নতুন নীরব ঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মাদকহীন অস্বাস্থ্যকর খাবারজনিত লিভারের রোগ বা নন-অ্যালকোহলিক স্টেয়েটোহেপাটাইটিস (ন্যাশ), যা থেকে বাঁচতে হলে অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিহার, স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে বেশি জরুরি। এ জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে ব্যাপক জনসচেতনতা। আজ বিশ্ব ন্যাশ দিবস উপলক্ষে গত সোমবার হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ, কালের কণ্ঠ, চ্যানেল আই ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় গোলটেবিল বৈঠক, যা নিয়ে আজকের এই বিশেষ ক্রোড়পত্র। গ্রন্থনা : শরীফুল আলম সুমন ও রেজাউল করিম। ছবি : মঞ্জুরুল করিম
অধ্যাপক মবিন খান
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী লিভার রোগ হলো নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার তথা ন্যাশ। পৃথিবীর প্রায় এক-চতুর্থাংশ লোক ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। এর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই ফ্যাটি লিভার রোগের প্রাদুর্ভাব ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। বাংলাদেশেও ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ লোক এই ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে শিশু-কিশোর, মধ্যবয়সী ও মহিলাদের মধ্যে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। ন্যাশ প্রাথমিকভাবে লিভার কোষে প্রদাহ শুরু করে। পরে লিভার সিরোসিসের দিকে এগোয়। বর্তমানে সারা বিশ্বে লিভার সিরোসিসের প্রধান কারণ হলো হেপাটাইটিস বি, সি এবং অ্যালকোহলিক লিভার ডিজিজ। কিন্তু ভবিষ্যতে লিভার সিরোসিসের প্রধান কারণ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে এই ন্যাশ। যদিও ডায়েট এবং এক্সারসাইজের মাধ্যমে এই ন্যাশ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। আগের দিনে বলা হতো, পাশ্চাত্য দেশে অবিসিটি, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, অ্যালকোহলিক রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। বর্তমানে আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। এতে পরিশ্রম করার প্রবণতা কমে গেছে, বাসার খাবারের পরিবর্তে ফাস্ট ফুড ও রেস্তোরাঁর খাবারের অভ্যাস গড়ে উঠেছে, হাঁটার পরিবর্তে গাড়িতে চলাচলের প্রবণতা বেড়েছে। এতে শরীরের ওজন বৃদ্ধি ও ফ্যাটি লিভার রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজকের এই আলোচনার বিষয়বস্তু মিডিয়ায় গুরুত্বসহকারে প্রচার পেলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে বলে আমি আশা করছি।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী
লিভার ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে লিভার সিরোসিস বা লিভার আক্রান্তদের শেষ চিকিৎসা। আমরা এত দিন জানতাম লিভার রোগের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ এবং অ্যালকোহল। কিন্তু ইদানীং যেটা দেখা যাচ্ছে, ন্যাশজনিত লিভার সিরোসিসই এর প্রধান কারণ। যদি আমেরিকা বা আমাদের সাবকন্টিনেন্টের কথা বিবেচনা করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে ন্যাশই হবে লিভার ট্রান্সপ্লান্টের প্রধান কারণ। আমাদের দেশেও হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’র পরে যে লিভার ট্রান্সপ্লান্টগুলো করাই, তা হচ্ছে এই ন্যাশ। আমাদের দেশে হেপাটাইটিস ‘বি’র পরিমাণ ৪ থেকে ৭ শতাংশ। হেপাটাইটিস ‘সি’ ১ শতাশং। আর ন্যাশ ১২ থেকে ১৭ শতাংশ। বাংলাদেশেও লিভার ট্রান্সপ্লান্টের দ্বিতীয় কারণ ন্যাশ। আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরে সারা বিশ্বে লিভার ট্রান্সপ্লান্টের প্রধান কারণই হবে ন্যাশ।
