চিকিৎসক নয়, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সংস্কার প্রয়োজন

অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৭ জানুয়ারী ২০১৯ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেছেন। এর আগেও তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেছিলেন। কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করার ঘটনা বিরল। তিনি পরিদর্শনে গিয়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে মত বিনিময় করেন। বিভিন্ন বিষয়ে দিক-নিদের্শনা এবং কার্যক্রমের মনিটরিং করেন, সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন। এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহন করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন। আমাদের দেশের প্রশাসনে বড় একটা দুর্বলতা রয়েছে যে,  নিয়মিত যথাযথ মনিটরিং, সুপারভিশন এবং ফলো আপ করা হয় না। এটা সর্বজন বিদিত যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তাঁর কার্যালয় বা গণভবনে বসে সকল কাজের নজরদারী করেন। সেদিন তিনি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং মেডিক্যাল শিক্ষার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। এর মধ্যে ডাক্তার নার্সদের উপস্থিতি এবং  তাদের কর্মস্থলে সুবিধা-অসুবিধা, নিরাপত্তার কথাও বলেছেন,  অসুবিধাগুলোর সমাধানের কথাও বলেছেন। আমি মনে করি এতে স্বাস্থ্য প্রশাসন উপকৃত হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট সকলে সচেতন হয়েছেন এবং আরো দায়িত্ববান হয়েছেন। এখন আমাদের সংশ্লিষ্ট  সকলের বিশেষ করে স্বাস্থ্য প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উচিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসরণ করে যে সমস্ত ভুলক্রটি, অনিয়ম রয়েছে তা সংশোধন করে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

দেশের জন্য আরো সুখবর “ সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপ-মন্ত্রীদের ৯০দিনের কাজের হিসাব নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের কাজের অগ্রগতি, কর্ম পরিকল্পনা, কে কোথায় কি নিয়ে ব্যস্ত – এসব মূল্যায়ন করবেন তিনি। এ তদারকির মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলে উৎসাহিত হবেন, কর্মস্পৃহা এবং দায়িত্ববোধ বাড়বে ফলে কাজের গতি এবং সফলতা আশাব্যঞ্চক হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে সকল বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সফলতা, সীমাবদ্ধতা, অনিয়ম, চিকিৎসকদের স্বল্পতা, হাসপাতাল ভাংচুর, নিরাপত্তা, আবাসন সমস্যাসহ নানা প্রতিকূলতার কথা বলেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সকল বিষয়ে দৃষ্টি রাখার জন্য আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা আশাবাদী  যে অনেক বাস্তব সমস্যার সমাধান দ্রুত হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসকদের সফলতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি নিজে ঘোষণা করেছেন, তাঁর  চিকিৎসা যেনো বাংলাদেশেই হয় এবং তিনি বাংলাদেশের চিকিৎসকদের কাছে পরীক্ষা- নিরীক্ষাসহ চিকিৎসা নিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, রয়েছে বাজেট – জনশক্তির স্বল্পতা। এরপরও গত ২ জুন ২০১৮ তারিখে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটের গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ ও মানসূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সার্কভূক্ত দেশেগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ভূটান, নেপাল ও  আফগানিস্তানের ওপরে। গবেষণায় যে ১৯৫টি দেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩। ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১৪৫, ১৪৯, ১৫৪। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ এওয়ার্ড পেয়েছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ভারত ও পাকিস্তানের থেকে এগিয়ে রেখেছে।  ভারতের কংগ্রেস নেত্রী মিসেস সোনিয়া গান্ধী, নোবেলবিজয়ী  ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন অনেকবার বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কোন কোন ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে এগিয়ে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের পরপরই কিছু  গণমাধ্যম কেবলমাত্র চিকিৎসকদের সমালোচনায় জড়িয়ে পড়লো – মনে হলো সকল অব্যবস্থার জন্য কেবলমাত্র চিকিৎসকরাই দায়ী – মুখোমুখি করা হলো চিকিৎসকদের গণমাধ্যমের এবং জনগণের। অনিয়ম, অব্যবস্থা যা আছে তা সংশোধন করতে হবে – এ নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই।  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে দিক নির্দেশনা  দিয়েছেন তা অনুসরণ করে, বিদ্যমান সকল সমস্যা চিহ্নিত করে, দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে সবাই মিলে কিভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরো উপযোগী, গণমুখী করা যায় সকলের সেদিকে নজর দেয়া উচিত। সেখানে চিকিৎসকরা অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা নেবে।

