স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ভেঙে নতুন ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর’ গঠন

দেশে নতুন আরেকটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে এই অধিদপ্তরের নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর’। বর্তমান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দুই ভাগ করে চিকিৎসা শিক্ষা বিভাগের জন্য এই আলাদা অধিদপ্তর করছে সরকার। আর চিকিৎসাসেবা বিভাগ থাকছে বর্তমান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে। গত ২৪ নভেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের আওতায় ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর’ গঠন করে আদেশ জারি করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে এই অধিদপ্তর গঠন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর স্বাস্থ্য শিক্ষা সংক্রান্ত সব প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাডেমিক, প্রশাসনিক, উন্নয়ন ও গবেষণার বিষয়গুলো দেখভাল করবে। এখন থেকে সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, ম্যাটস ও হেলথ টেকনোলজিসহ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ গত সোমবার বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ভেঙে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর নামে আরেকটি বিভাগ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে একটি আদেশ জারি হয়েছে। ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিভাগকেও আলাদা করে আরেকটি অধিদপ্তর করার চিন্তাভাবনা রয়েছে।

ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের জন্য নতুন লোকবল নিয়োগ শুরু হয়েছে। নবগঠিত অধিদপ্তরের প্রথম মহাপরিচালক হিসেবে বর্তমান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত সোমবার তাকে প্রেষণে এই পদ নিয়োগ দিয়ে এক আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

পাশাপাশি তিনজন অতিরিক্ত মহাপরিচালককেও (এডিজি) নিয়োগ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গত বৃহস্পতিবার নিয়োগ দিয়ে আদেশ জারি করা হয়। তারা দুজনই আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নেতা। তাদের মধ্যে একজন অধ্যাপক ডা. আবু ইউসুফ ফকির এডিজি (শিক্ষা) এবং অধ্যাপক ডা. আবুল হাশেম খান এডিজি (প্রশাসন) হিসেবে। ডা. ইউসুফ ফকির ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের অধ্যাপক ও হাসপাতাল স্বাচিপের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে তিনি স্বাচিপের কার্যকরী কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ। আর ডা. আবুল হাশেম খান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার অপারেশনাল প্ল্যান ক্লিনিক প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ও হাসপাতাল স্বাচিপের সভাপতি ছিলেন। তিনি বিএমএ’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক।

এছাড়া বর্তমান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগব্যাধি বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনাকে নতুন অধিদপ্তরের এডিজি হিসেবেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দেশে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এছাড়া মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও অনেকটা বেড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নেই। ফলে প্রকৃত মেডিকেল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভবিষ্যৎ চিকিৎসকরা। এসব বিষয় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও সমাধার জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর প্রয়োজন। অন্যদিকে দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে অসংখ্য হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সেবার মান দেখার জন্য পর্যাপ্ত জনবল নেই। ফলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুই ভাগ হলে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।

এখনো নতুন অধিদপ্তরের স্থান নির্ধারণ হয়নি বলে জানান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, বর্তমানে অধিদপ্তরের শিক্ষা বিভাগ অধিদপ্তরের পুরনো ভবনে কাজ করছে। সেটাই নতুন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় হতে পারে। অধিদপ্তরের জন্য নতুন অর্গানোগ্রাম তৈরি ও কাজের পরিধি নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী লোকবল নিয়োগ দেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে নতুন অধিদপ্তরের নতুন এডিজি অধ্যাপক ডা. ইউসুফ ফকির বলেন, নতুন অধিদপ্তরের জন্য অর্গানোগ্রাম তৈরির কাজ চলছে। নিয়োগও হচ্ছে। আশা করি আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে অধিদপ্তর পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করতে পারবে। এখন থেকে চিকিৎসা শিক্ষার পুরো বিষয়টা আমরা দেখব। সব মেডিকেল কলেজে ভর্তি ও পড়ালেখার দেখভাল এই অধিদপ্তর করবে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সরকারের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে তিন ভাগে ভাগ করা উচিত। একটি মেডিকেল শিক্ষা, একটি জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি এবং আরেকটি স্বাস্থ্যসেবা। মেডিকেল শিক্ষার মধ্যে চিকিৎসক, নার্স ও প্যারামেডিক থাকবে আর জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টির মধ্যে টিকাদান, পুষ্টি কার্যক্রম এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সব ধরনের চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানকে তদারকি করবে। এতে করে জবাবদিহিতার ক্ষেত্র তৈরি হবে। মানুষ সব ধরনের সেবা গ্রহণ করতে পারবে। দেরিতে হলেও সরকার একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্তটি বহু আগেই নেওয়া উচিত ছিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দুই ভাগ করার উদ্দেশে ২০১৭ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে পুনর্গঠন করে দুটি বিভাগ করা হয়। এর একটি ‘স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ’, অন্যটি ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ’। বর্তমানে এ মন্ত্রণালয়ের একজন মন্ত্রী এবং দুই বিভাগের দুজন সচিব রয়েছেন। এর মধ্যে বর্তমান স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীনে এবং নতুন অধিদপ্তর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের’ অধীনে থাকবে।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সব হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিক), বর্তমান স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট, ইলেকট্রো-মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) এবং যানবাহন ও যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ সংস্থা (টেমো)।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে রয়েছে নতুন অধিদপ্তর, মেডিকেল কলেজ, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউট, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল, বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল এবং ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক বোর্ডও রয়েছে এই বিভাগের অধীনে।

Exit mobile version