কোরবানির ঈদ : কোলেস্টেরল হতে সাবধান

মাংস-পোলাও এবং চর্বি-ঘিয়ের ব্যাপক আয়োজন হয় কোরবানি ঈদের ডাইনিং টেবিলে। খাওয়ার পর এ চর্বি বাসা বাঁধে মানুষের রক্তে, বেড়ে যায় রক্তের কোলেস্টেরল মাত্রা। কোলেস্টেরল মাত্রা বেশি থাকা মানেই রক্তে শত্রুর সঙ্গে বসবাস। রক্তের বাড়তি কোলেস্টেরল বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশিকে নির্জীব মৃতাবস্থায় নেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে।

মাংসের সঙ্গে কোলেস্টেরলের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কোরবানি ঈদে মাংস একটু বেশিই খাওয়া হয়। মাংস-পোলাও এবং চর্বি-ঘিয়ের ব্যাপক উপস্থিতি থাকে ঈদের খাবারগুলোতে। খাওয়ার পর এ চর্বি বাসা বাঁধে মানুষের রক্তে, বেড়ে যায় রক্তের কোলেস্টেরল মাত্রা। কোলেস্টেরল মাত্রা বেশি থাকা মানেই রক্তে শত্রুর সঙ্গে বসবাস। রক্তের বাড়তি কোলেস্টেরল বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশিকে নির্জীব মৃতাবস্থায় নেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। আর এ কারণেই কোরবানির ভোজনে কোলেস্টেরলের কথা মনে রাখতে হবে। বিশেষ করে যাদের রক্তে কোলেস্টেরল মাত্রা বেশি কিংবা বিপদ সীমার কাছাকাছি রয়েছে। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের কাছে কোলেস্টেরল একটি ভীতিকর উপাদান। বয়স চলি্লশের কোঠায় পেঁৗছনোর পর রক্তের কোলেস্টেরল মাত্রা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। কারণ কোলেস্টেরল নীরবে আপনার মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। মানুষের শরীরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী দু’টি অঙ্গের অসুস্থতার জন্যই কোলেস্টেরলকে দায়ী করা যায়। হৃৎপিণ্ডের হার্ট অ্যাটাক এবং মস্তিষ্কের স্ট্রোক এ দু’য়ের জন্য কোলেস্টেরলকে দোষারোপ করা হয়ে থাকে।

রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ে অনেকের মধ্যেই বিভ্রান্তি রয়েছে। কেউ কেউ রক্তে টোটাল কোলেস্টেরল মাত্রা ২০০ মি.গ্রাম/ডিএল থাকলেই সেটাকে নিরাপদ বলে মনে করেন। আসলে ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। টোটাল কোলেস্টেরল মাত্রা ১৫০ মি.গ্রাম/ ডিএল বা তার নিচে হলে তাকে নিরাপদ মাত্রা বলা যায়। সাধারণত নিরাপদ মাত্রার কোরেস্টেরল থাকাবস্থায় হার্ট অ্যাটাক দেখা যায় না। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোলেস্টেরলের মাত্রা ১৫০-২০০ থাকাবস্থায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কোলেস্টেরল মাত্রা ৩০০ এর চেয়ে দ্বিগুণ বেশি হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ১৬ বছর মেয়াদি আমেরিকার এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের কোলেস্টেরল মাত্রা ১৫০-২০০-এর মধ্যে তাদের প্রায় শতকরা ৩৫ ভাগ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তাই কোলেস্টেরল নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে এ সম্পর্কে সচেতন হওয়াটাই আসল কাজ। সেই সঙ্গে কোলেস্টেরল মাত্রা কমানোর ব্যবস্থাও নিতে হবে।