…………………………………………………………………………………………………

মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার পরিসংখ্যানে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সার্কভূক্ত দেশেগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ভূটান, নেপাল ও  আফগানিস্তানের ওপরে। গবেষণায় যে ১৯৫টি দেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩। ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১৪৫, ১৪৯, ১৫৪। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ এওয়ার্ড পেয়েছেন।

…………………………………………………………………………………………………

বিগত দশ বছরে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে – বেড়েছে অবকাঠামো, জনশক্তি, বাজেট, চিকিৎসার সুযোগ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা আধুনিকায়ন এবং উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ, এর পরে ও বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে ১৭ কোটি মানুষের অর্ধেকের কাছাকাছি মানুষকে আধুনিক চিকিৎসা পৌঁছানো গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী প্রতি ১০,০০০ মানুষের জন্য প্রয়োজন ১০ জন চিকিৎসক এবং ৩০ জন নার্স। বর্তমানে বাংলাদেশে এর অবস্থান উল্টো – চিকিৎসক রয়েছে ৫.৫ জন এবং নার্স ২.১জন। বর্তমানে দেশে প্রয়োজন ১,৭০,০০০ চিকিৎসক  এবং ৫,১০,০০০ নার্স। বর্তমানে রেজিষ্ট্রকৃত চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ৮০,০০০ (এমবিবিএস এবং বিডিএস)। গোটা বাংলাদেশে সরকারী চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ২১,৮০০ জন (মহাপরিচালক, অধ্যাপক থেকে মেডিকেল অফিসারসহ)।  এর মধ্যে বেশীর ভাগ নগরকেন্দ্রিক। বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে ১৫টি, স্নাতকোত্তর হাসপাতাল ১১টি, জেনারেল ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ৬৩, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৪২৪টি, অন্যান্য হাসপাতাল ৯৪টি। সরকারী শয্যা সংখ্যা ৪৯,৪১৪টি, বেসরকারী শয্যা সংখ্যা ৮৭,৬১০টি, নার্স সংখ্যা ৩৭,০০০ যেখানে গোটাদেশে বহির্বিভাগে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা ১৫০,০০০ – ২০০,০০০।  মেডিকেল কলেজ ১১১টি (সরকারী, বেসরকারী, ডেন্টালসহ)। এ বছর মেডিকেল কলেজগুলোতে ১০,২২৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। নার্স টেকনোলজিষ্ট এবং অন্যান্য সহকারী কর্মচারী অপ্রতুল এবং অদক্ষ। কমিউনিটি ক্লিনিক প্রায় ১৬ হাজার। রয়েছে বাজেট অপ্রতুলতা, দক্ষ জনশক্তির অভাব, দূর্নীতি এবং সর্বোপরি সর্বস্তরে অব্যবস্থাপনা। বাজেট মাথাপিছু ৩২ ডলার। গভীরভাবে সবাইকে অনুভব করতে হবে এ সক্ষমতা দিয়ে ১৭ কোটি মানুষের সন্তোষজনক চিকিৎসা দেয়া সম্ভব কিনা?  চিকিৎসা ক্ষেত্রে কিছু বাস্তবচিত্র সকলেরই অবগত হওয়া দরকার –

