শীতে বেশ কিছু অসুখ বেশি হয়, তাই প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা। ছবি : কাকলী প্রধান
শীতের মিঠেকড়া রোদ অনেককেই টানে। কুয়াশা গায়ে মাখতেও ভালোবাসেন কেউ কেউ। তবে সুযোগ-সন্ধানী রোগগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক
ডা. জাকির হোসেন ও রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
ডা. এফ এম সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন
ডা. সাকলায়েন রাসেল
শুষ্ক ত্বক
দেহের সবচেয়ে সংবেদনশীল অঙ্গ ত্বক। শীতের প্রথম প্রকোপ তাই ত্বকে প্রকাশ পায়। এ সময় ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। তাপমাত্রা কমে যায়। শুষ্ক ত্বকে নানা সমস্যা হতে পারে। ত্বক চুলকাতে পারে, ফেটে যেতে পারে। নানা চর্মরোগের আবির্ভাব হতে পারে। এ সময় অ্যালার্জির প্রকোপও বাড়ে। ত্বকের আর্দ্রতা রক্ষা করা তাই এ সময় জরুরি। এজন্য আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী যেকোনো লোশন বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করতে পারেন। ব্যবহার করতে পারেন গি্লসারিনও। তবে গি্লসারিনের আঠালো ভাব কমানোর জন্য কিছুটা পানি মেশানো যেতে পারে। গোসলের ঠিক পর পরই এসব লোশন লাগানো ভালো।
হাত-পা ফেটে যাওয়া
শীতকালের সবচেয়ে পরিচিত বিড়ম্বনা হলো হাত-পা ফেটে যাওয়া। অনেকের শীতকাল আসার আগেই হাত-পা ফাটতে পারে। এ সমস্যা প্রতিরোধে আপনাকে বেশি বেশি পানি খেতে হবে। শীতকাল আসার কমপক্ষে এক মাস আগে হাত ও পায়ে গি্লসারিন লাগানোর অভ্যাস করতে পারলে ভালো হয়। সম্ভব হলে হাত ও পায়ে বেশির ভাগ সময় মোজা পরিধান করতে হবে। বিশেষ করে রাতে হাত-পা আর্দ্র রাখা খুব জরুরি।
অ্যাজমা বা হাঁপানি
শীতকাল অ্যাজমা রোগীদের জন্য বেশ আতঙ্কের। বেশির ভাগ অ্যাজমার রোগী এ সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় এ সময় বাতাসে অ্যালার্জেন বা অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী পদার্থের আধিক্য দেখা যায়, যার সংস্পর্শে এলে অ্যাজমা রোগীরা দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ সময় তাই যতটুকু সম্ভব ধুলাবালি এড়িয়ে চলতে হবে। তবে রাস্তার ধুলাবালির চেয়ে ঘরের ধুলা বেশি ক্ষতিকর। কারণ এগুলোয় মাইট থাকে, যা অ্যাজমার প্রকোপ বাড়ায়। শীতকাল এলেই যাদের অ্যাজমা বেড়ে যায়, তাঁরা এ সময় অনেক বেশি সতর্ক থাকবেন। স্টেরয়েড-জাতীয় ইনহেলার শীতকালজুড়ে ব্যবহার করবেন। একেক ব্যক্তির একেক খাবারে অ্যাজমা হয়। যে খাবারে আপনার অ্যাজমা বাড়ে, তা যত প্রিয় হোক দূরে রাখবেন। প্রয়োজনে শীতকাল আসার আগেই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। অ্যাজমা প্রতিরোধে তাঁর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিয়ে রাখুন।
খুশকি
খুশকি খুব কমন একটি স্বাস্থ্য সমস্যা । বিশেষ করে শীতকালে এ সমস্যাটি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। খুশকি আসলে কী? চামড়ার বাইরের একটি আস্তরণ আমাদের অজান্তে সব সময় ঝরে পড়ে। আমরা তা দেখতে পাই না। কিন্তু মাথার চামড়া কিছুটা মোটা হওয়ায় ঝরে পড়া চামড়ার কিছু অংশে চুলের গোড়া আটকে যায়। একেই আমরা খুশকি বলি। শীতকালে ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়ায় তাই খুশকি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এ সমস্যা প্রতিরোধে প্রতিদিন গোসল করতে হবে। মাথায় শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে। রাতে মাথায় ভালোভাবে তেল মেখে নিয়ে সকালে গোসল করতে হবে। তবে ঠাণ্ডার ভয়ে যাঁরা এ সময় গোসল কমিয়ে দেন_বাড়তি খুশকির জ্বালা তাঁদের সহ্য করতেই হবে।