লিভার সিরোসিসের ১২ থেকে ১৩ শতাংশের লিভার ক্যান্সার হয়। তবে ন্যাশ সিরোসিস রোগে ক্যান্সারটা অতি তাড়াতাড়ি আরম্ভ হয়।
অধ্যাপক এম এ রশীদ
সারা পৃথিবীতে কমিউনিকেবল ডিজিজ কমে এলেও নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। আজকের যে আলোচনার বিষয় ‘ন্যাশ’ তা মানুষের কাছে এখনো ব্যাপকভাবে অজানা। আমার দৃষ্টিতে এটি একটি সাইলেন্ট কিলার। এটি পাবলিক হেলথ প্রবলেম। এটির ব্যাপারে আমাদের ব্যাপক গুরুত্ব দিতে হবে। ন্যাশের সঙ্গে অন্য ডিজিজগুলো শরীরকে আক্রান্ত করছে। এর মধ্যে হার্ট ডিজিজ, ব্রেন স্ট্রোক এমনকি অন্যান্য আট্রিয়াল ডিজিজও ন্যাশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমার কাছে মনে হয়, প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর। ন্যাশেরও প্রিভেনশন সম্ভব। আমরা যদি প্রতিদিন কিছু এক্সারসাইজ করি, ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখি এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করি তাহলে কিন্তু আমরা ন্যাশ প্রিভেন্ট করতে পারব, হার্ট ডিজিজ প্রিভেন্ট করতে পারব। একই সঙ্গে মন এবং স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। আমি মনে করি, আজকের এই আলোচনার বিষয়বস্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনার মাধ্যমে আমাদের দেশের জনগণ ন্যাশ সম্পর্কে জানতে পারবে। এ ক্ষেত্রে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াও ভূমিকা রাখতে পারে। হার্ট ডিজিজের সঙ্গে ন্যাশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এত দিন অনেক ডিজিজ মানুষের কাছে অজানা ছিল, তা এখন সামনে চলে আসছে। আগে মানুষ লিভারের ব্যাপারে অত গুরুত্ব দিত না, কিন্তু এখন যেহেতু ন্যাশ ইমাজিং প্রবেলেম, এটাও সামনে চলে আসছে। এতে প্রচুর লোক আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদি আমরা সম্মিলিতভাবে প্রিভেনশনের দিকে এগোই তাহলে ন্যাশও প্রিভেনশন সম্ভব। তবে এ জন্য মানুষকে ব্যাপকভাবে জানাতে হবে।
ড. নাজমা শাহীন
আগে আমরা ডাক্তারের কাছে গেলে বলতেন, রাইস ইটারদের ফ্যাটি লিভার থাকেই। সেটায় দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আজকে আমরা আলোচনা থেকে যে তথ্যগুলো পেলাম, সেখানে আমাদের দেশের ৩৪ শতাংশের ফ্যাটি লিভার, এর মধ্যে আবার ৩৬ থেকে ৫০ শতাংশের ন্যাশ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ফ্যাটি লিভার নিয়ে খুব নিশ্চিন্তে থাকার উপায় নেই। খাদ্যের সঙ্গে ওজন বৃদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে। যদি সুষম খাবার না খাই, আমাদের যতটুকু ক্যালরি প্রয়োজন এর চেয়ে যদি বেশি গ্রহণ করা হয় তাহলে ওজন বৃদ্ধির একটা ব্যাপার থাকে। ওজন বাড়লে বাড়ে কিন্তু ফ্যাটের অংশ। তখন বিভিন্ন অর্গানে ফ্যাট জমে, এর মধ্যে লিভার একটি। আমাদের খাবারগুলো পরিপাক করে এর পুষ্টি রক্তের মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে দেওয়ার জন্য লিভার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাবারের সঙ্গে আমরা যেসব রাসায়নিক গ্রহণ করছি সেগুলোও আমাদের শরীর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য যে লিভার থেকেই এনজাইম তৈরি হয়।
ড. তাহমীদ আহমেদ