(১) চিকিৎসকের জীবন – যাপন :  প্রখর মেধা নিয়ে দূর্দান্ত প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে একজন মেডিকেল ছাত্রকে ভর্তি হতে হয় দু চোখ ভরা স্বপ্ন, দেশপ্রেম এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প নিয়ে। মেডিকেল কলেজ জীবন শুরু হয় আবাসন সমস্যা, নিম্মমানের খাবারসহ নানা সংকট নিয়ে। নতুন করে বড় সংকট হিসেবে দাঁড়িয়েছে তীব্র শিক্ষক সংকট। এত সংকটের মধ্যে তারুণ্য প্রাণবন্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে দেশ ও পরিবারের কাছে নানা দায়বদ্ধতা নিয়ে চিকিৎসক হিসেবে বেরিয়ে আসে। ছাত্রাবস্থায় একটা সাধারণ অভিযোগ থাকে মেডিকেল ছাত্রের পেছনে রাষ্ট্রের নাকি সবচেয়ে বেশী খরচ হয়।  বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে মেডিকেলের ছাত্রের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের পেছনে রাষ্ট্রের বেশী খরচ হয় । ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ডাক্তার হলেই সরকারী চাকুরির নিশ্চয়তা ছিলো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শুধুমাত্র পিএসসি এর মাধ্যমে নিয়োগ পেতে হয় স্বল্পসংখ্যক মেডিকেল অফিসার পদে। শেখ হাসিনা সরকার প্রায় ছয় হাজার ডাক্তার এডহক নিয়োগ দিয়েছিলেন, সম্প্রতি ১০,০০০ নিয়োগ দিয়েছেন এবং সামনে আরো দশ হাজার নিয়োগের প্রস্তুতি চলছে। এখন প্রায় ৫০,০০০ ডাক্তার বেকার রয়েছে। এদের সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত। কেউ অনেক কষ্ট করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করছে।  কেউ কেউ লজ্জাজনক বেতনে ক্লিনিকে অনিশ্চিত চাকুরী করছে। ইন্টার্নী চিকিৎসকদের বেতন যে কোন নিম্ম আয়ের মানুষের চেয়ে কম – মাত্র ১৫,০০০ টাকা। অথচ এরা সারা দিন রাত রোগীর পাশে থেকে হাসপাতালকে জাগিয়ে রাখে।

বাংলাদেশের যে কোন চিকিৎসক যে কোন সময়ে তাঁর আত্বীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী এবং এলাকার মানুষের বিনামূল্যে যে চিকিৎসা প্রদান করে তা বিশ্বে নজিরবিহীন, এমনকি দক্ষিন এশিয়াতেও। এদেশের মেডিকেল ছাত্র-চিকিৎসকরাই নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে রোগীর সেবা করেন। ড্রাগ ব্যাংক বানিয়ে দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে ঔষধ প্রদান করে, নগদ অর্থ সংগ্রহ করে অসহায় রোগীদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন – এ খবরগুলো খুব একটা দেখা যায় না। সম্প্রতি শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের অগ্নি দূর্ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ স্থাপন করেছেন চিকিৎসক,  মেডিকেল ছাত্র, নার্স-কর্মচারীরা।

(২) গ্রামে যেতে চায় না বা থাকতে চায় না – একটি ঢালাও অভিযোগ ডাক্তারদের শুনতে হয় – তাহলে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো চলছে কিভাবে? একটি কেন্দ্রও তো কখনো শোনা যায় না বন্ধ হয়ে গেছে বা একদিনও খোলা হয়নি। হয়তো কোথাও কোথাও অনিয়ম আছে – সেখানে ব্যবস্থা নিলেইতো শুধরিয়ে যাবে। কোথায় অনিয়ম থাকলে  আত্মমর্যাদাবান, মেধাবী চিকিৎসদের সতর্ক করলে বা কোন ধরনের ব্যবস্থা নিলে তারা সংশোধন করে নেবে। আমার বিশ্বাস, চিকিৎসকরা কখনো অবাস্তব দাবী করেনি। কিছু সমস্যাতো প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছে। কোন চিকিৎসক কখনো বলেনি এ সমস্যার সমাধান না হলে আমি যাবো না – এমনটা কখনো শোনা যায় না। গোটা বাংলাদেশে যে কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রোগীরা প্রতিদিন ডাক্তারের সাক্ষাৎ নিয়েই বাড়ী ফেরে নইলে নগর থেকে গ্রামে প্রতি হাসপাতালে, প্রতি কেন্দ্রে প্রতিদিন উপচে পড়া রোগীর ভীড় থাকে কিভাবে? সেখানে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তার সকল দায় চিকিৎসকের উপরে দিলে ঠিক হবে না।

