Connect with us

স্বাস্থ্য সংবাদ

বিশ্ব পানি দিবস

॥ সুনির্মল চন্দ্র বসু ॥ আজ বিশ্ব পানি দিবস। প্রতি বছর এ দিনটিকে বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। পানি প্রকৃতির এক অনন্য দান। পারিবেশিক সুস’তা এবং মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পানির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। ভূপৃষ্ঠের যে বিশাল জলরাশি সমুদ্র, হ্রদ, নদী ও খাল-বিল বহমান এমনকি ভূ-গর্ভে যে বিশাল জলরাশি সঞ্চিত হয়েছে তা অপরিমেয়। পরিমাণগত […]

Published

on

॥ সুনির্মল চন্দ্র বসু ॥
আজ বিশ্ব পানি দিবস। প্রতি বছর এ দিনটিকে বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। পানি প্রকৃতির এক অনন্য দান। পারিবেশিক সুস’তা এবং মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পানির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। ভূপৃষ্ঠের যে বিশাল জলরাশি সমুদ্র, হ্রদ, নদী ও খাল-বিল বহমান এমনকি ভূ-গর্ভে যে বিশাল জলরাশি সঞ্চিত হয়েছে তা অপরিমেয়। পরিমাণগত দিক দিয়ে পৃথিবীর তিন ভাগ পানি হলেও গুণগত মান বিচারে তা কতখানি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ভূমিকা রাখে, সময়ের বিচারে আজ তা প্রশ্নের সম্মুখীন। পৃথিবীর মোট পানির আয়তন ৩২৬০,৭৪,৪০০ ঘন মাইল। এর মধ্যে প্রায় ৯৭.৫ শতাংশ লবণাক্ত পানি এবং বাকি ২.৫ শতাংশ স্বাদু পানি। হৃদ, নদী ও খাল-বিলে অবসি’ত পানির পরিমাণ খুবই সামান্য; অর্থাৎ পৃথিবীর মোট পানির ০.০১ শতাংশ। বাংলাদেশের নদীবাহিত পানির পরিমাণ প্রায় ১০১০ কি.মি. এবং স’ানীয় বৃষ্টির পানির পরিমাণ ৩৪০ কি.মি. যা নদীর মধ্য দিয়ে সমুদ্রে প্রবাহিত হয় (উৎস : বাংলাদেশ ওয়াটার ভিশন-২০২৫) । পৃথিবীর কিছু এলাকায় পানির প্রচুর বাড়তি (ব্রাজিল ৩৮,০০০ মি৩/প্রতিজন/বছর) এবং কিছু এলাকায় ভয়াবহ ঘাটতি (মিসরে ১২০০ মি৩/প্রতিজন/বছর) দেখা যায়। আমাদের দেশে মাথাপিছু পানি পাওয়ার হার ১১,০০০ ঘন মিটার/প্রতিজন/বছর। পানির ৭৩ ভাগ সেচকাজে, ২১ ভাগ শিল্পে ও ৬ ভাগ মাত্র মানুষের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহাত হয়। বাংলাদেশে গ্রামীণ এলাকায় প্রায় মাথাপিছু ৫০ লিটার, শহর অঞ্চলে মাথাপিছু ১০০ লিটার এবং মেট্রোপলিটনে ১৬০ লিটার পানির প্রয়োজন। ভূগর্ভস’ পানির প্রায় ৮২ শতাংশ সেচকাজে ব্যবহৃত হয়। এ দিকে শহরে প্রতিদিন পানিদূষণ ঘটছে কলকারখানার ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্য দ্বারা, অপর দিকে গ্রামে ব্যাপক পানিদূষণ ঘটছে কৃষিজমিতে সার-কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এবং খাবার পানির উৎসে মানুষসৃষ্ট দূষণের কারণে। যুগপৎভাবে এ ক্ষতিকর প্রভাব জীববৈচিত্র্যকে নষ্ট করার পাশাপাশি মানুষের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। ফলে ভূ-পৃষ্ঠের, ভূউপরিস’ ও ভূগর্ভস’ পানির গুণাগুণ হচ্ছে নষ্ট, যা মানুষের বেঁচে থাকার পরিবেশকে প্রতিকূল করে তুলছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে বিশ্বে পানির চাহিদা ২৪৩৭০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার (মার্চ মাস সর্বোচ্চ চাহিদা পরিমাপ করে) এবং সরবরাহ ২৩৪৯০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার থাকবে। অর্থাৎ পানি ঘাটতি থাকবে ৮৮০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। এতে পানির স্বল্পতার ভবিষ্যৎ চিত্র ভয়াবহ হবে।
