ও মেন্যুয়াল ট্রাকশন, হাইড্রোথেরাপি, লেজার থেরাপি এবং চিকিৎসক বিভিন্ন কৌশলগত ব্যায়াম করিয়ে থাকেন।
নিচের পরামর্শ মেনে চললেও বাতের ব্যথা কমে
> ব্যথা বেশি হলে সাত দিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম নেবেন।
> নিয়মিত ফিজিওথেরাপি নেবেন।
> ব্যথার জায়গায় গরম বা ঠাণ্ডা সেঁক দেবেন ১০ থেকে ১৫ মিনিট।
> বিছানায় শোয়া ও ওঠার সময় যেকোনো একদিকে কাত হয়ে হাতের ওপর ভর দিয়ে শোবেন ও উঠবেন।
> মেরুদণ্ড ও ঘাড় নিচু করে কোনো কাজ করবেন না।
> নিচু জিনিস যেমন_পিঁড়ি, মোড়া বা ফ্লোরে না বসে চেয়ারে পিঠ সাপোর্ট দিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে বসবেন।
> ফোম ও জাজিমে না শুয়ে উঁচু শক্ত সমান বিছানায় শোবেন।
> মাথায় বা হাতে ভারী বোঝা বহন নিষেধ।
> দাঁড়িয়ে বা চেয়ারে বসে রান্না করবেন।
> চিকিৎসকের দেখানো ব্যায়াম নিয়মিত করবেন, ব্যথা বেড়ে গেলে ব্যায়াম বন্ধ রাখবেন।
> শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখবেন, পেট ভরে খাওয়া নিষেধ, অল্প অল্প করে বারবার খাবেন।
> সিঁড়িতে ওঠার সময় ধীরে ধীরে হাতল ধরে উঠবেন।
> চেয়ারে বসে গোসল করবেন।
> কোনো ধরনের মালিশ করবেন না।
> দীর্ঘক্ষণ এক জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে থাকবেন না, কিছু সময় পর পর অবস্থান বদলাবেন।
> শোয়ার সময় একটি পাতলা নরম বালিশ ব্যবহার করবেন।
> বাইরে চলাফেরা করার সময় কোমরের বেল্ট ব্যবহার করুন, শোওয়ার ও ব্যায়াম করার সময় অবশ্যই বেল্ট খুলে রাখুন।
> হাই হিলযুক্ত জুতা ব্যবহার করবেন না, নরম জুতা ব্যবহার করবেন।
> ব্যথা তীব্র হলে উঁচু কমোডে বসে টয়লেট করবেন।
> চলাফেরায় ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন ও রাস্তা এড়িয়ে চলবেন এবং সামনের বা মাঝামাঝি আসনে বসবেন। ব্যথা কমে গেলে নিয়মিত সমতল জায়গায় কমপক্ষে এক ঘণ্টা হাঁটুন।

সহকারী অধ্যাপক, আইআইএইচএস, ঢাকা ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা।
shafiullahphysio@yahoo.com

Exit mobile version