যেহেতু এসব সমস্যা নিয়ে প্রায়ই সাংবাদিক বন্ধুদের সাথে আলোচনা হলে অনেকেই আমাকে পাল্টা বলেছেন – আজকে বাংলাদেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে কতগুলো অভিযোগ রয়েছে যা খুবই অল্প – ১৭ কোটি মানুষের দেশে এটা। সাংবাদিক বন্ধুদের এ কথাগুলো আমাদের আশ্বস্ত করে, উৎসাহিত করে।

আমাদের অনেক চিকিৎসক যারা বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ তৃনমূলে থেকে মানুষের সেবা দিয়ে আসছে ঢালাওভাবে যখন অভিযুক্ত করা হয় তখন তাঁদের মানসিক অবস্থাটা কি দাঁড়ায় ? স্বাভাবিকভাবে কষ্ট এবং হতাশা তাঁদেরকে গ্রাস করে। কোন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যখন  অনিয়ম বা অন্যায় প্রমানিত হয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে চিকিৎসকদের সংগঠন কখনো তার প্রতিবাদ করেনি। কোন চিকিৎসক অনিয়ম করলে চিকিৎসকদের মধ্যে তাদের ব্যাপারে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে।  অল্প সংখ্যক চিকিৎসকদের অভিযোগের দায়ভার গোটা চিকিৎসক সমাজ গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয় ।

(৩) চিকিৎসকের দায়িত্ব : প্রশাসনে যারা রয়েছেন তারা  বাদে অধিকাংশ চিকিৎসকের দায়িত্ব হচ্ছে চিকিৎসা প্রদান। উন্নত দেশে বা উন্নয়নশীল দেশের হাসপাতালে চিকিৎসক কেবল রোগী দেখে রোগ নির্নয় করে চিকিৎসা প্রদান করে এবং পরে ফলো আপ করেন।  শল্যচিকিৎসকরা অপারেশন করেন। এর বাইরে তাদের  কোন দায় নেই – এমনকি রোগীর আত্নীয়স্বজনের সাথে কথা বলারও দায় নেই, সেখানে আলাদা নির্ধারিত অচিকিৎসক ব্যাক্তি আছেন যিনি রোগীর স্বজনদের তথ্য সরবরাহ করেন। যেহেতু ওসব জায়গায় একটা সিস্টেম দাঁড়িয়ে গেছে। আর আমাদের দেশে সকল দায় চিকিৎসকদের বহন করতে হয়। এদেশের চিকিৎসকরা হাসিমুখে সে দায় নিচ্ছে কিন্তু সেখানে প্রয়োজন অনভিপ্রেত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করা। জেলা – উপজেলা পর্যায়ে প্রতিটি চিকিৎসক প্রতিটি মূহুর্তে উৎকন্ঠায় থাকে কখন আক্রমণের শিকার হবেন। কারন কেবল বাংলাদেশ কেন, উন্নয়নশীল দেশের কোন হাসপাতালই রোগীর সম্পূর্ণ সন্তোষজনক চিকিৎসা প্রদানের সক্ষমতা অর্জন করেনি। তবে চিকিৎসকদের প্রশান্তির বিষয় হলো সাধারন মানুষের চিকিৎসা নিয়ে তেমন কোন অভিযোগ নেই বরং তারা দীর্ঘ লাইন ধরে যে চিকিৎসা পাচ্ছে সন্তুষ্টি চিত্তে তা নিয়ে বাড়ী ফিরছে ।

(৪) বাংলাদেশের সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা :
এটি বাংলাদেশের জন্য খুবই গৌরবের বিষয়। স্বাধীনতার পর পরই বন্ধবন্ধু বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সরকারের দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছেন।  তাঁর ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু কন্যা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এর উন্নয়ন, সম্প্রসারণ, আধুনিকায়ন করে চলেছেন। এরকম সরকারী ব্যবস্থা বিশ্বে আর কোথাও খুব একটা পাওয়া যাবে না। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সৌদি আরবে  পাওয়া যেত – সেখানে এখন অনেক সংকুচিত হয়েছে। পাশের দেশগুলোতে বেসরকারী ব্যবস্থার কাছে সরকারী ব্যবস্থা খুঁজে পাওয়া যায় না। উন্নত বিশ্বে ইনসুরেন্সসহ নানাভাবে চিকিৎসা পুরোপুরি ক্রয় করতে হয়। বিশ্ব জোড়াই আধুনিক চিকিৎসা ব্যয়বহুল। অসংখ্য রোগী বিদেশ থেকে বাংলাদেশে চিকিৎসা নিতে আসে এমনকি আমেরিকা, ভারত আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে।