সবার মধ্যে একটা ধারণা আছে, ফ্যাটি লিভার বা ন্যাশ উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তেরই হয়ে থাকে। আসলে এটা ঠিক নয়। ১৯৯৬ সালের বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভিসের দিকে তাকালে দেখব, আমাদের মা-বোনেদের ৫৪ শতাংশ, অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি আন্ডারওয়েট। আমরা যে উন্নয়ন লাভ করেছি এর ফলে ২০১৪ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১৯ শতাংশে। এর পাশাপাশি ১৯৯৬ সালে ওভারওয়েট ছিল ৩ শতাংশ, সেটা এখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ শতাংশে। এটা শুধু উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে নয়, যদি ঢাকার বস্তিগুলোতে যাওয়া যায়, তাহলেও দেখা যাবে অনেক মহিলাই ওভারওয়েট। বাংলাদেশের বস্তিগুলোতে ডায়াবেটিসের প্রার্দুভাব ১৮ শতাংশ। আর মহিলাদের মধ্যে এটা ২২ শতাংশ। ওভারওয়েট, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, অবিসিটি—সবই হচ্ছে ন্যাশের জন্য একটা ঝুঁকি। এসডিজির যে ৩ নম্বর লক্ষ্য আছে, এর একটি হচ্ছে মাতৃস্বাস্থ্য। প্রতি এক লাখ শিশুর জন্মের সময় এই মাতৃমৃত্যুর হার ৭০-এর নিচে রাখতে হবে। এই টার্গেট যদি আমরা বাংলাদেশ থেকে পূরণ করতে চাই তাহলে ফ্যাটি লিভার ডিজিজ ন্যাশ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
অধ্যাপক ডা. কাজী রকিবুল ইসলাম
আমাদের দেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। ইকোনমিক গ্রোথ কয়েক বছর ধরেই ৭ শতাংশের কাছাকাছি। ফ্যাটি লিভার ডিজিজ যে ন্যাশে পরিণত হচ্ছে এর মধ্য দিয়ে নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ বেড়ে যাচ্ছে। আমরা এত দিন কমিউনিকেবল ডিজিজ নিয়ে অনেক কথা বলছি, প্রিভেনশনের চেষ্টা করছি। নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের মধ্যে ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন, কার্ডিও ভাস্কুলার ডিজিজ, স্ট্রোক ইত্যাদি। এখন দেখা যাচ্ছে, এই ডিজিজগুলো হওয়ার ক্ষেত্রে ফ্যাটি লিভার বা ন্যাশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যেই ডিজিজগুলোতে মৃত্যু ঘটছে বা মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে সেগুলো নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ন্যাশ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। ন্যাশ রোগীর সংখ্যা যদি বেড়ে যায়, তাহলে আমাদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য খরচ ও সরকারের খরচের পরিমাণ বাড়ানোর প্রয়োজন হবে। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির খরচ হয় ৬৭ শতাংশ। যদিও আন্তর্জাতিকভাবে এটা ৩২ থেকে ৩৪ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া আছে।
অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সফি আহমেদ মুয়াজ
লিভারে চর্বি জমার বিষয়টি এত দিন বড়দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাচ্চাদেরও যে লিভারে চর্বি জমতে পারে তা অনেকেরই ধারণার বাইরে। বর্তমানে অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, বেশি ওজনের শিশুদের লিভারে চর্বি জমার আশঙ্কা বেশি। ২০১৮ সালে নিউ দিল্লি অ্যাপোলো হাসপাতালে ১৩টি প্রাইভেট স্কুলের ৯৬১ বাচ্চার মধ্যে সমীক্ষায় দেখা যায়, স্বাভাবিক ওজনের বেশি শিশুদের ৪৬ শতাংশেরই নন-অ্যালকোহেলিক লিভার ফ্যাটি ডিজিজ রয়েছে। ২২ শতাংশ স্বাভাবিক ওজনের শিশুদেরও একই ডিজিজ রয়েছে।