সাইনুসাইটিস
আমাদের নাসারন্ধ্রের দুই পাশে ছোট ছোট বায়ুকুঠুরি বা সাইনাস থাকে। যার কারণে আমরা সুরেলা কণ্ঠে কথা বলতে পারি। এই সাইনাসে কোনো কারণে প্রদাহ হলে তাকে সাইনুসাইটিস বলে। তখন ঘনঘন হাঁচি হয়, সব সময় সর্দি লেগে থাকে। সুরেলা কণ্ঠে তখন নাকি সুরে বেজে ওঠে। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত গরম পানির ভাপ নেওয়া যেতে পারে। পানিতে একটু মেনথোল মিশিয়ে দিলে আরো ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রয়োজনে নাকের ড্রপ বা স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে কোনো অবস্থায়ই এসব ওষুধ দীর্ঘদিন ব্যবহার করা ঠিক নয়। প্রয়োজনে একজন নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
ব্রঙ্কাইটিস এবং নিউমোনিয়া
ব্রঙ্কাইটিস কিংবা নিউমোনিয়া-জাতীয় শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ এ সময় বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে শিশু কিংবা বৃদ্ধরা এ সময় শ্বাসতন্ত্রের নানা অসুখে বেশি আক্রান্ত হয়। এ ধরনের সমস্যা প্রতিরোধে ঠাণ্ডা থেকে দূরে থাকুন। নিজে চিকিৎসা না করে দ্রুত একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
হার্ট অ্যাটাক
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, শীতকালের সঙ্গে হার্ট অ্যাটাকের কী সম্পর্ক? কোনো কারণে হার্টের রক্তনালি সরু হয়ে গেলে রক্ত চলাচল কমে যায়। ফলে অঙ্েিজন স্বল্পতা হওয়ায় আমরা বুকে তীব্র ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট অনুভব করি, যার অপর নাম হার্ট অ্যাটাক। শীতকালে সারা শরীরের রক্তনালি কিছুটা হলেও সংকুচিত থাকে। ফলে অল্প টেনশন বা পরিশ্রমে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়তে পারে। যদিও এখনো পর্যন্ত শীতে হার্টের অসুখ, স্ট্রোক, রক্তচাপ ইত্যাদির পেছনের সঠিক কারণ জানা যায়নি।
বিষণ্নতা
শীতকালের সঙ্গে বিষণ্নতার বিশেষ একটি সম্পর্ক আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, বিষণ্নতার সঙ্গে আলোর সম্পর্ক নিবিড়। শীতকালে দিনের স্থায়িত্ব অনেক কম হওয়ায় মানুষ আলোর সংস্পর্শে আসার সুযোগ তুলনামূলক কম পায়। এ সময় অনেকের কর্মস্পৃহা কমে যায়। সারা দিন ঘুমঘুম ভাব থাকে। কাজকর্মে মনোযোগ কমে যায়। কিছুটা হতাশা কাজ করে। এ সবই বিষণ্নতার লক্ষণ। বিজ্ঞানীরা এ ধরনের রোগীকে বেশির ভাগ সময় তাই আলোয় কাটানোর পরামর্শ দেন। প্রয়োজনে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
ভালো থাকার কয়েকটি উপায়
> অনেকে মনে করেন সারা দিন গায়ে কাপড় থাকায় এ সময় ধুলোবালি কম লাগে। তাই দুই-এক দিন পরপর গোসলে কোনো সমস্যা নেই। শীতকালে প্রতিদিন গোসল করা সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই জরুরি।
> এ সময় গায়ে দুর্গন্ধ হতে পারে। তাই পরিধেয় কাপড় ছয় ঘণ্টার বেশি না পরলে এ সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে।
> যাঁরা নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাঁরা সম্ভব হলে এ সময় সকালের পরিবর্তে বিকেলে ব্যায়াম করবেন। শীতের ভয়ে ব্যায়াম বন্ধ রাখবেন না।
> পায়ের মোজা ছয় ঘণ্টার বেশি পরবেন না। পায়ে গন্ধ হলে হালকা কুসুম গরম পানিতে কয়েকটি পটাশের দানা মিশিয়ে পা ডুবিয়ে রাখুন। প্রয়োজনে বদ্ধ জুতা পরিহার করে সহজে খোলা ও পরা যায়_এমন জুতা ব্যবহার করুন।
> একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকার অভ্যাস পরিহার করুন।
> শীতের বাজার টাটকা সবজিতে সয়লাব থাকে। তাই এ সময় বেশি বেশি সবজি খান
saklayendmc@gmail.com