(৫) রোগীরা কেন বিদেশে যায় ?
বিশ্বে এখন স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা হচ্ছে অর্থ উপার্জনের বড় ব্যবসা। খোদ  ঢাকা শহরে বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার ব্যবসায়িক প্রতিনিধি আছে, আছে তাদের লিয়াজোঁ অফিস। বাংলাদেশের চিকিৎসাকে বিতর্কিত করে অন্য দেশের চিকিৎসার সুনাম করাই প্রধানত তাদের কাজ। যারা যাচ্ছে বিদেশে তাদের শতভাগ বিদেশের বেসরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হচ্ছে বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে চাকচিক্যের মধ্যে। নি:স্ব হয়ে ফেরার অসংখ্য ইতিহাস কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতারিত হচ্ছে। বাংলাদেশের যে সমস্ত রোগীরা বিদেশে যাচ্ছে তাদের ৮০ ভাগের চিকিৎসা আমাদের এমবিবিএস ডাক্তারাই প্রদান করতে সক্ষম। উন্নত চিকিৎসার জন্য কিছু রোগী যেতেই পারে – সব দেশ থেকেই তা যায়ও।  কিন্তু কেবলমাত্র ব্যবসার ফাঁদে পড়ে যাবে – সে বিষয়ে সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া উচিত।

(৬) নিরাপত্তাহীনতা :  বিগত ৫-৭ বছরে চিকিৎসক এবং হাসপাতালে অসংখ্য হামলা হয়েছে। সাতক্ষীরা, বগুড়া, ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল, সলিমুল্লা মেডিকেল ইমার্জেন্সীসহ গোটা দেশে চিকিৎসক হামলা, হত্যা-ধর্ষণ, হাসপাতাল ভাংচুর হয়েছে। তেমন কোন প্রতিকার বা ব্যবস্থা গ্রহণ লক্ষ্য করা যায়নি। বিশেষ করে ইমার্জেন্সী বিভাগে চিকিৎসক-নার্স-কর্মচারীরা প্রতিনিয়ত হামলার আতংকে ভোগে। সামান্য তুচ্ছ ঘটনায় ডাক্তার মারধর, হাসপাতাল ভাংচুর বেড়েই চলেছে।

(৭) টীম ওয়াকর্ :  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী প্রতি ১০,০০০ মানুষের জন্য ন্যূনতম ২৩ জনের একটি মেডিকেল টীম থাকতে হয়। সংখ্যা এবং দক্ষতায় সহযোগী কর্মীর ব্যাপক সংকট রয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় নার্স, টেকনোলজিষ্টসহ সহযোগী স্বার্স্থ্যকর্মীদের রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চিকিৎসক চিকিৎসা প্রদানের পর ২৪ ঘন্টা সহযোগী স্বাস্থ্য কর্মীরা নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

(৮) দূর্নীতি : স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রায়ই বড় বড় দূর্নীতির খবর আমরা দেখতে পাই। বড় অংকের অর্থ লোপাট, অপ্রয়োজনীয় মহামূল্যবান যন্ত্র ক্রয় করে ফেলে রাখাসহ নানা খবর নানা অভিযোগ। যারা রোগীদের জীবনরক্ষার অর্থ লুটপাট করে তাদের ব্যাপারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে উন্নত বিশ্বের চিকিৎসা ব্যবস্থা তুলনা করা ঠিক হবে না। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সকল মহলকেই ভিন্নভাবে দেখতে হবে, চিকিৎসকদেরতো বটেই  – কারণ, এ ব্যবস্থায় মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে কাজ করতে হয়। দুবার স্বাধীন হওয়া দেশ, দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতার পর এখন স্বস্থিকর একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। একা চিকিৎসকের দায় নয়, বৃহৎ ব্যপস্থাপনা পুরো সার্ভিস দক্ষতার উপর নির্ভর করে। এ ছাড়া আমরা রাতারাতি পাল্টাতে পারবো না।