তবে আমাদের শিশুদের এই ডিজিজটি কেন হচ্ছে? মাঠে খেলাধুলা না করা বা সুযোগ না পাওয়া, বাসায় কম্পিউটার, মোবাইলে আসক্তি এবং জাংক ফুড খাওয়া ওজন বাড়ার প্রধান কারন। এ ছাড়া কিছু জেনেটিক কারণেও ফ্যাটি লিভার হতে পারে। আমাদের কাছে কিছু রোগী আসে, যাদের তেমন কোনো লক্ষণ আমরা দেখতে পাই না। মাঝেমধ্যে বাচ্চারা অ্যাবডোমেন পেইন নিয়ে আসে। তখন আমরা আলট্রাসনোগ্রাম করে বুঝি যে ফ্যাটি লিভার আছে। তবে সবার ক্ষেত্রে যে ন্যাশ হচ্ছে তা কিন্তু নয়। আর ন্যাশের পরিমাণটাও এখনো আমরা শিশুদের ক্ষেত্রে বুঝতে পারছি না। আর এ ব্যাপারে গবেষণাও কম।
ডা. মো. গোলাম মোস্তফা
লিভারে চর্বির আধিক্যের কারণে ন্যাশ হয়। অর্থাৎ অ্যালকোহলবিহীন চর্বির কারণে ন্যাশ হয়ে থাকে। পরামর্শপ্রত্যাশী লোকজন আমাদের কাছে জানতে চায় ন্যাশ কি প্রাণঘাতী রোগ? অথবা ন্যাশ আক্রান্ত রোগী কত দিন বাঁচবে? উত্তরে বলা যায়, লিভারে চর্বির কারণে লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সার হতে পারে। ন্যাশ আক্রান্ত রোগী লিভারের বিভিন্ন জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারে। ন্যাশ আক্রান্ত রোগীদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। হৃদরোগে মারা যাওয়া ন্যাশ রোগে আক্রান্তদের অন্যতম কারণ। এক গবেষণায় ১১৬ জন ন্যাশ রোগীর ওপর সমীক্ষা চালানো হয়। তাদের সবারই ডায়াবেটিস ছিল। তাদের ১০ বছর ছয় মাস সময় পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই সময়ে ২৭ জন রোগী মারা যায়। যারা মারা গেছে তাদের ৩১ শতাংশ ক্যান্সারে মারা গেছে।
ডা. মো. গোলাম আযম
মদ্যপান না করেও মদ্যপানজনিত কারণে লিভারে যে প্রদাহ হয়, সেটিই হলো ন্যাশ। আজকের দিবসটির নাম হলো ইন্টারন্যাশনাল ন্যাশ ডে। ন্যাশ অবশ্যই একটি ভয়াবহ রোগ। এটির চূড়ান্ত একটি পরিণতি হয়। এ জন্যই দিবসটির নাম ন্যাশ ডে করা হয়েছে। ন্যাশ হলো ফ্যাটি লিভারের একটি অংশ। অঙ্কের হিসাবে হিসাব করলে আমরা বলতে পারি, যদি ১০০ জন লোকের ফ্যাটি লিভার ধরা পড়ে, তার মধ্যে কিন্তু সবাই ন্যাশ রোগী নয়। আমাদের গবেষণায় আমরা দেখতে পেয়েছি, ১০০ জন ফ্যাটি লিভার রোগীর মধ্যে ৪৫ জনই ন্যাশে আক্রান্ত। আমাদের দেশে প্রায় চার কোটি রোগী রয়েছে ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। যার মধ্যে ১৮ লাখই হলো ন্যাশে আক্রান্ত। এই ১৮ লাখের পরিণতি কী হবে? সময়প্রক্রিয়ায় এটি বয়স বা লিঙ্গভেদে পার্থক্য হয়। কারো খাদ্যাভ্যাস, জীবনধারণের প্রক্রিয়া ও জেনেটিক কারণে এটির একটি চূড়ান্ত পরিণতি ধারণ করে ফাইব্রোসিস। পরের পরিণতি হলো লিভার সিরোসিস। লিভার সিরোসিস হলো লিভার ক্যান্সারের জন্য একটি উর্বর কারণ। সিরোসিস হয়ে গেলে ক্যান্সার হতে পারে। বাংলাদেশের ১৮ লাখ লোকের যদি ন্যাশ থেকে থাকে প্রতিবছর এদের মধ্যে ১৮ হাজার লোক ন্যাশের চূড়ান্ত পরিণতিতে ভুগছে। এর চিকিৎসা হলো লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন। কিন্তু প্রতিবছর বাংলাদেশে এই পরিমাণ লোকের প্লান্টেশন করার জন্য আমরা প্রস্তুত নই।
ডা. মো. ফিরোজ আমিন
সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও ডায়াবেটিস বাড়ছে। ডায়াবেটিস মূলত ‘রক্তে অনিয়ন্ত্রিত সুগার লেভেল’ হিসেবে চিহ্নিত একটি রোগ এবং এখন পর্যন্ত সাধারণত একে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে—টাইপ-১ এবং টাইপ-২। টাইপ-১ ডায়াবেটিস, যা সাধারণত ছোটবেলায় শুরু হয়, সেটি যেকোনো কারণেই হোক। টাইপ-২ ডায়াবেটিস হলো শরীরের ইনসুলিন তৈরির ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া। ৭৫ শতাংশই ডায়াবেটিস রোগীর আক্রান্তের কারণ হলো চর্বি। টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও ফ্যাটি লিভার ম্যানেজমেন্ট পার্ট প্রায় একই রকম। আমাদের দেশে একসময় শুধু কার্বোহাইড্রেডের কারণে ডায়াবেটিস হয় বলে উল্লেখ করা হতো। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ ক্যালরির খাবার। ক্যালরি রেসট্রিকশন খাবার আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ডা. সাইফুদ্দিন নিসার আহমেদ