ধরুন আপনি সুস্থ আছেন কিন্তু কোলেস্টেরল মাত্রা ১৯৮ অথবা ১৮৯। কোলেস্টেরলের এই মাত্রা নিয়ে বিমর্ষ হওয়ার কিছু নেই। দেখে নিন আপনার এইচডিএল (হাইডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন) বা ভালো কোলেস্টেরল মাত্রা। তারপর হিসাব করে নিন টোটাল কোলেস্টেরল এবং এইচডিএলএর মাত্রা । যদি এই অনুপাত ৪-এর নিচে থাকে তবে আপনি রিলাক্স মুডে থাকতে পারেন। তখন সত্যিকার অর্থেই আপাতত হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থেকে আপনি মুক্ত বলে ধরে নিতে পারেন। কাজেই টোটাল কোলেস্টেরল মাত্রা ২০০-এর বেশি হলেই যে তা ঝুঁকিপূর্ণ হবে এক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়। কারণ উচ্চমাত্রার এইচডিএল (ভালো জাতের কোলেস্টেরল) হার্ট অ্যাটাকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। কিন্তু কোলেস্টেরল মাত্রা ৩০০-এর বেশি থাকাটা আসলেই খুব বেশি বলে ধরে নিতে হবে।

ঈদে কিছু কৌশল মেনে চলা যেতে পারে। যেমন_ মাংসের দৃশ্যমান চর্বি মাংস কাটার সময়েই কেটে কেটে বাদ দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া রান্নার আগে মাংসকে আগুনে ঝলসে নিলেও খানিকটা চর্বি গলে পড়ে যায় । আবার মাংসকে হলুদ লবণ দিয়ে সিদ্ধ করে ফ্রিজে ঠাণ্ডা করলেও কিছুটা চর্বি মাংস থেকে বেরিয়ে জমাকৃত অবস্থায় থাকবে। তখন বাড়তি চর্বিটুকু চামচ দিয়ে আঁচড়িয়ে বাদ দেওয়া খুবই সহজ। আবার মাংসকে র‌্যাক বা ঝাঁঝরা পাত্রে রেখে অন্য একটি পাত্রের ওপর বসিয়ে চুলোতে দিলে নিচের পাত্রটিতে মাংসের ঝরে যাওয়া চর্বি জমা হবে। এই পদ্ধতিতেও মাংসের কিছুটা চর্বি ঝরে যাবে। মাংস ছাড়া অন্য উৎস থেকে যাতে কোলেস্টেরল কম আসে সে বিষয়েও লক্ষ্য রাখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে রান্নার কাজে ঘি, বাটার অয়েল ব্যবহার না করে সয়াবিন কিংবা পাম অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে। মিষ্টান্ন তৈরির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে স্কিম্ড বা ননীতোলা দুধ। একইভাবে ডিমের তৈরি যেকোনো খাবার থেকে কুসুম বাদ দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া প্রচুর শাক-সবজি, ফলমুল খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। খাবারের সঙ্গে সালাদ রাখতে হবে। সালাদ এবং শাক-সবজি খাবারের চর্বিকে শরীরে শোষিত হতে বাধা দেয়। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিদিন ১০ গ্রামের মতো দ্রবণীয় আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করলে কোলেস্টেরলের পরিমাণ ৫-১০ শতাংশ কমতে পারে।

কাজেই কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে চাইলে পশুচর্বি বর্জন করতে হবে। এতে রক্তে খারাপজাতের কোলেস্টেরল এলডিএল মাত্রা কমে যাবে। পাশাপাশি যদি শাক-সবজি খাওয়ার মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া যায় সেক্ষেত্রে শাক-সবজির এন্টি অক্সিডেন্ট রক্তনালীর ভেতরের দেয়ালে খারাপজাতের কোলেস্টেরল এলডিএল-এর আঠালোভাবে লেগে থাকার প্রবণতা হ্রাস করে।

যাই হোক কথা হচ্ছিল কোরবানি নিয়ে। অর্থাৎ কোরবানির মাংস নিয়ে বলতে যেয়ে বলা হয়ে গেছে কোলেস্টেরল সম্পর্কে। সেই সঙ্গে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক সম্পর্কেও বলা হয়েছে। শেষ করার আগে একটা কথা বলে রাখি, কোরবানির মর্মকথা হচ্ছে আত্মত্যাগ। কোরবানিতে মাংস ভোজনের ব্যাপারে আত্মত্যাগের মহিমাকে অনুসরণ করলেই কিন্তু বাড়তি কোলেস্টেরলের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব।

ডা. সজল আশফাক
সহযোগী অধ্যাপক নাক, কান ও গলা বিভাগ
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।

Exit mobile version