লক্ষ্য প্রাণের বিনিময়ে অজির্ত এ দেশে আমরা সংশ্লিষ্ট সকলে আন্তরিকভাবে একটি লক্ষ্য স্থির করি – ‘চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিদ্যমান  সম্পদ  এবং জনশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে রোগীদের সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে।’

…………………………………………………………………………………………………

বর্তমানে দেশে প্রয়োজন ১,৭০,০০০ চিকিৎসক  এবং ৫,১০,০০০ নার্স। বর্তমানে রেজিষ্ট্রকৃত চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ৮০,০০০ (এমবিবিএস এবং বিডিএস)। গোটা বাংলাদেশে সরকারী চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ২১,৮০০ জন (মহাপরিচালক, অধ্যাপক থেকে মেডিকেল অফিসারসহ)।  এর মধ্যে বেশীর ভাগ নগরকেন্দ্রিক। বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে ১৫টি, স্নাতকোত্তর হাসপাতাল ১১টি, জেনারেল ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ৬৩, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৪২৪টি, অন্যান্য হাসপাতাল ৯৪টি। সরকারী শয্যা সংখ্যা ৪৯,৪১৪টি, বেসরকারী শয্যা সংখ্যা ৮৭,৬১০টি, নার্স সংখ্যা ৩৭,০০০ যেখানে গোটাদেশে বহির্বিভাগে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা ১৫০,০০০ – ২০০,০০০।  মেডিকেল কলেজ ১১১টি (সরকারী, বেসরকারী, ডেন্টালসহ)। এ বছর মেডিকেল কলেজগুলোতে ১০,২২৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। 

…………………………………………………………………………………………………

এ লক্ষ্যে সুপারিশ হলো –
(১)   স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণ : যে কোন কাজ শুরুর আগে তার প্রশাসনিক ব্যবস্থা নির্দিষ্ট করে নিতে হয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা খুবই নাজুক এবং অকার্যকর। বাস্তাবিকপক্ষে স্বাস্থ্য সচিব থেকে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক খুবই ব্যস্ত। তাদের পুরনো দায়িত্ব বন্টন এখন অবাস্তব। প্রতিটি কাজের যে মনিটরিং, সুপারভিশন এবং ফলোআপ করা দরকার এ ব্যবস্থায় সম্ভব নয়।  এবং এ ছাড়া কোন কার্যক্রমই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। একই ব্যক্তির আবার বহু দায়িত্ব দেয়ায় এবং ধরে রাখার প্রবণতার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। যেমন একটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, তিনিই ডীন, তিনিই বিভাগীয় প্রধান, তিনিই বিএমডিসির সদস্য এবং অনেকগুলো চিকিৎসক সমিতির নেতা। আবার রয়েছে প্রাইভেট প্রাকটিস এবং ক্লিনিকে ভর্তি রোগী দেখা – একটি কাজের জন্যই তাকে চব্বিশ ঘন্টা ব্যয় করার কথা। এ কাজগুলোর সুসম বন্টন হলে কাজের গতি এবং আউটপুট বাড়বে। বহুবার ভাবা হয়েছে প্রশাসনিক পদগুলোকে নন প্র্যাকটিসিং করার। স্বাস্থ্য প্রশাসকদের দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণেরও অভাব রয়েছে। লোকবলও পর্যাপ্ত নয়। প্রশাসকদের সহকর্মী বান্ধব হতে হবে। গ্রহণযোগ্য কর্মপরিবেশ এবং মানসিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য প্রশাসন কাঠামো পূণর্মূল্যায়ন করে বাস্তব দায়িত্ব বন্টন এবং নিবীড় পর্যবেক্ষনের ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।

(২) স্বাস্থ্য জনশক্তি পরিকল্পনা গ্রহন : ৪৮ বছরের বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বলতে গেলে তেমন কোন স্বাস্থ্য জনশক্তি পরিকল্পনা নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কখনো কখনো হয়েছে তবুও তা বাস্তবায়ন হয়নি। একটি সময়পোযোগী  – স্বাস্থ্য জনশক্তি পরিকল্পনা করা সময়ের দাবী। কারন আমরা উন্নয়নশীল দেশে পদার্পন করেছি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা কার্যক্রম শুরু করেছি।