ন্যাশ হলো একটি ক্রনিক ডিজিস। ন্যাশে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ডায়াবেটিস ও হাইপারটনেশন থাকে। চর্বিযুক্ত লিভারকে ফ্যাটি লিভার বলা হয়। সাধারণত অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে এ সমস্যা হয়। একপর্যায়ে লিভারে প্রদাহ তৈরি হয়। ন্যাশ বা নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটোহেপাটাইটিস লিভারে প্রদাহ তৈরি করে। একসময় এটা লিভার সিরোসিসের দিকে ধাবিত হয়। লিভার সিরোসিস থেকে ক্যান্সারের দিকে চলে যায়। হেমোরয়েডস হয়, বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয়। লিভার অকার্যকর হতে পারে। সেগুলো থেকে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। এ রোগ থেকে মুক্ত থাকতে হলে খাদ্য গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মদ্যপান, চর্বিজাতীয় ও ফাস্ট ফুড পুরোপুরি পরিহার করতে হবে। একই সঙ্গে শারীরিক ব্যায়াম, হাঁটাচলার ওপর জোর দিতে হবে। শরীরে চর্বি কমানোর জন্য খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামের পাশাপাশি কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ওষুধের মাধ্যমে লিভার থেকে চর্বি সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এসব ওষুধ শতভাগ কার্যকর তা বলা যাবে না।
আপনি ওজন কমিয়ে এবং স্বাস্থ্যসম্মত ওজন ও ডায়েটের মাধ্যমে ন্যাশ প্রতিরোধ করতে পারেন। ওজন কমানো বা নিয়ন্ত্রণ বা শরীরের চর্বি কমানোর জন্য ব্যায়াম অন্যতম মাধ্যম।
ডা. মো. সাইফুল ইসলাম এলিন
শুধু একটি কারণে ন্যাশ বা ফ্যাটি লিভার ডেভেলপ করে না। এটির পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো জিনগত পরিবর্তন। যেমন একই শহরে একই খাদ্যাভ্যাস বা একই রকম চলাফেরা করছে, এদের মধ্যে কিন্তু ফ্যাটি লিভার ডেভেলপ করছে না। আবার যাদের ফ্যাটি লিভার ডেভেলপ করেছে, তাদের কিন্তু সবার ক্ষেত্রে সিরোসিস হচ্ছে না, লিভার ক্যান্সারের দিকে যাচ্ছে না বা ন্যাশ হচ্ছে না। ফ্যাটি লিভারের দিকে, ক্যান্সারের দিকে বা ন্যাশের দিকে যাওয়ার কারণটা হলো, জেনেটিক মিউটেশন।
ডা. মো. আকমত আলী দিপু
ন্যাশ বলতেই বোঝায় সাধারণ ফ্যাটি লিভারের আরেক ধাপ ওপরের একটি রোগ। আমাদের একটি বিষয় বোঝার রয়েছে, ন্যাশ কি শুধু লিভারেই থাকে নাকি শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, ন্যাশ শুধু লিভারেই নয়, এর প্রভাব আমাদের শরীরের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। মস্তিস্ক, হার্ট, কিডনিসহ কয়েকটি অঙ্গে এর ক্ষতিকর প্রভাব জড়িত। মস্তিস্ক আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যার স্বাভাবিক কার্যকারিতার জন্য রক্ত চলাচল খুবই জরুরি। ন্যাশ রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের শরীরে রক্ত চলাচলে বাজে প্রভাব পড়ে। ফলে ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকিতে পড়ে ন্যাশ রোগী। ন্যাশের কারণে কিছু ক্ষতিকর উপাদান তৈরি হয়। যেগুলোর প্রভাব শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতো হার্টেও প্রভাব পড়ে।