নদ-নদী মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জীবন-জীবিকায় অপরিমেয় প্রভাব ফেলে। নদীর জোয়ার-ভাটা কৃষিকাজের জন্য ভূপ্রকৃতি, পানি ও বৃষ্টিপাতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। বঙ্গোপসাগর থেকে ২১ শতাংশ মাছ ধরা হয়, যা রফতানি আয়ের ১০ শতাংশ দেয়। শহরে পয়ঃপ্রণালী বা শিল্পকারখানার আবর্জনা নিষ্কাশনের ব্যবস’াপনা নদীমুখী বলে নদীর স্রোত কম হলে ওই আবর্জনা অপসারণও সম্ভব হয়নি। ২০৫০ সালে পৃথিবী বিশাল আবর্জনার স-ূপে পরিণত হবে। কলকারখানার বর্জ্যে ইতোমধ্যে বিশ্বের অর্ধেক নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে উঠছে। এ আবর্জনা অণুজীবের সংখ্যা বাড়ায় এবং ফাইটোপ্লাঙ্কটনেরও সংখ্যা বাড়ানোর কারণ হয়। পাশাপাশি পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় জলজ প্রাণীর জীবনযাত্রা হুমকির মুখোমুখি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ ইউরোপ, আফ্রিকা ও ঢাকায় পানির সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করবে। প্রতিদিন বিশ্বে ২৫,০০০ মানুষ পানির অভাব ও দূষণে মারা যাচ্ছে। ইউরোপের রাইন নদীতে প্রতি ঘণ্টায় ১২৫০ টন দূষিত তরল বর্জ্য নিঃসরিত হওয়ার ফলে রাইন নদী কলুষিত হচ্ছে। অথচ প্রায় দুই কোটি লোক রাইন নদী থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করে থাকে। জরিপে দেখা গেছে, ভারতের শতকরা ৭০ ভাগ ভূপৃষ্ঠের পানি দূষিত। মালয়েশিয়ার চারটি নদী পাম তেল ও রাবার শিল্পবর্জ্য দ্বারা এমন মাত্রায় দূষিত যে, ওই সব নদীর মাছ ও জলজ প্রাণীর মৃত্যু ঘটছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী কলকারখানাগুলো থেকে দৈনিক গড়ে ৫০-৬০ টন বর্জ্য পদার্থ নদীপথে বঙ্গোপসাগরে পতিত হচ্ছে। নদ-নদীকে ঘিরে সম্পদ আহরণের জন্য ১ কোটি ১০ লাখ জনশক্তি প্রত্যক্ষ এবং দেড় কোটি পরোক্ষভাবে কাজ করছে। নদীর দুই পাশের মাটি ভরাট, স’াপনা নির্মাণ একদিন কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে?
ধারণা করা হয়, প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি টন অপরিশোধিত তেল সমুদ্রবক্ষে পতিত হয়। উপসাগরীয় যুদ্ধ ও ইরাক যুদ্ধে এর মাত্রা বহুলাংশেই বাড়ছে। ফলে জীবনির্ভর পেশাজীবী দরিদ্র মানুষ ক্রমান্বয়ে দিনহীন হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি প্রাণীর ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়ে পানিদূষণের প্রভাবে মানুষের স্বাস’্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস’্য সংস’ার মতে, মানবদেহে শতকরা ৮০ ভাগ রোগই হয় দূষিত পানির কারণে। শুধু ঢাকা শহরে প্রতিবছর ১০ হাজারেরও বেশি শিশু পানিবাহিত রোগে মারা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার আকাশে জমেছে বাদামি মেঘের আস্তরণ; তা থেকে ঝরতে পারে অ্যাসিডবৃষ্টি, যা কোটি কোটি মানুষের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে আনবে। এ বাদামি মেঘের জন্যই এ এলাকায় বৃষ্টিপাত দীর্ঘস’ায়ী ও অনিয়মিত হচ্ছে। এতে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার মতো মারাত্মক রোগ হচ্ছে। অজৈব আর্সেনিক ক্যান্সার সৃষ্টি করতে সক্ষম এ ধারণা শতাব্দী-প্রাচীন। বিশ্বের বহু দেশে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদে আর্সেনিক শরীরে প্রবেশ করলে ত্বক, মূত্রাশয়, ফুসফুসসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গে ক্যান্সার হতে পারে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আর্সেনিক বিশেষজ্ঞ ডা: অ্যালান এইচ স্মিথের মতে, আগামী দশকে বাংলাদেশে প্রতি পাঁচটি ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর একটি হবে আর্সেনিক-দূষণ থেকে সৃষ্ট ক্যান্সারের ফলে। বাংলাদেশের জনস্বাস’্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. শেখ আখতার আহমদের আশঙ্কা ইতোমধ্যে কমপক্ষে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ লাখ লোক আর্সেনিকের প্রকোপে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। আশঙ্কাটি বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের জন্য নিঃসন্দেহে ভয়াবহ।
পানির জন্য বর্তমান শতাব্দীতে যুদ্ধ ঘটতে পারে, যেমনটি ঘটছে তেলের জন্য। জাপানের কিয়োটাতে বিশ্ব পানি ফোরামে জাতিসঙ্ঘের উপস’াপিত পর্যালোচনা রিপোর্টে বলা হয়েছে, বর্তমানে পৃথিবীর ২০০ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে না। দূষিত পানি পান করায় প্রতি বছর ২০ কোটি মানুষ কলেরা-ডায়রিয়া প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে মারা যায় প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। এ অবস’া থেকে উত্তরণের জন্য জাতিসঙ্ঘ ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস’্যসম্মত উপায়ে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে প্রতি বছর দরকার হবে ১০ হাজার কোটি ডলার। আফ্রিকায় যারা বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধা পাচ্ছে না, তাদের সংখ্যা ২০১৫ সালের মধ্যে অর্ধেক কমিয়ে আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিশাল জলরাশিকে পৃথিবীর পরিবেশ ব্যবস’ার মেমোরিস্বরূপ বিবেচনা করা হয়। ক্রিস নিকেজ তার বই জার্নি থ্রো দ্য ইমপসিবলে উল্লেখ করেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লেক ও নদ-নদীগুলো আজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সুইডেনের ২০ ও নরওয়ের ৮০ শতাংশ লেক ও নদ-নদী আজ দূষিত। ওনটারিত্তর ৩০০ লেক অম্লীয়। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন নদী শুকিয়ে আজ অতীতের বহমান নদীর চিহ্ন বহন করছে। এ অবস’ার জন্য একেবারেই সুযোগ দেয়া অনুচিত?
এ বছর সব মানুষের কাছে নিরাপদ পানি পৌঁছে দেয়ার আয়োজন সম্পন্ন করা বা পর্যাপ্ত উদ্যোগ গ্রহণ করাও সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য। ভূ-উপরিসি’ত পানি ও বৃষ্টির পানি মিলিয়ে বিশাল পানিসম্পদ রয়েছে। পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের পানিসম্পদকে বিনষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষক, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ, মুজিব ডিগ্রি কলেজ, কাদেরনগর, সখীপুর, টাঙ্গাইল

Continue Reading
Advertisement