(৩) বাজেট : জাতীয় বাজেটের নূন্যতম দশভাগ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দিতে হবে। এতে ক্ষতি হবে না। সুস্থ জনবল দেশের উন্নয়নে বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বাজেট মাথাপিছু ৩২ ডলার, ভারতে ৬১ ডলার, নেপালে ৩৯ ডলার, ভিয়েতনামে ১১১ ডলার, মাল্বদ্বীপে ৭১০ ডলার এবং শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১০০০ ডলার।

(৪) নিয়োগ এবং বদলী নীতিমালা : দেশে কোন সুর্নিদিষ্ট নিয়োগ ও বদলী নীতিমালা নেই। এটিই তরুণ চিকিৎসকদের হতাশার অন্যতম কারণ। তরুণ চিকিৎসকদের বদলির ধাপ এবং উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সম্বলিত একটি কার্যকর  ঈধৎৎরবৎ চষধহহরহম দরকার । তাহলেও কিছুটা হতাশা দূর হবে। দূরবর্তী বা দূর্গম চিকিৎসা কেন্দ্রের পদায়নের জন্য আলাদা আর্থিক  রহপবহঃরাব  যুক্ত করা প্রয়োজন।

(৫) বিএমডিসিকে শক্তিশালী এবং কার্যকর করতে হবে : প্রায় ১৫ বছর বিএমডিসি মামলাধীন এবং অকার্যকর ছিলো। বর্তমানে কিছুটা কার্যকর হয়েছে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ এ নিয়ন্ত্রনকারী সংস্থা নানা দুর্বলতায় নিমজ্জিত। চেয়ারম্যান পদে একজন সার্বক্ষণিক পেশার সিনিয়র অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে দিলে যথাযথ কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হয় না।  লোকবলের স্বল্পতাসহ রয়েছে নানা সমস্যা। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গুরুত্বের কথা বিবেচনায় রেখে এর সকল সমস্যা দ্রুত সমাধান করে সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে হবে।  তাহলে দেশের স্বাস্থ্য ও মেডিকেল শিক্ষা কার্যক্রম অনেক সুষ্ঠু ও নিয়ন্ত্রিত হবে।

(৬) বেসরকারী হাসপাতাল ও কিèনিক পরিচালনা : দেশের বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থারও অনেক উন্নয়ন হয়েছে এবং স্বাস্থ্য সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কোন কার্যকর নীতিমালা নেই। বিশেষ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক – নার্স জনবল ও নিয়মিত বেতন কাঠামোসহ কার্যকর নীতিমালা থাকতে হবে  যাতে চাকুরীরত চিকিৎসক নার্স এবং অন্যান্য জনবল চাকুরীর নিশ্চয়তা পেতে পারে।   বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সরকারীভাবে সহযোগীতা করা প্রয়োজন।

(৭) নিরাপত্তা নিশ্চিত করা : প্রতিটি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্র নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে পুলিশ ফাড়ি বা পুলিশের বিশেষ স্কোয়াডের ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসক আক্রমণ এবং হাসপাতালে ভাঙচূরের জন্য দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

(৮) আঞ্চলিক প্রশাসনিক বিন্যাস : কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রন করা , যোগাযোগ করা বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সমস্যা সমাধান করা বাস্তবমুখী নয়। প্রয়োজনীয় জনবল, অবকাঠামো এবং ক্ষমতা প্রদান করে জেলা বা নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরন প্রয়োজন।

(৯) ঔষধের মূল্য : বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প অত্যন্ত গৌরবের। দেশের ৯৮ ভাগ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ১৪৫টি দেশে রফতানি করছে। ভেজাল ঔষধ নিয়ন্ত্রণে আরো কার্যকর কঠোর কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রয়োজনীয় জনবল প্রয়োজন। ঔষধের মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঔষধের মূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।