ডা. কামরুল আনাম
সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য একটি মতবাদ আছে প্যাথোজেনোসিসের ব্যাপারে, সেটা হচ্ছে ‘টু হিট হাইপোথিসিস’। এটার ফার্স্ট হিট হচ্ছে ডেভেলপমেন্ট অব স্টেয়োসিস। এর অর্থ লিভারে যে সেলগুলো আছে, যাকে হেপাটোসাইট বলে। সেখানে যখন ট্রাইগ্লিসারাইড অ্যাকোমোলেড হয়, এটাকে বলা হয় স্টেয়াটোসিস। স্টেয়াটোসিসের পরিমাণ যখন ৫ শতাংশের বেশি হেপাটোসাইটে ইনভলব করে তখন এটা ফ্যাটি লিভারে টার্ন নেয়। যেহেতু এটা মেটাবলিক কারণে হচ্ছে, সেহেতু একে আমরা নন-অ্যালকোহলিক মেটাবলিক ডিজিজ বলছি। এটা মেটাবলিক ইমব্যালান্সের কারণে হয়। এই মেটাবলিক ইমব্যালান্স হয় অবিসিটি, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, ডায়াবেটিস, মেলাইটিসসহ কিছু জেনেটিক কারণে।
ডা. মুশফিকুল আবরার
এই রোগ শনাক্ত করা কঠিন এবং এর চিকিৎসা করা আরো কঠিন। নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটোহেপাটাইটিসে (সংক্ষেপে, ন্যাশ) ভুক্তভোগীদের লিভারে প্রদাহ হয়, যা সিরোসিস নামে পরিচিত স্থায়ী ক্ষতের দিকে চালিত করে এবং লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। কিছু বিশেষজ্ঞ ধারণা করছেন, কয়েক বছরের মধ্যে লিভার ট্রান্সপ্লান্টের সবচেয়ে বড় কারণ হতে পারে ন্যাশ। কেন চিকিৎসক ও রোগীরা এ রোগকে উপেক্ষা করেন? ‘এর কারণ হতে পারে, তাঁরা এটি দেখেন না, অর্থাৎ এটি শনাক্ত করা কঠিন।’ ন্যাশের প্রাথমিক পর্যায়ে উপসর্গ দেখা যায় না বললেই চলে। অর্থাৎ এ পর্যায়ে উপসর্গ বিরল। এটি শনাক্ত করতে লিভার বায়োপসির প্রয়োজন, যেখানে ছোট নিডল দিয়ে লিভার থেকে কোষ অপসারণ করা হয়। উপসর্গ বিরল বলে এ রোগ শনাক্ত করতে খুব দেরি হয়ে যায়, যা লিভার বিকলের কারণ হতে পারে এবং বর্তমানে এর কোনো উপযুক্ত চিকিৎসা নেই। তার পরও সুখবর রয়েছে! আপনি ওজন কমিয়ে এবং স্বাস্থ্যসম্মত ওজন ও ডায়েটের মাধ্যমে ন্যাশ প্রতিরোধ করতে পারেন।
আশরাফ উদ্দিন আহমেদ
আজকের এই গোলটেবিল বৈঠকে সবার উপস্থিতির জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ন্যাশজাতীয় রোগের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় থাকে। একটি হচ্ছে মানুষের মধ্যে সচেতনতা আর অন্যটি হচ্ছে ট্রিটমেন্ট। সচেতনতার ক্ষেত্রে আমরা হেপাটোলজি সোসাইটিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এ ধরনের আয়োজনে আমাদের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। ভবিষ্যতে আরো বড় কোনো আয়োজনেও আমরা সহযোগী হতে চাই। ট্রিটমেন্টের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের ওষুধই আমরা উৎপাদন ও বাজারজাত করে থাকি। মেটফরমিন, পিয়োগ্লাটিজন, ইনসুলিনসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ আমরা বাজারজাত করে থাকি। আমরা আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, ভবিষ্যতেও যেসব ওষুধ বিশ্ববাজারে আসবে সেগুলো এ দেশে সস্তায় ও কম দামে দিতে পারব।
তৌফিক মারুফ
একটি জাতীয় দৈনিক হিসেবে রাজনীতি, অর্থনীতির পাশাপাশি যে ইস্যুগুলোর সঙ্গে মানুষের সরাসরি সংযোগ আছে সেগুলো নিয়ে আমরা কালের কণ্ঠ কাজ করি। সেই হিসেবে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানা বিষয় নিয়ে আমরা প্রায় প্রতি মাসেই নিজেরা অথবা যৌথভাবে গোলটেবিল বৈঠক করে থাকি। ন্যাশ শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই একটি হুমকি। বাংলাদেশে ফুড সেফটি বড় একটি হুমকি। আমরা নিউট্রিশনের জন্য খাচ্ছি, কিন্তু সেই খাদ্যটা যদি নিরাপদ না হয় তাহলে সেটি ভালোর চেয়ে খারাপের দিকে নিয়ে যায়। মানুষ এখনো স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের বিষয়টি বোঝে না। তারা মনে করে ঠিকমতো ধোয়ামোছা হলেই বুঝি স্বাস্থ্যসম্মত হয়। কিন্তু এখন খাদ্যে যেসব কেমিক্যাল, হেভি মেটাল পাওয়া যাচ্ছে তা আপনারাই তুলে ধরছেন। ন্যাশকে মহামারি থেকে ঠেকাতে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে বড় একটি আন্দোলন দরকার। এ ব্যাপারে মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার।
ডা. মো. শাহিনুল আলম
এটি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটোহেপাটাইটিসের (এনএএসএইচ বা ন্যাশ) দিবস। এটি কি কোনো মহামারি রোগ? এ সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? আমরা কি এই রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত—এ ধরনের অনেক প্রশ্ন আমাদের সামনে তৈরি হয়েছে। হোপাটোলজি সোসাইটির তত্ত্বাবধায়নে লিভার বিশেষজ্ঞরা ২০০৭ সাল থেকে ফ্যাটি লিভার নিয়ে গবেষণা করছেন। এ পর্যন্ত আমাদের ১৪টি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা ও অনেক আর্টিকেল আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া ২৪টি গবেষণালব্ধ ফলাফল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রকাশ ও উপস্থাপন করা হয়েছে। হোপাটোলজি সোসাইটির তত্ত্বাবধায়নে এসব গবেষণা প্রকাশ করে আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কারও লাভ করেছেন। গত বছর থেকে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক ন্যাশ ডে পালন করা হচ্ছে। দেশে আমাদের ধারণার বেশি পরিমাণ ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। এটি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে মনে হয়েছে, এটি মহামারি।
যাঁরা অংশ নিয়েছেন
অধ্যাপক মবিন খান
সভাপতি, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ
অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী
হেপাটোবিলিয়ারি প্যানক্রিয়াটিক সার্জারি ও লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন, বারডেম
অধ্যাপক এম এ রশীদ
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট
ড. নাজমা শাহীন
অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. তাহমীদ আহমেদ
সিনিয়র ডিরেক্টর, আইসিডিডিআরবি
অধ্যাপক ডা. কাজী রকিবুল ইসলাম
সাধারণ সম্পাদক, ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট
অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সফি আহমেদ মুয়াজ
পরিচালক, ঢাকা শিশু হাসপাতাল
ডা. মো. গোলাম মোস্তফা
সহযোগী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
ডা. মো. গোলাম আযম
সহযোগী অধ্যাপক, বারডেম
ডা. মো. ফিরোজ আমিন
সহযোগী অধ্যাপক, বারডেম
ডা. সাইফুদ্দিন নিসার আহমেদ
লিভার বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
ডা. মো. সাইফুল ইসলাম এলিন
লিভার বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
ডা. মো. আকমত আলী দিপু
সহযোগী অধ্যাপক, আদ্ দীন মেডিক্যাল কলেজ
ডা. কামরুল আনাম
লিভার বিশেষজ্ঞ
ডা. মুশফিকুল আবরার
লিভার বিশেষজ্ঞ
আশরাফ উদ্দিন আহমেদ
জেনারেল ম্যানেজার (সেলস), ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস
তৌফিক মারুফ
ডেপুটি চিফ রিপোর্টার, কালের কণ্ঠ ও সভাপতি, বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম
সঞ্চালক
ডা. মো. শাহিনুল আলম
সহযোগী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়