(১০) রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বাস্থ্য প্রশাসন :  স্থানীয়ভাবে জনপ্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বাস্থ্য প্রশাসনকে সহযোগীতা করতে হবে। সচিবালয় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য কেন্দ্র পর্যন্ত প্রশাসন চিকিৎসক সংগঠনের প্রভাব মুক্ত থাকতে হবে যাতে প্রশাসন নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও আইনানুগভাবে কাজ করতে পারে। এ বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে।

(১১) মেডিকেল ইনফরমেশন সিস্টেম (এম আই এস) : একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য গওঝ  খুবই প্রয়োজনীয়। দুঃখজনক হলো আমি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগের কাছে  কোন তথ্য বা সহযোগীতা পাইনি অসংখ্যবার যোগাযোগ করে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ অবগত আছেন। দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিষয়ক তথ্য অনেক কষ্ট করে সংগ্রহ করতে হয়।

(১২) সুনির্দিষ্ট অভিযোগ – সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা : ঢালাওভাবে অভিযোগ না করে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিতে হবে। সহকর্মীর মানসিক অবস্থা, ব্যক্তিগত সমস্যা বিবেচনায় রেখে সহকর্মীবান্ধব প্রশাসন সৃষ্টি করতে হবে। শুধুমাত্র শাস্তি প্রদানের মধ্যে দিয়েই বন্ধত্বপূর্ণ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের, আন্তরিক পরিবেশ গড়ে ওঠে না।

(১৩) পেশাজীবীদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ : চিকিৎসকদের সাথে সকল পেশার মানুষের রয়েছে হৃদ্ধতাপূর্ণ সম্পর্ক। সকল পেশাজীবীরা চিকিৎসকদের কাছে বন্ধুত্বের কারনেই বিশেষ সহযোগীতা পেয়ে থাকেন। কিন্তু মাঝে মাঝে অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বিশেষ করে সাংবাদিক বন্ধুদের সাথে।  চিকিৎসা একটি জটিল এবং বিস্তৃত বিজ্ঞান। কষ্ট সাধ্য পাঁচ বছর সর্বোচ্চ মেধা প্রয়োগ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ঈঙজঊ কঘঙডখঊউএঊ রপ্ত করতে হয়।  তারা ছাড়া কেউ চিকিৎসাশাস্ত্র বা চিকিৎসার ধরণ সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারবে না। করলে সঠিক হবে না বরং বিভ্রান্তিকর হবে। একজন চিকিৎসক চাইলে যে কোন সাধারণ পেশায় যেতে পারে – যাচ্ছে। কিন্তু অন্য যে কোন সাধারণ বিষয়ের মানুষ কখনোই চিকিৎসক হতে পারবে না। আমরা সকলেই এদেশের সন্তান, ভাই-বোন, আত্নীয়-স্বজন। পরস্পর বিরোধী অবস্থান পরিহার করে কিভাবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং আস্থা অর্জন করে বোঝাপড়ার শক্ত ভিত স্থাপন করতে পারি – সকলের সেদিকেই মনোযোগী হওয়া দরকার। তাহলেই অনেক সংকট দূরীভূত হবে। আমরা কেউ কাউকে ছাড়া চলতে পারি না বা সম্ভব নয়।  সেজন্য সুসম্পর্ক থাকুক অটুট এবং কার্যকর।

১৭৬২ ডলারের মাথাপিছু আয়ের এ দেশে, অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েও সকলের সহযোগীতায় একটি স্বাস্থ্যবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। পারস্পরিক বৈরিতা এবং দোষারোপ পরিহার করে সমস্যা চিহ্নিত করে বাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। চিকিৎসক – নার্স – স্বাস্থ্য কর্মীদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এবং হাসিমুখে সেবা দিতে হবে যেমন, তেমনি রোগী এবং স্বজনদেরও  থাকতে হবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সহযোগীতা এবং সহনশীলতা।

আমরা আশা করবো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরবর্র্তী স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় পরিদর্শনের পূর্বেই তাঁর দিক -নির্দেশণার ব্যাপারে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে । বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেনো সন্তুষ্টি নিয়ে ফিরতে পারেন মন্ত্রনালয় থেকে।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

Exit mobile version